ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে জনশক্তি রপ্তানি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় জনসংখ্যার অসম বণ্টন দেখা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকাসহ অনেক দারিদ্র্য দেশে সামর্থ্যরে তুলনায় অধিক জনসংখ্যা রয়েছে। ফলে দেখা দিচ্ছে নানামুখী সমস্যা। তাই বিপুল জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরের বিকল্প নেই। অধিক জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরের প্রক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।
জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশসমূহ : বিশ্বের অনেক দেশেই বাংলাদেশের জনশক্তি রয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে গমন করে থাকে। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার হচ্ছে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। এছাড়া বাহরাইন, লিবিয়া, লেবানন, দ. কোরিয়া, মরিশাস, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশের শ্রমিক কর্মরত রয়েছে।
জনশক্তি রপ্তানিতে বাংলাদেশ : জনশক্তি রপ্তানিতে দিন দিন বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ১৯৭৬ সাল থেকে জনশক্তি রপ্তানি শুরু করে। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের ৭০ শতাংশের বেশি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত রয়েছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-এর হিসাবে ২০০২-২০১২ সাল পর্যন্ত মোট জনশক্তি রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৬০ লক্ষ জন।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিটেন্স : সাম্প্রতিক প্রবাসীদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা বেকার সমস্যা হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে। ২০১১-১২ সালে ৬.০৮ লক্ষ বাংলাদেশি কাজের সন্ধানে বিদেশে গমন করেছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান তথা শ্রমশক্তি রপ্তানিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ সুবিধার কল্যাণার্থে সরকার প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক নামক একটি বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। নিম্নে বিভিন্ন বছরের প্রবাসী বাংলাদেশিদের জনশক্তি রপ্তানি ও প্রেরিত রেমিট্যান্স তুলে ধরা হলো-
সাল ২০০৯-১০
জনশক্তি রপ্তানি (জন) ৩,৯০,৭০২
মিলিয়ন মার্কিন ডলার ১১,৬৫০.৩২
সাল ২০১০-১১
জনশক্তি রপ্তানি (জন) ৫,৬৮,০৬২
মিলিয়ন মার্কিন ডলার ১২,৮৪৩.৪৩
সাল ২০১১-১২
জনশক্তি রপ্তানি (জন) ৬,০৭,৭৯৮
মিলিয়ন মার্কিন ডলার ১২,৩০৩.৬৪
জনশক্তি রপ্তানি কিছুটা ক্রমহ্রাসমান হলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমবর্ধমান। ২০১১-২০১২ অর্থবছরে রেমিটেন্সের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ১১.১১% যা মোট পণ্য রপ্তানির ৫২.৯২%।
শ্রেণিভিত্তিক জনশক্তি রপ্তানি : জনশক্তি রপ্তানির ধরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, স্বল্পদক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মোট জনশক্তি রপ্তানির ৫০ শতাংশের বেশি। বর্তমানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে নানা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে।
দেশভিত্তিক জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিটেন্স : বাংলাদেশের জনশক্তির অধিকাংশই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে কর্মরত আছে। এছাড়া বাহরাইন, কাতার, ব্রুনাই, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালিসহ প্রভৃতি দেশেও কর্মরত রয়েছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে যেখানে ২ শতাংশ, সেখানে ২০১২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ শতাংশে পৌঁছেছে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজার ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। দেশভিত্তিক সর্বাধিক বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২১৫,৪৫২ জন। আর বিপুল পরিমাণ জনশক্তি প্রেরণের ফলে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। ফলে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয়, জীবনযাত্রার মান প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনশক্তি রপ্তানির গুরুত্ব : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। বিপুল জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার মাধ্যমে দেশের উন্নতি করা সম্ভব। নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো-
(ক) বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত জনশক্তির অধিকাংশ গ্রামীণ জনগণ। ফলে গ্রামীণ জনগণের প্রেরিত অর্থ দ্বারা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয় পুঁজি, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, কৃষিতে বিনিয়োগ প্রভৃতি বৃদ্ধি ও জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটে।
(খ) প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ আমাদের গ্রামীণ জনগণের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করে। ফলে গ্রামীণ কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও পরিবারের সদস্যদের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
(গ) বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
(ঘ) বিপুল পরিমাণ জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করে তা বিদেশে পাঠানোর মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে বৈদেশিক সাহায্য ও নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়।
তাছাড়া আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্য রক্ষা কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, কৃষি বিনিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিটেন্স বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপ : রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি ও বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার তৈরিতে সরকার প্রদত্ত গৃহীত পদক্ষেপ নিম্নে তুলে ধরা হলো-
(ক) জর্ডানে বিনা খরচে গৃহকর্মী পাঠানো হচ্ছে এবং গার্মেন্টস খাতে ১৪,০০০ টাকা ব্যয়ে নারী কর্মী প্রেরণ করা হচ্ছে।
(খ) বিএমইটি এবং বোয়েমেলের মাধ্যমে জর্ডান, হংকং, কাতার, বাহরাইনে নারী কর্মী প্রেরণ করা হচ্ছে।
(গ) বিদেশ হতে প্রত্যাগত কর্মীদের পুনঃকর্মসংস্থানে আর্থিক সহায়তা দিতে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে।
(ঘ) রিক্রুটিং এজেন্সি এবং মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম ও প্রতারণা হ্রাস করতে ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে বহির্গমন প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
(ঙ) দক্ষ জনশক্তিকে বিদেশে প্রেরণের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে।
(চ) অধিক রেমিটেন্স প্রেরণকারীদের সরকার কর্তৃক ঈওচ মর্যাদা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা : দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যম হলো জনশক্তি রপ্তানি। কিন্তু বর্তমানে প্রায় তিন বছর ধরে জনশক্তি রপ্তানির নিম্নমুখী প্রবণতা রয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, দক্ষ শমিকের অভাব, বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কূটনৈতিক তৎপরতার অভাবসহ নানাবিধ কারণ এর সাথে জড়িত। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব বিশ্বে রাজনৈতিক সংকটের ফলে শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসছে। তবে বর্তমানে পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে দক্ষ ও অদক্ষ জনবলের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ফলে এসব অঞ্চলে বাংলাদেশের শ্রমিক রপ্তানির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া আফ্রিকা মহাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশে নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কাজ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সামগ্রিকভাবে শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
উপসংহার : বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এ বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে আমাদের সকলের প্রচেষ্টার প্রয়োজন। তবেই আমরা দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে পারব এবং সকল অভাব অনটন দূরে টেলে আমরা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারব।