‘সাধু ভাষা’ ও ‘চলিত ভাষা’ বাংলা ভাষারই দুটো রীতি। এক রীতির সাথে অন্য রীতি মিলিয়ে ফেললে ভাষা অসুন্দর হয়, ভাষারীতিতে ত্রুটি ঘটে; তাই এ ধরনের মিশ্রণ অবশ্যই দূষণীয় ও বর্জনীয়। যেমন, যদি লিখি
‘আমি শব পোড়াতে গিয়াছিলাম’
তাহলে ভুল হবে; কেননা, ‘শব’ সাধু রীতির শব্দ, ‘গিয়াছিলাম’ ও তাই, অথচ ‘পোড়াতে’ চলিত ভাষার রূপ। তাই লেখা উচিত
সাধু ভাষায় : ‘আমি শব দাহ করিতে গেয়াছিলাম’ কিংবা ‘আমি মড়া পোড়াইতে গিয়াছিলাম’।
চলিত ভাষ : আমি মড়া পোড়াতে গেছিলাম।
সাধু ও চলিত ভাষার ত্রুটিপূর্ণ মিশ্রণকে ‘গুরুচণ্ডালী দোষ’ বলে।
এ ‘গুরুচণ্ডালী ভাষাদোষে দুষ্ট’ হবার জন্যে বাংলা গদ্যের প্রথম পর্যায়ের কোনো কোনো গদ্য – লেখককেও বিদ্রুপ করে বলা হতো ‘শব-পোড়া’ ‘মরা-দাহে’র দল (‘শব-দাহ’ বা ‘মরা-পোড়া’ না বলে)। তাই, বাংলা গদ্যে বা রচনায় এবং চলিত কথাবার্তায় এ দুই রীতির মিশ্রণ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ এবং দূষণীয় এবং বর্জনীয়ও বটে। নিচে গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট ভাষার একটি উদাহরণ লক্ষ করা যাক-
“ধরণীর মধ্যে সবচেয়ে বড় জিনিস জানিবার ও বুঝিবার প্রবৃত্তি মানুষের মন থেকে যেদিন চলিয়া যাবে সেদিন মানুষ আবার পশুত্ব লাভ করবে।”
উল্লিখিত অশুদ্ধ বাক্যটিতে সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণের ফলে তা গুরুচণ্ডালী ভাষা-দোষে দুষ্ট। এ-বাক্যটির শুদ্ধ সাধু ও চলিত রূপ হবে নিম্নরূপ :
সাধু রীতিতে সংশোধন : ধরণীর মধ্যে যাহা সবচাইতে বড় জিনিস তাহা জানিবার ও বুঝিবার প্রবৃত্তি মানুষের মন হইতে যেই দিন চলিয়া যাইবে সেই দিন মানুষ আবার পশুত্ব লাভ করিবে।
চলিত রীতিতে রূপান্তর : পৃথিবীর মাঝে যা সবচেয়ে বড় জিনিস তা জানবার ও বুঝবার প্রবণতা মানুষের মন থেকে যেদিন চলে যাবে সেদিন মানুষ আবার পশুত্ব লাভ করবে।
ব্যতিক্রম : (গুরুচণ্ডালী ভাষা দোষে দুষ্ট ভাষার সীমাবদ্ধতা)
কবিতা রচনার ক্ষেত্রে ছন্দের প্রয়োজনে ও মাত্রাসঙ্গতির কারণে ‘সাধু’ ও ‘চলিত’ রীতির মিশ্রণ ঘটলে সাধারণত তা দূষণীয় বলে বিবেচিত হয় না। কবিতা রচনার সময় কবিকে নির্দিষ্ট মাপে শব্দ ব্যবহার করতে হয়। ছন্দের রীতি অনুসরণ করে বিশেষ বিশেষ মাপে শব্দের প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। পঙ্ক্তির শেষে মিল রাখতে হয়। ফলে কবিগণ শব্দের ব্যবহারে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করেন। তাই কবিদের বেলায় সাধু আর কথ্য মিশ্রণ স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। যেমন : ‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।’ - - এই দৃষ্টান্তে ‘উহারে’ শব্দটি সাধু রীতির। কিন্তু ‘দেখে’ ক্রিয়াপদ তথ্য রীতির। সাধু রীতির সবর্চনামপদ ‘উহারে’ কথ্য রীতিতে পরিবর্তিত করে ‘ওরে’ করলে কবিতায় ছন্দোপতন ঘটবে। আরেকটি উদাহরণ লক্ষ করি –
“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারা দিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।”
এখানে ‘উঠিয়া’ ক্রিয়াপদ সাধু রীতির, আর ‘হয়ে’ ক্রিয়াপদ কথ্য রীতির। দুটিকে যে-কোনো একটি রীতিতে প্রয়োগ করলে কবিতার ত্রুটি ঘটবে। কবিরা ছন্দ মেলানোর সুবিধার জন্যে এ ধরনের সাধু – কথ্যের মিশ্রণ ঘটানোর ব্যাপারে সব সময়েই স্বাধীনতা পেয়ে থাকেন।
সংগ্রহ : ভাষা-শিক্ষা, বাংলা ব্যাকরণ ও রচনারীতি; ড. হায়াৎ মামুদ