↬ একটি রেলওয়ে স্টেশন
জীবন সে তো একটি নাটক। মানুষ সেই জীবন-নাটকের এক-একজন পাত্র-পাত্রী বা কুশীলব মাত্র। এই জীবন-নাটকের বাস্তব প্রতিচ্ছবি অসাধারণভাবে উদ্ভাসিত হয় কোনো রেল স্টেশনে গেলে। সেখানে বিচিত্র লোকের বিচিত্র কর্মকাণ্ডে এক-একটি নাটক মঞ্চস্থ হয় যেন। এমনিতেই রেল স্টেশন আমার খুব প্রিয়, তার ওপর কাঙ্ক্ষিত স্টেশন হলে তো কথাই নেই।
আমার পছন্দের সেই স্টেশনটি হচ্ছে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন। একসময় এটি বটতলি স্টেশন নামে পরিচিত ছিল। তবে বটতলির সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। তাছাড়া স্টেশনটিও বটতলি থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়ে নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন ভবনটি তৈরি হয়েছে গ্রিক স্থাপত্যরীতিতে। ইতিমধ্যেই এই নতুন স্টেশন ভবনটি সৌন্দর্যপিপাসুদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।
প্রতিদিন বেশ কটি ট্রেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে। স্টেশনটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক প্ল্যাটফর্ম। সারিবদ্ধ চেয়ার দিয়ে বসার সুব্যবস্থা রয়েছে। প্ল্যাটফর্মের পিলারগুলোর গোড়াতেও বসার জন্যে চমৎকারভাবে বেদি তৈরি করা হয়েছে। সম্প্রতি বাধ্য হয়ে কিছু সময় কাটাতে হয়েছিল আমাকে এই স্টেশনে।
ঢাকা যাব খালোতো বোনের বিয়ে উপলক্ষে। টিকেট আগেভাগেই কেটে রেখেছি। সুতরাং কোনো চিন্তা নেই। ট্রেন ছাড়ার পনেরো-বিশ মিনিট আগে আমি স্টেশনে হাজির। রিকশা থেকে নামতে না নামতেই আমার সামান্য ওজনের ব্যাগটা নিয়ে দুই কিশোরের মধ্যে টানাটানির প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আমি পড়লাম মহাবিপদে। আমার ব্যাগটাই না জানি ছিঁড়ে যায়। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে একরকম দৌড়েই স্টেশনের ভেতরে পৌঁছলাম। যাত্রীদের জন্যে পাতা চেয়ারে বসতে যাব, এমন সময় কিশোর বয়সী আরেকজন এসে চেয়ারটা তার গলার গামছা দিয়ে ঝটপট মুছে দিল। চেয়ারটা কিন্তু পরিষ্কারই ছিল। মাঝখান থেকে দুটো টাকা আক্কেল সেলামি দিলাম।
এমন সময় শুনি স্পিকারে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে- ‘ঢাকা থেকে নিম্নগামী মহানগর প্রভাতী নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরে চট্টগ্রামে পৌঁছাবে।’ এই ‘কিছু সময়’ মানে যে কতক্ষণ, কে জানে। আমার উৎকণ্ঠা গেল বেড়ে। কারণ, এই ট্রেনটিই ‘মহানগর পূরবী’ হয়ে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে যার অন্যতম যাত্রী আমি। ‘অনুসন্ধান’ কাউন্টারে গেলাম সঠিক সময় জানার আশায়। চশমাপরা ভদ্রলোক জানালেন, ট্রেন আসতে ঘণ্টাখানেক দেরি হবে।
আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসলাম। পাশের দুই যুবক ক্রিকেট নিয়ে দারুণ গল্প জমিয়েছে। কে এখনকার সেরা ব্যাটসম্যান, কে সেরা বোলার, ভারতের পরবর্তী অধিনায়ক কে হতে পারে- এইসব নিয়ে একেবারে জম্পেশ আড্ডা। মাঝে মাঝে তর্কও যে হচ্ছে না তা নয়।
বসে আছি তো বসেই আছি। এ যেন অনন্তকাল ধরে বসে থাকা। ফাঁকে ফাঁকে চলছে বিভিন্ন ফেরিওয়ালা, বিচিত্র রকমের ভিক্ষুকের উৎপাত। অধিকাংশই প্রতিবন্ধী। প্রতি বছর আমাদের দেশে ‘প্রতিবন্ধী দিবস’ পালিত হয়। অথচ এদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয় না কখনোই। এক ফেরিওয়ালা ‘একের ভিতর চার’ নিয়ে সামনে হাজির। একের ভিতর চারটি জিনিস হলো- একটি লাইটার, একটি চিরুনী, একটি কান পরিষ্কারের লোহার বাঁকানো পাত ও একটি উঁকুন পরিষ্কারক চিরুনি। একজন পাঁচ টাকায় তিনটি বলপেন বিক্রি করছে। একজন আনল বাচ্ছাদের বই। আরেকজন বিভিন্ন রকমের পোস্টার নিয়ে ঘুরে গেল। এদের প্রথমে ভালো লাগলেও পরে যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে গেলাম। পা বাড়ালাম টি-স্টলে। কিন্তু সেখানেও মানুষ গিজগিজ করছে। কোনো রকমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এককাপ চা খেলাম।
‘মহানগর পূরবী’র যাত্রী আর ‘মহানগর প্রভাতী’র যাত্রী ও অভ্যর্থনাকারীদের পদচারণায় স্টেশন চত্বর ও প্ল্যাটফর্ম গমগম করছে। এর মধ্যে সিলেট থেকে ‘শাহজালাল এক্সপ্রেস’ পৌঁছে গেছে। লোকজনের ভিড় বেড়ে গেল আরো। পরক্ষণেই ‘বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস’ ছেড়ে গেল। কেবল আমাদের ট্রেনটিরই কোনো খবর নেই। আর কোনো নতুন ঘোষণাও প্রচার করছে না। কিছুক্ষণ আগে পুরনো ঘোষণাই আরেকবার শুনেছিলাম।
কিছু করার নেই। চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ দেখি, কয়েকজন একটা লোককে ধরে পেটাচ্ছে। তাদের অনুমান লোকটা পকেটমার। শেষমেষ রেলওয়ে পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামলে নিল। এদিকে আরেক লোক কাঁদছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তার দুটো ব্যাগের মধ্যে একটা নেই। পিলারে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল, কে কখন কোন ফাঁকে ব্যাগটা সরিয়ে নিয়েছে বেচারা টের পায় নি। অন্যদিকে একটি ছোট্ট মেয়ে তার বাবা-মাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে বাসায় ফিরে যাবার জন্যে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন এসে পৌঁছেছে। শুনেছি চট্টগ্রাম থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টির হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্যে কেবল দুটি শাটল ট্রেন রয়েছে। এই দুটি ট্রেন কয়েক দফায় ছাত্রছাত্রীদের শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরে আনা-নেওয়া করছে। উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত তরুণ-তরুণীরা যখন হৈচৈ করে স্টেশন চত্বর পার হচ্ছিল আমার খুব ভাল লাগছিল। ভাবছিলাম, এইচ.এস.সি. পাশ করে আমিও তো পড়ব বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কল্পনায় বিভোর হয়ে ছিলাম। হঠাৎ শুনলাম স্পিকারে ভেসে আসছে- ‘ঢাকা থেকে নিম্নগামী মহানগর প্রভাতী অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চট্টগ্রাম স্টেশনে এসে পৌঁছাবে।’ যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। আমিও উঠে দাঁড়ালাম।
আরো মিনিট দশেক পর ট্রেন এসে পৌঁছাল। প্রভাতীর যাত্রী, অভ্যর্থনাকারী, পূরবীর যাত্রী সব মিলে প্ল্যাটফর্মে তিল ধারণের জায়গা রইল না। এ ওকে ডাকছে তো সে তাকে খুঁজছে। তারই মধ্যে কুলির হাঁকাহাঁকি, ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি। সে এক এলাহি কাণ্ড। প্রভাতীর যাত্রীদের নামতে অনেক সময় লাগল। আমরা যারা পূরবীর যাত্রী তারাও উঠতে পারছি না। দরজার মুখে ভিড় করে যাত্রীদের নামার পথ বন্ধ করে রেখেছে। এরই মধ্যে কেউ কেউ যাত্রীদের আগে নামতে না দিয়ে ঠেলেঠুলে উঠে গেল। এই অস্থিরতা দেখে দুঃখ পেলাম।
প্রভাতীর যাত্রীরা সব নেমে গেলে ধীরে-সুস্থে আমি আমার কামরায় উঠলাম। তারও অনেক পরে নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় দুই ঘণ্টা পরে ‘মহানগর পূরবী’ ঢাকার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম স্টেশন ছাড়ল। আমিও স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম।
আরো দেখুন :