পৃথিবীর অধিকাংশ সুগঠিত ভাষারই আদি উৎস খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে। জেনে অবাক হবার কথা যে, বিশ্বের যাবতীয় ভাষার উৎপত্তি হয়েছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি মূল ভাষাগোষ্ঠী থেকে। তাদের মধ্যে একটি হলো ‘ইন্দো-ইউরোপিয়’ বা ‘আদি আর্য ভাষাগোষ্ঠী’। এই ভাষাগোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়েছে অনেকগুলো ভাষার। সেগুলোই মূলত বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত ভাষা। অসমিয়াকে বাদ দিলে ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষাবংশের পূর্বদিকের সবচেয়ে প্রান্তিক ভাষা বাংলা। নব্য ভারতীয় আর্যগোষ্ঠীর এই ভাষা ঐতিহাসিক সূত্রে আইরিশ, ইংরেজি, ফরাসি, গ্রিক, রুশ, ফারসি ইত্যাদি ভাষার দূরবর্তী জ্ঞাতিভগ্নী। বর্তমানে বাংলাদেশে বাংলা প্রায় একমাত্র এবং ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যবহৃত প্রধান ভাষা। এর পশ্চিমে ওড়িয়া, মাগধী, মৈথিলী এবং পূর্বে অসমিয়া ভাষার সীমান্ত। এছাড়া সাঁওতালী, মুণ্ডারি, খাসি ইত্যাদি অস্ট্রিক গোত্রের ভাষা এবং কাছারি, বোড়ো, গারো, ত্রিপুরী ইত্যাদি ভোট-বর্মী গোত্রের ভাষাও বাংলাকে ঘিরে রেখেছে, কখনও বা তার অঞ্চলে প্রবিষ্টও হচ্ছে।
“হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা রূপান্তরিত হয়ে বঙ্গীয় অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিল এক মধুর-কোমল-বিদ্রোহী প্রাকৃত। তার নাম বাংলা। এই ভাষাকে কখনো বলা হয়েছে ‘প্রাকৃত’, কখনো বলা হয়েছে ‘গৌড়ীয় ভাষা’। কখনো বলা হয়েছে ‘বাঙালা’ বা বাঙ্গালা’। এখন বলি ‘বাংলা’।”
বাংলা ভাষার প্রকৃত উৎপত্তিকাল নির্ণয় করা কঠিন। এ পৃথিবীতে আসার পর থেকেই মানুষ কথা বলে ভাষার সৃষ্টি করেছে। আদি মানবের যে-ভাষা ছিল তা মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে কালক্রমে বহু ভাষার রূপ পরিগ্রহ করেছে। আজকের পৃথিবীতে ৫০০ কোটি মানুষের ভাষার সংখ্যা ৩৫০০ বলে অনুমান করা হয়।
মানুষের মুখে কেমন করে ভাষা এল তা এক অপার রহস্য। কারণ বাঙালির মুখে বাংলা ভাষা যে-দিন জন্মেছিল, সে-দিনই তা কেউ লিখে রাখে নি। মানুষের বুক থেকে মানুষের মুখে এসে ধ্বনিত হয়ে আদি বাংলা ভাষা মিশে গেছে আকাশে-বাতাসে। বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষায় কথা বলত না। এর রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও বিবর্তনধারা। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মধ্য-এশিয়ায় একদল লোক বাস করত। তারা প্রথম যে-ভাষা ব্যবহার করেছিল তার নাম ‘ইন্দো-ইউরোপিয়’ মূলভাষা। পরবর্তীকালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের পক্ষে একস্থানে বসবাস করা আর সম্ভব হয় নি, তখন তারা ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শাখাগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে পড়ায় বিভিন্ন শাখার ভাষার মধ্যে ভাষাগত পরিবর্তন দেখা দেয়। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষাগোষ্ঠীর একদল ভারতে প্রবেশ করেন। তাঁদের ভাষা ‘আর্য’ (noble) ভাষারূপে পরিচিত ছিল। তাঁরা পেছনে আর একটি দল রেখে আসেন, যাঁরা ইরান ও মধ্য-এশিয়ায় বসবাস শুরু করেন। ইরানীয় ও ভারতীয় আর্য একত্রে ইন্দো-ইরানিয় ভাষা নামে পরিচিত। ইন্দো-ইরানিয় ভাষার প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায় ঋক্ বেদে (১২০০-১১০০ খ্রিস্টপূর্বে রচিত)। এ সময় থেকেই ভাষা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকেই আর্যরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ভারতবর্ষে আসতে শুরু করেন। সঙ্গে ছিল তাঁদের শক্তিশালী বৈদিক ভাষা ও দেবগীতিমূলক সাহিত্য। ধীরে ধীরে তাঁরা ভারতবর্ষের বহুস্থানে ছড়িয়ে পড়েন। স্থানীয় অনার্য অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি আত্মসাৎ করে তাঁরা একদিন আর্যভাষার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। কালক্রমে ভারতে বসবাসকারী আর্যদের ভাষা জলবায়ুগত প্রভাবে, অনার্য ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রণের ফলে এক ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করল। প্রয়োজন হল বৈদিক ভাষার সংস্কার। সংস্কারজাত নতুন ভাষাই হল সংস্কৃত ভাষা। কিন্তু এ ভাষা তথাকথিত বিদগ্ধ ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল।
অথচ ভাষা হল সতত বহতা নদীর মতোই প্রবাহমাণ। সে থামে না। প্রতিকূলতার মধ্যেও সে আপন চলার পথ খুঁজে নেয়। সাধারণের বোধগম্য ভাষা উপেক্ষা করে কার সাধ্য? জন্ম নিল ‘প্রাকৃত ভাষা’। ‘প্রাকৃত’ বা ‘প্রাকৃত ভাষা’ কথাটির তাৎপর্য হল প্রকৃতির অর্থাৎ জনগণের কথ্য ও বোধ্য ভাষা। পরবর্তীকালে এই ‘প্রাকৃত’ ভাষাই ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রভাবে, কথ্য ভাষার উচ্চারণের বিভিন্নতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করল। এই ‘প্রাকৃত ভাষা’ই আঞ্চলিক বিভিন্নতা নিয়ে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত হল। যেমন, ‘মাগধী প্রাকৃত’, ‘মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত’, ‘শৌরসেনী প্রাকৃত’, ‘পৈশাচী প্রাকৃত’ ইত্যাদি। মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশ (বা অবহটঠ অর্থাৎ যা খুব বিকৃত হয়ে গেছে) থেকেই কালক্রমে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে উৎপত্তি লাভ করে বাংলা ভাষা।
বাংলা ভাষা বিবর্তনের রূপরেখা |
ঊনিশ শতকে বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে কারোরই কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বিভিন্ন সম্পর্কিত ভাষার সাথে বাংলার সম্পর্কের সূত্রও উদ্ঘাটিত হতে শুরু করে। বিশ শতকের প্রথম দশকে বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে কাঠামোবিষয়ক বিতর্ক বাংলা ভাষার উদ্ভব বিষয়ক ধারণার সাথে জড়িত হয়ে পড়ে : সংস্কৃতপন্থীরা সংস্কৃত উৎসে বিশ্বাসী থাকে, কিন্তু বাংলাপন্থীরা বিশ্বাসী হয় প্রাকৃতের বিবর্তনে।
বিশ শতকের নবম বৎসরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। একজন অমর হয়ে গেছেন আদি বাংলা ভাষা আবিষ্কার করে। তিনি হলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি সেই ভাগ্যবান যাঁর প্রথম দেখতে পেয়েছিল প্রথম যুগের বাংলা ভাষার মুখ। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারে সন্ধান পান তিনটি পুঁথির, আর বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের এক গোয়ালঘরে সন্ধান পান একটি পুঁথির। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কার প্রকাশিত হয় ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ (১৯১৬ : ১৩২৩), ও বসন্তরঞ্জনের আবিষ্কার প্রকাশিত হয় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ (১৯১৬ : ১৩২৩) নামে।
চর্যাপদের পুঁথির একটি পাতা : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন |
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথির একটি পাতা : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন |
এ-দুটি গ্রন্থ প্রকাশের পর সূচিত হয় বাংলা ভাষার ইতিহাস সন্ধানের যুগ- বিজয়চন্দ্র মজুমদার (১৯২০), সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯২৬), সুকুমার সেন (১৯৭১), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৬৩) প্রমুখের অনুসন্ধান ও গবেষণা। ঐ গ্রন্থ দুটির রচনাকাল নির্ণয় ও ভাষার বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে রচিত হয় বিপুল পরিমাণ প্রবন্ধ; এবং বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে ধারণা স্বচ্ছ হয়ে ওঠে অনেকখানি। এ-উদ্যোগের শ্রেষ্ঠ ফল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ (১৯২৬)। তাঁকেই গণ্য করতে হয় বাংলা ভাষার প্রধান ঐতিহাসিকরূপে। বহুবিষয় আলোচনা করে গ্রন্থের বিরাশি পাতায় সুনীতিকুমার উপনীত হন এ-সিন্ধান্তে : ‘ইন্দো-আর্যভাষা, মধ্যভারভীয় আর্য ভাষা স্তরের প্রথম পর্যায়ে, বাংলায় আগমনের এক হাজার বছরের মধ্যে (খ্রি.পূ. ৪০০ – খ্রি. ৯০০) রূপান্তরিত হয় বাংলা ভাষায়।’ তিনি মাগধী অপভ্রংশকে মেনে নেন বাংলায় উৎস-ভাষা হিসেবে এবং এ-গোত্রে বিন্যস্ত করেন অসমিয়া, ওড়িয়া, মাগধী, মৈথিলী, ভোজনপুরিয়াকে। তিনি বাংলা ভাষার গঠনকাল হিসেবে নির্দেশ করেন ৭০০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ; আদি বাংলা যুগ হিসেবে নির্দেশ করেন ৯৫০-১২০০ অব্দকে; মধ্য বাংলা যুগ হিসেবে নির্দেশ করেন ১২০০ – ১৮০০; এবং এর পরের সময় আধুনিক যুগ।
সুনীতিকুমারের পরেই বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে যাঁর মত মূল্য পেয়ে থাকে তিনি হলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৬৩)। তিনি মনে করেন ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোন সময়ে, অর্থাৎ সপ্তম শতকে, গৌড়ী প্রাকৃত থেকে জন্ম নিয়েছিল আধুনিকতম প্রাকৃত বাংলা ভাষার।
বাংলা ভাষা তার জন্মের পর থেকে বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান কাল পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। প্রথম থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়ের বাংলা ভাষাকে তিন যুগে ভাগ করা হয়। যেমন :
(ক) প্রাচীন যুগ : খ্রিস্টীয় ৬৫০ (মতান্তরে ৯৫০) থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত।
(খ) মধ্য যুগ : খ্রিস্টীয় ১২০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত।
(গ) আধুনিক যুগ : খ্রিস্টীয় ১৮০০ থেকে বর্তমান পর্যন্ত।
এর মধ্যে ১২০১ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত কালকে সন্ধিযুগ বা অন্ধকার যুগ ধরা হয়। তবে বর্তমান গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এ যুগ অন্ধকার যুগ নয়।
সংগ্রহ : ভাষা-শিক্ষা, বাংলা ব্যাকরণ ও রচনারীতি; ড. হায়াৎ মামুদ