রচনা : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

ভূমিকা : বাঙালি জাতির মহত্তম অর্জন, গৌরবময় অধ্যায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ঔপনিবেশিক শোষণের যাতাঁকালে নিষ্পেষিত বাঙালি এ যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে। অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা, লাখো শহীদের রক্ত আর ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে এসেছে স্বাধীনতা। বাঙালির এ মহান আত্মত্যাগ, শৌর্য-বীর্য ও বীরত্বের স্মৃতি-নিদর্শন দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যত্রতত্র। গৌরবোজ্জ্বল এইসব ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানই ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’

জাদুঘর স্থাপনের উদ্দেশ্য ও দায়বদ্ধতা : প্রতিটি স্বাধীন জাতিই তার স্বাধীনতার বীরদের নিকট চির-দায়বদ্ধ। নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে মুক্তিযুদ্ধের প্রমাণ-তথ্যাদি, যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, শহীদদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, স্মৃতিস্মারক প্রভৃতি যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এর প্রবেশপথে ‘শিখা চিরন্তন’ প্রস্তরে উৎকীর্ণ করা আছে সেই দৃঢ় অঙ্গীকার-
‘সাক্ষী বাংলাদেশের রক্তভেজা মাটি
সাক্ষী আকাশের চন্দ্র তারা
ভুলি নাই শহীদদের কোনো স্মৃতি
ভুলব না কিছুই আমরা।’

উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠা : কয়েকজন দেশ প্রেমিক, সমাজসচেতন মহৎ ব্যক্তি এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দেশব্যপী সর্বস্তরের মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া, সমর্থন ও সহায়তা এই মহতি উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকারী ভূমিকা রাখে। ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ ঢাকা সেগুনবাগিচার একটি পুরোনো দ্বিতল ভবন ভাড়া নিয়ে তা যথাযথ সংস্কার করে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি উদ্বোধন করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী রশিদুল হাসান এর নাতনী অর্চি।

বৈশিষ্ট্য ও অবকাঠামো : স্বভাবতই অন্যান্য জাদুঘর থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিষয়-বৈশিষ্ট্যে সম্পূর্ণ আলাদা। দ্বিতল ভবন-বিশিষ্ট জাদুঘরের ছয়টি গ্যালারিতে সাজানো প্রদর্শনীতে পরিকল্পিত ও সুচারু ব্যবস্থাপনার ছাপ স্পষ্ট । ভবনের প্রবেশ মুখে ছোট প্রাঙ্গনে রয়েছে শহীদ ডা. ফজলে রাব্বির ব্যবহৃত একটি গাড়ি।

প্রথম গ্যালারি : প্রথম গ্যালারিতে পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য-নিদর্শন ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চিত্র। পলাশী প্রান্তরের নকশা, সিপাহী বিদ্রোহ, টিপু সুলতান, তিতুমীরের অংকিত চিত্র, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী ও ঢাকা ভার্সিটি কমিটির আলোক চিত্র, রবীন্দ্রনাথের ছোট ভাস্কর্য, অবিভক্ত ভারত ও বাঙালি জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যের চমৎকার সব প্রমাণ। রয়েছে ময়নামতি, পাহারপুর, ষাটগম্ভুজ মসজিদের মডেল, তালপাতার পুথি, প্রাচীন গির্জা, প্রাচীন বাংলার শিল্প কর্মের নিদর্শন এর একটি ছবি।

দ্বিতীয় গ্যালারি : এই গ্যালারিতে তুলে ধরা হয়েছে পাকিস্তানিদের বৈষম্য, অত্যাচার, শাসন-শোষণের ইতিহাস। এতে সংগৃহীত রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহৃত পোশাক, কলম, পাইপ, রুমাল ও চিঠিপত্র।

তৃতীয় গ্যালারি : এই গ্যালারির প্রদর্শনের শুরুতেই রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের উদাত্ত আহ্বানের চিত্র। রয়েছে ‘৭১ এর অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ মার্চে গণহত্যা, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের স্বাধীনতার ঘোষণা, অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ ও শরণাথীদের দুর্গত জীবন চিত্র।

চতুর্থ গ্যালারি : এই গ্যালারিতে রয়েছে বেশ কিছু শোকেস। বিভিন্ন শহীদদের ব্যবহৃত পোশাক ও অন্যান্য জিনিসপত্র এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া আরও আছে বিদেশের পত্র পত্রিকায় গণহত্যা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিবেদন।

পঞ্চম গ্যালারি : পঞ্চম গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদানের সাক্ষ্যবাহী নিদর্শনের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে গেরিলা যুদ্ধ, স্বাধীন বাংলা বেতার, নৌকামান্ডো, বিমান বাহিনী, নারী সমাজ, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, বৈদেশিক সমর্থন এবং বিশেষ করে ভারতীয় জনসাধারণের সমর্থনের প্রতিচ্ছবি।

ষষ্ঠ গ্যালারি : এটি জাদুঘরের শেষ কক্ষ। এতে রয়েছে ভারতীয় বাহিনীর অশংগ্রহণ ও আত্মত্যাগের নিদর্শন। রয়েছে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পনের চিত্র, তাদের দোসর রাজাকার, আলশামস, আল বদরের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের নিদর্শন। এছাড়া রয়েছে বাংলার বীর যোদ্ধাদের আত্মদানের গৌরবের পরিচয়।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কার্যক্রম : প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নানা ধরণের কর্মকা- পরিচালনা করে থাকে। যেমন-
  • আউটরিচ কর্মসূচীর আওতায় জাদুঘরের ব্যবস্থাপনায় ছাত্র-ছাত্রীদের জাদুঘর পরিদর্শনে নিয়ে আসা হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে এই কর্মসূচী পরিচালিত হয়ে আসছে।
  • আউটরিচ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিবছর বিশাল আকারে আয়োজন করা হয় ‘মুক্তির উৎসব’। এটি শুরু হয় ২০০১ সালে, প্রতিবছর এতে অংশ নেয় ১৫,০০০ শিক্ষার্থী।
  • বৃহৎ আকারের একটি বাসকে ভ্রাম্যমান জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিভ্রমণ করে প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে।
  • পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদরদের বীভৎস হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী মিরপুরের জল্লাদখানা বধ্যভূমি। এখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে তুলেছে ‘বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ’।
  • ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর সপ্তাহব্যাপী আয়োজন করে আসছে আন্তর্জাতিক প্রামাণ্যচিত্র উৎসব। যুদ্ধ, গণহত্যা, মানবাধিকার, শান্তি ও সম্প্রীতি বিষয়ক তথ্যচিত্র এতে প্রদর্শিত হয়।
  • ২০০৬ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সবরমতী গান্ধী আশ্রম, আহমেদাবাদের সহযোগিতায় সেই ঐতিহাসিক স্থানে শান্তি ও সহনশীলতা বিষয়ক এশীয় তরুণদের ক্যাম্প পরিচালনা করে আসছে।
  • ২০০৮ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গণহত্যা বিষয়ক আর্ন্তজাতিক সম্মেলন করে আসছে।
  • ২০০৮ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত বজলুর রহমান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বজলুর রহমান স্মৃতিপদক’ চালু করেছে।
  • মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠন করেছে ‘স্বেচ্ছাকর্মীদল’। যারা জাদুঘরের নানামুখী কর্মকা- পরিচালনায় সহযোগিতামূলক ভূমিকা রাখছে।
  • * বিশ্বের অন্যান্য আটটি সমভাবাপন্ন দেশের সঙ্গে মিলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গঠন করেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব হিস্টরিক মিউজিয়ামস অব কনসান্স’। এছাড়া এটি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব মিউজিয়াম ও আইকম-বাংলাদেশের সদস্য।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : বর্তমানে জাদুঘরে মাত্র ১৪শ স্মারক প্রদর্শিত হলেও সংগ্রহভান্ডারে জমা আছে ১৫ হাজারের অধিক স্মারক। শুধু স্থান স্বল্পতার দরুন এই বিশাল সংগ্রহভান্ডার প্রদর্শন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের স্থায়ী জাদুঘর নির্মাণের জন্য ০.৮২ একর ভূমি বরাদ্দ পেয়েছে জাদুঘর ট্রাস্ট। এমতাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আগামী পরিকল্পনাসমূহ-
  • বরাদ্দপ্রাপ্ত জমিতে স্থায়ী ভবন নির্মাণ। ইতোমধ্যে এর কাজ শুরু হয়ে গেছে।
  • নতুন জাদুঘর ভবনে ‘স্থায়ী’‘পরিবর্তনশীল’ দুই ধরণের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রাখা হবে।
  • মূল স্থায়ী প্রদর্শনীর জায়গায় থাকবে দু’টি ভাগ: (ক) বাংলার জনপদ ও ঐতিহ্য এবং (খ) ইতিহাসের গতিধারা।
  • প্রদর্শনীতে ইতিহাসের মূলধারার পাশাপাশি ব্যক্তি মানুষের জীবন ও আত্মদানের পরিচয় মেলে ধরা হবে বিশেষ গুরুত্বসহকারে।
উপসংহার : বাঙালি জাতিসত্তার স্মৃতিবাহী প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। যুদ্ধদিনের আয়না মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হৃদয়ে ধারণ করে আছে মুক্তিযুদ্ধেও স্মারক চিহ্ন। এটি অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এ তিন কালের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করে শেকড় সন্ধানী প্রজন্মকে জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ জন্মের সঠিক ইতিহাস। তাই বহুমাত্রিক জাদুঘর না হলেও বাঙালির জীবনে এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post