মার্চের দিনগুলি

রচনা : জাতিসংঘে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী

ভূমিকা : বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মহান ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতিসংঘ। পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা মানব সমাজকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করে। এই অনুপ্রেরণা থেকেই উদ্ভব হয় জাতিসংঘের। জাতিসংঘের ৬টি মূল অঙ্গ সংস্থা এবং অনেকগুলি সহযোগী সংস্থা বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে শান্তি স্থাপনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের এই কার্যক্রমের এক গর্বিত অংশীদার।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন : বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা জাতিসংঘের প্রধান কাজ। এক দেশের সাথে অন্য দেশের বিরোধ নিরসন ও মধ্যস্থতায় জতিসংঘ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং জাতিগত দাঙ্গা মোকাবিলায় এরূপ পদ্ধতি পুরোপুরি কার্যকরী নয়। সেখানে নিরাপত্তার প্রশ্নে সামরিক শক্তি প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন গঠিত হয়েছে।

মিশনের পরিচিতি : জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। সদস্য দেশগুলোর প্রেরিত সামরিক সদস্যরাই এর প্রধান শক্তি। নিরাপত্তা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন দেশের সামরিক, বেসামরিক ও আধা-সামরিক লোকজন নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে (ইসরাইল-ফিলিস্তিন) কেন্দ্র করে প্রথম শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠন করা হয়। এর পর থেকে যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সেখানেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ করেছে। অভাবক্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর নিকট ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে সহায়তা করা এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশের পুনর্গঠনে শান্তিরক্ষী বাহিনী জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজ করছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে জাতিসংঘ এ পর্যন্ত ৬৫ টি মিশন পরিচালনা করেছে এবং এর মধ্যে চলমান আছে ১৫টি মিশন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী ১৯৮৮ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে।

শান্তিরক্ষী মিশনের কাজ : জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন যে কাজ করে তার মধ্যে প্রধান হলো- বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি তদারকি ও কার্যকর করা, স্থিতাবস্থা বজায় রাখা ও গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচন পরিচালনা করা, বিবাদমান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সমঝোতা ও চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি করানো, ভূমি আইন অপসারণ করা, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো পুনর্গঠনে সহায়তা করা, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, শরণার্থী ও উদ্বাস্তুদের মানবিক সাহায্য প্রদান ইত্যাদি।

শান্তিরক্ষা মিশন ও বাংলাদেশ : জাতিসংঘের বিশ্বশান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ বরাবরই সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। শান্তিরক্ষা মিশনে জাতিসংঘের আহবানে বাংলাদেশ প্রথম অংশগ্রহণ করে ১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে। সে যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল প্রশংসাযোগ্য। এর পর দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে (২০১৩ সাল পর্যন্ত) বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী যেমন-সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ প্রভৃতি কৃতিত্বের সাথে এই মহতী দায়িত্ব পালন করে আসছে। বাংলাদেশি এসব বাহিনী দৃঢ় মনোবল, উন্নত শৃঙ্খলা, কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ১৫টি মিশনের মধ্যে ১২টিতে কাজ করছে। সব মিলে ৫৪টি মিশনে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী অংশগ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকা : জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী অংশগ্রহণ করলেও সেনাবাহিনীর ভূমিকাই প্রধান। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মূলমন্ত্র হলো ‘শান্তিতে আমরা, সমরে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অবদান দেখলে মনে হয় সারা বিশ্বের সব দেশই যেন বাঙালি সেনাবাহিনীর নিজ দেশ। সকল দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষাই যেন তাদের কাজ। আর তাইতো বাংলাদেশ বর্তমানে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সর্বোচ্চ সংখ্যক সেনা প্রেরণকারী দেশ। জাতিসংঘের বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উল্লেখযেগ্য কার্যক্রমসমূহের বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো-

নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ : শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে বিভিন্ন দেশের ভিআইপি, ভিভিআইপি, সরকারি মালামাল রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিবহন এবং সাধারণ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কাজ। বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই কাজটি দক্ষতার সাথে পালন করছে।

সামরিক পর্যবেক্ষক : বিবাদমান পক্ষসমূহের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি-না, কোথাও শান্তি ভঙ্গ হচ্ছে কি-না, অথবা শান্তির প্রতি হুমকি স্বরূপ কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে কি-না তা পর্যবেক্ষণ করে শান্তিরক্ষী বাহিনী। লাইবেরিয়া, লেবানন, কঙ্গো, সুদান, আইভরি কোস্ট প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত সুনামের সাথে এ দায়িত্ব পালন করেছে এবং করছে।

অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাইন উদ্ধার : যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোতে শান্তির প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে দেশে ছড়িয়ে থাকা অস্ত্র ও ভূমিতে পেতে রাখা মাইনসমূহ। ভূমিতে পেতে রাখা মাইনে অসংখ্য নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও ল্যান্ড মাইন উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা : প্রধানত দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ অঞ্চলের অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দূর করতে মিশন কাজ করে। এ বাহিনীর অন্যতম কাজ হলো দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ, বিশৃঙ্খল অঞ্চলে শৃঙ্খলা আনয়ন করা। সংশ্লিষ্ট দেশের বাহিনীকে এ কাজে সহায়তা করা। বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা পূর্ব তিমুর, কঙ্গো, সুদান, লাইবেরিয়া, হাইতি প্রভৃতি দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে।

শান্তি প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা : জাতিসংঘ বাহিনী যুদ্ধরত অঞ্চলে শান্তি আনয়নে কাজ করে। এক্ষেত্রে বিবাদমান সকল গ্রুপ, দল, উপদলের স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষা করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেয় মিশন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করে সফলতা অর্জন করেছে। লাইব্রেরিয়ার কাউন্টির ডানকাপানসু গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী বড় ভূমিকা পালন করে।

নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা করা : বিভিন্ন দেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শান্তিরক্ষী বাহিনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্বাচন পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।

মানবিক সহায়তা প্রদান : যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, শরণার্থী ও উদ্বাস্তুদের মানবিক সহায়তা প্রদান, চিকিৎসা সেবা প্রদান ইত্যাদি কাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বেশ সুনাম অর্জন করেছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিটগুলো কর্মরত প্রতিটি দেশের মানুষের জন্যই প্রচুর পরিমাণ ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে যায়। এছাড়াও স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কন্টিনজেন্ট।

স্থানীয় যুব সমাজকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান : মিশনে কর্মরত বাঙালি সেনারা বিভিন্ন দেশের স্থানীয় যুব সমাজকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেয়। শান্তিরক্ষার পাশাপাশি এরূপ কার্যক্রম স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। রাজমিস্ত্রি, ইট তৈরি, টেইলারিং, অ্যাম্রয়ডরি, কাঠমিস্তি, ইলেকট্রিক কাজ, কম্পিউটার, উন্নত কৃষি চাষাবাদ পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত দল হাত কলমে শিক্ষা দেয় স্থানীয় যুব সমাজকে।

অবকাঠামো উন্নয়ন : বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন দেশের মৌলিক অবকাঠামো সংস্কার ও উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে থাকে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদানের স্বীকৃতি : জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকতিস্বরূপ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সিয়েরা লিওন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছে, লাইবেরিয়া একটি সড়কের নাম রেখেছে বাংলাদেশ স্ট্রীট। এর থেকেও বড় স্বীকৃতি ও প্রাপ্তি হলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশসমূহের সাধারণ মানুষের মুখে ফুটিয়ে তোলা হাসি ও তাদের ভালোবাসা।

উপসংহার : বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন যে অবদান রেখে চলছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনীর ভূমিকা এবং সাফল্য আমাদেরকে গর্বিত করেছে। এর মধ্যে আবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকাই মুখ্য। এ পর্যন্ত শতাধিক বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর মৃত্যু হয়েছে। তারপরও বাঙালিদের শৃঙ্খলাবোধ, পেশাদারীত্ব এবং দক্ষতা স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। এটি দেশ ও জাতির নিকট অত্যন্ত গৌরবের বিষয় বলে বিবেচিত।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post