ভূমিকা : বিশ্বের বৃহৎ বদ্বীপ বাংলাদেশ। কক্সবাজার হলো এই বদ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম এবং বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা। এখানে প্রতিবছরই দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। কক্সবাজার আসলে একই সাথে নদী, সাগর, পাগাড়, সমতল, উপজাতিদের সংস্কৃতি, দর্শনীয় স্থান দেখার অপার সুযোগ মেলে। এই সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। বর্তমানে কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সমুদ্র সৈকত কী : সমুদ্র সৈকত হলো এক ধরণের ভূ-তাত্ত্বিক স্থলভাগ। যা গড়ে উঠে কোনো জলভাগের পাশে। সাধারণত সমুদ্রের পাশে গড়ে উঠা স্থল ভাগকে সমুদ্র সৈকত বলা হয়। যে সকল স্থানে বাতাসের প্রবাহ এবং মহাসাগরীয় স্রোতে কার্যকর হয় সেসকল স্থানে ভূ-তাত্ত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সমুদ্র সৈকত সৃষ্টি হয়।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত : অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। আর সমুদ্র সৈকতগুলো এই সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত। এদেশের উল্লেখযোগ্য সমুদ্র সৈকতগুলো হলো- কক্সবাজার ও ইনানী, পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা এবং চট্টগ্রাম জেলার পতেঙ্গা ইত্যাদি। এদের মধ্যে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের দৈর্ঘ্য ১২০ কি.মি। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পুরো সৈকতটি বালুকাময়। কাদার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
অবস্থান : বন্দরনগরী চট্টগ্রাম হতে প্রায় ১৫৫ কি.মি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত কক্সবাজার। এটি একটি জেলা শহর। আর এই শহরেই অবস্থিত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। যা কক্সবাজার শহর থেকে বদর মোকাম পর্যন্ত একটানা ১২০ কি.মি পর্যন্ত বিস্তৃত। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ২৫ কি.মি দূরে ইনানী সমুদ্র সৈকত এবং ৮-১০ কি.মি দক্ষিণে রয়েছে হিমছড়ি নামক অতি মনোরম স্থান।
ইতিহাস : প্রতিটি স্থানেরই নামের পেছনে একটি ইতিহাস থাকে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যে, ১৭৯৭ সালে বার্মার (মায়ানমার) আরাকান অঞ্চলে গোলযোগ দেখা দেয়। ফলে সেখান থেকে বাঙালিদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। এই বিতাড়িত ছিন্নমূল বাঙালিরা বর্তমান কক্সবাজার, উখিয়া, গুনডুম প্রভৃতি অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। ঐ সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একজন দূত ক্যাপ্টেন কক্স বার্মার রাজ দরবারে কাজ করতেন। তিনি কোম্পানীর নির্দেশে এখানকার শরণার্থীদের তদারকি এবং ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য কক্সবাজার ছুটে আসেন। তখন এখানকার সমগ্র এলাকা মশা ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষের বসবাসের অযোগ্য ছিল। ক্যাপ্টেন কক্স এমন পরিবেশে অস্বস্তিবোধ করলেও শরণার্থীদের ফেলে চলে যায়নি। বরং তিনি তাদের জন্য কাজ করতে থাকেন। তখন এই সাগর তীরের নাম ছিল ‘ফালকিং’। অবশেষে ১৮০২ সালে ক্যাপ্টেন কক্স এখানে মারা যান এবং তার নাম অনুসারেই স্থানটির কক্সবাজার নামকরণ করা হয়।
বর্ণনা : পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত হলো কক্সবাজার। বিধাতা যেন বাংলার সব রূপ ঢেলে দিয়েছেন বালুর আঁচলে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রবেশ করতেই কানে ভেসে আসে সাগরের উত্তাল গর্জন। এই সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য। বালুচড়ে অনেক সময় দেখা যায় লাল রঙের রাজ কাকড়া। গভীর জলে মাছ ধরে জেলেদের ফিরে আসার দৃশ্য সত্যিই অপরূপ। বালিয়াড়ি সৈকত সংলগ্ন শামুক-ঝিনুক এবং নানা প্রজাতির প্রবাল সমৃদ্ধ বিপণি বিতান অত্যাধুনিক হোটেল, মোটেল, কটেজ, নিত্য সাজে সজ্জিত বার্মিজ মার্কেটসমূহ আর পর্যটকদের বিচরণে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত প্রাণ-চাঞ্চল্যকর হয়ে উঠে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অনেকগুলো পয়েন্ট রয়েছে। সেগুলো হলো- লাবনী পয়েন্ট, সী ইন পয়েন্ট, কলাবতী পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্ট, বালিকা মাদ্রাসা পয়েন্ট এবং ডায়বেটিক হাসপাতাল পয়েন্ট প্রভৃতি। এদের মধ্যে লাবনী পয়েন্ট কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখান থেকে বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, সারি সারি ঝাউবন এবং সাগরের আছড়ে পড়া বিশাল ঢেউ দেখা যায়। লাবনী বিচ থেকে হেঁটে হেঁটে পূর্বদিকে সোজা চলে যাওয়া যায় হিমছড়ির দিকে। এ ছাড়াও কক্সবাজারের আশেপাশে বৌদ্ধ যুগের অনেক প্রাচীন কীর্তি রয়েছে। এখানকার প্যাগোডাগুলো খুবই দর্শনীয়। এখানে একটি আবহাওয়া অফিস, একটি বাতিঘর রয়েছে এবং মারমা, রাখাইনসহ অনেক উপজাতির বসবাস রয়েছে।
গুরুত্ব : সুইজারল্যান্ডের ‘New Seven Wonders Foundation’ নামক বার্নার্ড ওয়েবারের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ২০০০ সালে ২য় বারের মতো বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চার্য নির্বাচন প্রতিযোগিতায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতটি কয়েক বছর শীর্ষ অবস্থানে ছিল। এই সৈকতটি বিনোদনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত। বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশি পর্যটকরা এর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এ দেশে পাড়ি জমায়।
বিনোদনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র : বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার চিত্ত বিনোদনের অন্যতম প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। এটি বিশ্বের অন্যতম স্বাস্থ্যকর স্থান। এখানে পর্যটকদের বিনোদনের জন্য রয়েছে স্পিড বোট, বিচ বাইক এবং ওয়াটার স্কুটারসহ বিভিন্ন ধরণের ব্যবস্থা। তবে সাম্প্রতিককালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বিনোদনের জন্য নতুন মাত্রা যোগ করা হয়েছে। আকাশে উড়ে বেড়ানোর জন্য প্যারাসুট চালু করা হয়েছে। এছাড়াও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য বিশেষ দিন উপলক্ষে বিভিন্ন ধরণের কনসার্ট এবং খেলাধুলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান : বর্তমান বিশ্বে পর্যটন বিলিয়ন ডলারের শিল্প মাধ্যম। শতাব্দীর সেরা এবং বিশ্বের বৃহত্তম শিল্প হলো পর্যটন। বাংলাদেশও এদিক থেকে পিছিয়ে নেই। পর্যটন শিল্প এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। তবে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের কথা কল্পনাই করা যায় না। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মূল আকর্ষণ হলো এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যের টানে প্রতিবছর বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে। কক্সবাজারের শ্যামল বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক দিয়ে অনেক সমৃদ্ধ। পর্যটনের ক্ষেত্রে এই সব বৈশিষ্ট্য সম্ভাবনার দাবি রাখে। এখানে প্রাকৃতিক নির্জনতা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। এ জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকে এ পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার অপার সম্ভাবনা এবং সুযোগ এখানে রয়েছে। নিঃসন্দেহে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেশের জাতীয় উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিভিন্ন সমস্যা : বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার আমাদের গর্ব। কিন্তু এই সমুদ্র সৈকতের প্রবেশদ্বারের অবস্থা খুবই নাজুক। আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে এটির মর্যাদা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকতে হয়। আবার সমুদ্র পাড়ের অবস্থা দেখলে লুটের রাজ্য মনে হবে। যেন এক দল প্রভাবশালী দস্যু চর দখল করার কাজে নিয়োজিত। এখানে অবৈধ উপায়ে বড় বড় দালান-কোঠা গড়ে তোলা হচ্ছে। এভাবে সমুদ্র সৈকতে দালান-কোঠা গড়ে উঠলে একদিন ঘন বস্তির সৈকতে পরিণত হবে। এছাড়াও পযর্টকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি, অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা প্রভৃতিও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অন্যতম সমস্যা।
সমাধান : কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সম্পর্কিত সমস্যাগুলো রাতারাতি সমাধান করার কোনো পথ নেই। তবে এখানে সুষ্ঠু, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে-
- দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
- পুরো শহর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আওতায় আনা।
- একটি প্রশস্ত বাইপাস রাস্তা নির্মাণ করা। যা সরাসরি ঢাকা থেকে কক্সবাজার যোগাযোগ করবে।
- কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের কাক্সিক্ষত লক্ষে পৌঁছানোর জন্য বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা।
- কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তোলার জন্য পৃথক সংস্থা গঠন করা।
কর্তৃপক্ষের কাজ সমূহ : বর্তমানে কর্তৃপক্ষ সমুদ্র সৈকতের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তারা বিভিন্ন জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দিবসে অপেন কনসার্ট, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিচ ফুটবল, বিচ ভলিবল, ক্রিকেট প্রতিযোগিতা, জাতীয় ঘুড়ি উত্তোলনের ব্যবস্থা করে থাকে। দেশের পর্যটন শহরের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ রাখতে ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে ট্যুরিস্ট পুলিশ নামে আলাদা ইউনিট গঠন করে সরকার। বর্তমানে ট্যুরিস্ট পুলিশের দায়িত্ব পালনের জন্য ১২টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।
উপসংহার : পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার নিয়ে বাঙালির গর্বের শেষ নেই। এটি চিত্ত-বিনোদনের জন্য যেমন অন্যতম প্রাণকেন্দ্র তেমনিভাবে দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমনে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ হয়ে উঠেছে আনন্দময় এবং প্রাণ চঞ্চল। তাই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।