ভূমিকা : আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের ফসল। পৃথিবীকে আধুনিক করে তুলেছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে গতি, সভ্যতাকে করেছে দ্রুততর। বিজ্ঞানীরা মহাকাশের রহস্য উম্মোচন করে বিজয় পতাকা উড়িয়েছে মহাশূন্যে। আকাশের অসংখ্য উজ্জ্বল বস্তু মানুষকে যুগে যুগে অভিভূত করেছে, মানুষ তাদের চিনতে চেষ্টা করেছে, চেষ্টা করেছে জয় করতে। পৃথিবীর মানুষের আকাশ জয়ের এই অদম্য বাসনা থেকেই সম্ভব হয়েছে মহাশূন্য যাত্রা।
মহাকাশ বিজ্ঞান কী? : মহাকাশ বিজ্ঞান ভৌত বিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা। মহাকাশ সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও পদ্ধতিগতভাবে লব্ধ সুশৃঙ্খল ও সুসংঘবদ্ধ জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি হলো মহাকাশ বিজ্ঞান।
মহাকাশ বিজ্ঞানের যাত্রা : মহাকাশে যাত্রা মহাবিশ্ব সম্পর্কিত বিষয়ে এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছে। মহাশূন্য যাত্রার বহুপূর্বে মানুষ কল্পনায় চাঁদে গিয়েছে, তার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে পাই। মানুষের বহু আকাঙ্ক্ষিত ও বহু প্রতিক্ষীত এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) এই যাত্রার সূচনা করে স্পুটনিক-১ (Sputnik-1) নামক কৃত্রিম উপগ্রহ (Satellite) উৎক্ষেপনের মাধ্যমে। স্পুটনিক-১ কে পাঠানো হয় আন্তর্জাতিক ভূ-গোলবর্ষে। স্পুটনিক-এর উৎক্ষেপণের কয়েক সপ্তাহ পর সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পূটনিক-২ মহাশূন্যে প্রেরণ করে। স্পূটনিক-২ এর যাত্রী ছিল ‘লাইকা’ নামের একটি কুকুর। লাইকার হৃদস্পন্দন, শারীরিক তাপমাত্রা ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়া বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসে। এ থেকেই বিজ্ঞানীরা অনুমান করতে পেরেছিল যে মানুষও হয়তো একদিন জীবিত অবস্থায় মহাকাশে যাত্রা করতে পারবে।
মাহশূন্যে মানুষের প্রথম যাত্রা : মহাকাশে মানুষের যাত্রার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয় ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। এই দিন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরি গ্যাগরিন (Yuri Gagarin) পৃথিবীকে পরিক্রমন করেন। তার পর ১৯৬৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ‘স্টক-৬’ মহাশূন্যযানে প্রথম মহিলা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেলেনতিনা তেরেসকোভা মহাশূন্যে যান। এরপর আর থেমে নেই মানুষের মহাকাশ জয়ের আকাঙ্ক্ষা।
চন্দ্রাভিযান : মানুষ চন্দ্রপৃষ্ঠ সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে ১৯৫৯ সালের অক্টোবরে ‘লুনার-৩’ উপগ্রহের মাধ্যমে পাঠানো চাঁদের অদৃশ্যমান অংশের ছবি থেকে। কালক্রমে চাঁদে ‘অ্যাপোলো-১১’ অভিযান বাস্তবায়ন শুরু হয়। ‘অ্যাপোলো-১১’ এর অভিযানের মাধ্যমে ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই চাঁদের বুকে প্রথম পা ফেলেন দুইজন নভোচারী। প্রথমে আমেরিকার নীল আর্মস্ট্রং, এরপরে এডুইন অলড্রিন। ‘অ্যাপোলো-১১’ এর যে অংশটি চাঁদে অবতরণ করে তা হলো চারপায়া বিশিষ্ট লুনার মডিউল। ‘অ্যাপোলো-১১’ এর অভিযানে মানুষ প্রথমে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেন।
মঙ্গলাভিযান : বিজ্ঞানীরা চাঁদে অভিযান চালিয়ে সফলতার পর মঙ্গলগ্রহেও অভিযান পরিচালনা করেন। ১৯৬৫ সালে ‘মেরিনার-৪’ মঙ্গল গ্রহের যে ছবি পাঠায় তা থেকে এটিতে অসংখ্য অগ্ন্যুৎপাতজনিত গহ্বরের সন্ধান মেলে। ১৯৭১ সালের ১৯ মে ‘মার্স-২’ মহাশূন্যযান মঙ্গল গ্রহে প্রথম অবতরণ করে। মঙ্গলে অভিযানের অংশ হিসেবে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা (NASA-National Aeronatics and space administration) ২০১২ সালের ৬ আগস্ট মঙ্গল কিউরিওসিটি রোবট পাঠিয়েছে যা এখনো মঙ্গলগ্রহে গবেষণা করছে। অদূর ভবিষ্যতে মঙ্গলে মনুষ্যবাহী যান পাঠানোর পরিকল্পনা করছে নাসা। এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে নিরন্তরভাবে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন : মহাশূন্যে সফলভাবে অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীরা তৈরি করছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। ১৯৬৯ সালের ১৬ জানুয়ারি পাঠানো সুয়োজ ছিল প্রথম পরীক্ষামূলক স্পেস স্টেশন। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে রাশিয়া, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলে মহাকাশে স্থায়ী আন্তর্জাতিক স্টেশন স্থাপন করে।
মহাকাশ অভিযানে স্পেস শাটল : মহাকাশ অভিযানের জন্য বিজ্ঞানীরা স্পেস শাটল তৈরি করেন। স্পেস শাটল এর বৈশিষ্ট্য হলো এটির মূল অংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য মহাকাশযান দ্য অরবিটার যা মহাকাশে উৎক্ষেপিত হবে রকেটের সাহায্যে, কিন্তু পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে এরোপ্লেনের মতো, রানওয়ে বেয়ে। মানুষের প্রথম মহাকাশ অভিযানের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্পেস শাটল ‘কলম্বিয়া’ কক্ষপথে পৌঁছায়। কলম্বিয়া, চ্যালেঞ্জার, ডিসকভারি আটলান্টিস স্পেস শাটল মহাকাশ গবেষণার বহু ক্ষেত্রে নজির স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। ১৯৮৩ সালের ১৮ জুন শাটল চ্যালেঞ্জার বাহিত হয়ে প্রথম মহাকাশে যাত্রা করেন আমেরিকার প্রথম মহিলা অভিযাত্রী স্যালিরাইড। ১৯৮৬ সালের ২৯ জানুয়ারি আমেরিকার মহাকাশ অভিযান পর্ব প্রথম ধাক্কা খায়, তখন তাদের স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার মাঝ আকাশে বিস্ফোরণে উৎক্ষেপণের মাত্র ৭৫ সেকেন্ডের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। এতে ছয়জন পুরুষ ও একজন মহিলাসহ মোট ৭ জন অভিযাত্রী সবাই মারা যায়। কিন্তু আশার কথা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার বিপুল আগ্রহে মহাকাশ গবেষণায় সচেষ্ট হয় এবং ১৯৮৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পাঁচজন যাত্রীসহ শাটল ডিসকভারি মহাশূন্যে পাঠায়। ১৯৯০ সালের ৯ অক্টোবর মার্কিন স্পেস শাটল ডিসকভারি সূর্যের মেরু অঞ্চলীয় তথ্য জানার জন্য মহাকাশযান ইউলিসিস উৎক্ষেপণ করে।
মহাকাশ অভিযানে নাসা (NASA) এবং ইসা (ESA) : বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণার কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বৃহৎ ও ব্যাপক পরিসরে গবেষণার জন্য ১৯৫৮ সালের ২৯ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয় নাসা (NASA-National Aeronatics and space administration) । নাসার বিজ্ঞানীরা প্রায় একশো (১০০) বার মহাশূন্যে মনুষ্যবাহী অভিযান পরিচালনা করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে মাত্রা দুইবার। ১৯৮৬ সালে চ্যালেঞ্জার বিস্ফোরণ এবং ২০০৩ সালে কলম্বিয়া বিপর্যয়। একই উদ্দেশ্যে ইউরোপের ১৮টি দেশের সম্মিলিত প্রয়াসে ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসা (ESA European space agency) মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
ভারত-চীন ও ইরানের মহাকাশ অভিযান : আমেরিকা, ইউরোপ এবং পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো ভারত, চীন ও ইরান সম্প্রতি মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করেছে। চীন ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো মুন রোভার মিশনে রোভার নামের ‘চেঙ্গি-৩’ সিরিজের মহাকাশযানটি উৎক্ষেপন করে। বিশ্বে এটি তৃতীয় চন্দ্রাভিযান। ভারত সম্পূর্ণ তাদের দেশীয় প্রযুক্তিতে ক্রায়োজেনিক রকেট তৈরি করেছে। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে চাঁদে নভোচারীসহ রকেট উৎক্ষেপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ভারত। ইরানও বর্তমানে মহাকাশ অভিযানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।
মহাকাশযানের নতুন নকশা : প্রথমবারের মতো কোনো কোনো গ্রহানুর পৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে ২০১৮ সালে একটি মহাকাশযান পাঠানোর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। নতুন নকশার ‘ওসিরিস রেক্স’ নভোযানটি ২০১৬ সালে যাত্রা করে বেনু নামের একটি গ্রহানুতে পৌঁছাবে ২০১৮ সালে। আর সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠাতে পারবে ২০২৩ সালে। মহাকাশে ক্ষুদ্র নকশার কৃত্রিম উপগ্রহ কিউবস্যাটের বিচরণ শুরু হয় ২০০৩ সালে। জলবায়ু পর্যবেক্ষণের জন্য মার্কিন ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এটি পাঠায়। কিউবস্যাটের আধুনিকায়নের মাধ্যমে প্রকৌশলীরা আরও ক্ষুদ্র নকশার ফায়ারফ্লাই উপগ্রহটি তৈরি করেছে। এর আকার ১০ সে.মি ১০ সে.মি ৩০ সে.মি এবং এর পরিভ্রমণ এলাকা ১৫ লাখ কি.মি (সূত্র নেচার)।
মহাকাশ অভিযানের অপকারিতা : মহাশূন্যের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বিজ্ঞানীরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে একথা যেমন সত্য তেমনি পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো এক প্রকার যুদ্ধেও শামিল হচ্ছে এই সব অভিযানের মাধ্যমে। মহাকাশে তারা আধিপত্য ধরে রাখতে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে। একটি নভোযান তৈরি করতে কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয় কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ ঘটলে বিপুল টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতিযোগিতামূলক অভিযানের ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈরীতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া মহাকাশযান বিস্ফোরণের ফলে মহাশূন্যে আবর্জনা সৃষ্টি হচ্ছে।
উপসংহার : বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ অবিরাম পৃথিবীর রহস্য উম্মোচন করে চলেছে এবং বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ও গবেষণার জন্য বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাচ্ছে মহাকাশে। বর্তমানযুগে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বাইরে বসবাসের জন্য বিভিন্ন গ্রহে গবেষণা করে চলছে। ইতোমধ্যে নাসার বিজ্ঞানীরা জীবনধারণের উপযোগী দুটি পৃথিবীসদৃশ গ্রহের সন্ধান পেয়েছে। কেপলার ‘৬২-এফ’ এবং ‘৬২-ই’ গ্রহ দুটি প্রাণীর বসবাসের উপযোগী। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মানুষ নতুন কোনো গ্রহে বাস করবে।