রচনা : একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

↬ সুন্দরবর ভ্রমণ

↬ নদীপথে ভ্রমণ


সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির এত সৌন্দর্য যে এভাবে ছাড়িয়ে আছে তা না দেখলে কল্পনায় এর ধারে-কাছেও যেতে পারবে না কেউ। আর এই নয়নাভিরাম ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হলো আমার এই সেদিন।

বলছিলাম সুন্দরবনের কথা। প্রকৃতি যেখানে নিজেকে উজাড় করে অকৃপণভাবে ঢেলে দিয়েছে তার বিচিত্র সৌন্দর্য। আর এই শোভা দর্শনের উদ্দেশ্যেই এক ভোরে বেরিয়ে পড়লাম আমরা চার বন্ধু- শেখর, জীতু, সুকান্ত এবং আমি। প্রায় আঠারো ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে রাত বারোটায় আমরা উপস্থিত হলাম খুলনায়। অনেক ঘুরে অবশেষে একটা মাঝারি গোছের হোটেলে দুটো ঘর খালি পেয়ে গেলাম। সঙ্গে শুকনো খাবার ছিল, তা দিয়েই সেরে নিতে হলো রাতের ভোজ। দীর্ঘ ভ্রমণজনিত ক্লান্তি পেয়ে বসেছে সবাইকে। চোখ ভেঙে নেমে আসছে রাজ্যের ঘুম। অগত্য হোটেলের শুভ্র চাদর পাতা বিছানাই হলো আমাদের ঠিকানা।

যখন ঘুম ভাঙল তখন সকাল ন’টা। এরপর সারাদিন ধরে সুন্দরবনে যাবার প্রস্তুতি, মংলা বন্দর বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা। নদীপথে যাত্রার সব অবলম্বন সংগ্রহ করে যখন আমরা লঞ্চ ‘এমভি যাত্রা’য় চাপলাম তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে। চারিদিকে নরম কনে-দেখা আলো। জলেও তার ছায়া পড়েছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। দূরে সমুদ্রগামী জাহাজগুলোতে হরেক রঙের বাতি জ্বলে উঠল একে একে। একসময় সূর্য ডুবে গেল। আমরা এগুচ্ছি আর বিস্ময়ভরে অবলোকন করছি এক অপার্থিব দৃশ্য। যে দৃশ্য কেবলই অনুভবের।

আমাদের সাথে গাইড হিসেবে রয়েছে জীতুর বড় ভাইয়ের বন্ধু স্থানীয় সোলায়মান ভাই। উনি জানালেন, আমরা সুন্দরবনের সীমানায় প্রবেশ করেছি। আমরা সবাই শিহরিত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে, এতদিন সুন্দরবনের কথা অন্যের মুখে শুনেছি, টিভিতে দেখেছি, বই কিংবা ম্যাগাজিনে পড়েছি। আর আজ নিজের চোখে দেখছি সব, ইচ্ছে করলেই হাত দিয়ে ছুঁতে পারব গোলপাতা।

নদী অসংখ্য শাখায় বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে। নদীর গা ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে বনরাজি। একসময় এমনই সুর হয়ে এল নদীপথ যে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলাম একটু সবুজ। চারিদিকে প্রচুর গোলপাতা। শেখর যেন আকাশ থেকে পড়ল। অবাক হয়ে বলল, আমি তো ভেবেছিলাম গোলপাতা গোল গোল। সবাই একচোট হাসলাম। সোলায়মান ভাই জানালেন এর ফল ও ফুলের কথা। আমরা কেউই জানতাম না যে গোলপাতার ফুলও হয়। আবার হয়ে দু’চোখ ভরে দেখলাম সোনার বরন উজ্জ্বল ফুল।

ক্রমেই রাত গভীর হচ্ছে। পাখির কলকাকলি থেমে গেছে। রাতের সবুজ ঘন অরণ্যে যেন আরো বেশি জমাট আঁধার নেমেছে। দূর থেকে হঠাৎ ভেসে আসছে কোনো কোনো প্রাণীর ডাক। এরই ফাঁকে চুকিয়ে নিলাম রাতের খাবারের পাট। গান, কৌতুক, অভিনয় এসবও চলল। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে একপশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল। একসময় কিছুক্ষণের জন্যে যাত্রাবিরতি। থেমে গেল ‘এমভি যাত্রা’র একটানা গর্জন। আমরাও ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। জেগে দেখি লঞ্চ এগিয়ে যাচ্ছে পানি কেটে কেটে। সকাল বেলার সোনা রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে এক অপরূপ আলোছায়ার ইন্দ্রজাল। বনের গাছপালা পরম স্নেহে, আদরে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছে পশুপাখিকে। একফাঁকে নাশতা সেরে নিলাম। যত এগুচ্ছি ততই দেখছি বনের অপূর্ব শোভা। ডালে ডালে নেচে বেড়াচ্ছে বাঁদর। মাঝে মাঝে চোখে পড়ল চর বা দ্বীপ। সোলায়মান ভাই জানালেন, সুন্দরবনে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে নদী আর খাল। অধিকাংশই শাখানদী। আর দ্বীপের ঘন জঙ্গলে রয়েছে অসংখ্য হরিণ। আর ‘টাইগার পয়েন্ট’, ‘হরিণ পয়েন্ট’ এবং ‘কচিখালি’ -এই তিনটি অভয়ারণ্যের তো তুলনাই নেই। আর সুন্দরবনের এই অভয়ারণ্যগুলোতে পর্যটকদের জন্যে রয়েছে বিশ্রামাগার আর নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। সুকান্ত চেঁচিয়ে ঘোষণা দিল, তিনটি অভয়ারণ্যেই সে যাবে। বাকি তিনজন মাথা ঝাঁকিয়ে ওকে সমর্থন করলাম। সোলায়মান ভাই হেসে ফেললেন। আমরাও পরক্ষণেই চুপসে গেলাম। কারণ, সবাই ভালো করেই জানি, আমাদের সময়ও কম, টাকাকড়িও কম। শেষে ঠিক হলো ‘টাইগার পয়েন্টে’ই যাব। কেননা ওখানে যাওয়াই সবচেয়ে সহজ।

‘টাইগার পয়েন্টে’র কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। এর আরেকটা নাম আছে ‘কটকা’। ‘এমভি যাত্রা’ নোঙর করল। এর একটানা শব্দ গেল থেমে। আমরা নৌকা করে হারবারে গিয়ে উঠলাম। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি ‘টাইগার পয়েন্টে’র ফটক। অবশেষে প্রথম পা রাখলাম সুন্দরবনের মাটিতে। আমরা সবাই নিশ্চুপ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যাচ্ছি। এমন আনন্দের শিহরণ আগে কখনো অনুভব করি নি। দু’পাশে সারি সারি গাছপালা, মাঝখানে সরু পথ। আমরা রেস্ট হাউসে উঠলাম। সেখানে সার্বক্ষণিক পাহারায় রত বন্দুকধারী রক্ষী। খাওয়া-দাওয়া করে রেস্ট হাউজ থেকে নেমে পেছনের পুকুর পাড়ে বসে আছি। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। হঠাৎ দেখতে পেলাম হরিণের পাল। সবাই নিঃশব্দে রইলাম। পাছে সামান্য শব্দে পালিয়ে যায়। ক্যামেরা রেডিই ছিল। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি নেয়া হলো অনেক। হরিণেরা দুলছে, ঘাস খাচ্ছে। শাবক হরিণগুলোর সে কী হুটোপুটি! একটা হরিণের পিঠে দেখলাম এক বানর। শুনেছিলাম, বানরের সাথে হরিণের অপূর্ব মিতালির কথা। আজ নিজ চোখে দেখছি। ভাবছি স্বপ্ন নয় তো! একসময় হরিণের পাল ক্ষিপ্রগতিতে ঢুকে গেল অরণ্যে। কোনো শব্দ শুনেছে হয়তো।

এবার অরণ্য দেখার পালা। জীতু ভাঙা রেকর্ডের মতো অনবরত বলে যাচ্ছে, ‘বাঘ দেখবো কখন, বাঘ দেখব কখন।’ বাঘ যে যখন তখন দেখা যায় না একথা ওকে বোঝায় সাধ্যি কার। আহ্! চারিদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। সুন্দরী, কেওড়া, গড়ান -এসব গাছ চিনিয়ে দিচ্ছিলেন সোলায়মান ভাই। অসংখ্য পরগাছা আর লতানো গাছও দেখলাম। এসব লতানো গাছে হরেক রঙের ফুল ফুটে আছে। দেখলাম অসংখ্য পাখি। বিচিত্র রঙের, বিচিত্র গড়নের। তাদের কলকাকলিতে মুখরিত বনাঞ্চল। ইচ্ছে হলো সবগুলো পাখির নাম জেনে নিই। আমরা ধীর পায়ে হেঁটে চলেছি। আমাদের চলার শব্দ আর পাখিদের গুঞ্জন ছাড়া কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ আমার পায়ের ওপর দিয়ে কী যেন সরে গেল। আমি মরণপণ চিৎকার করলাম। হাত থেকে ক্যামেরা ছিটকে পড়ল। কাছাকাছি কয়েকটা গাছে পাখিদের পাখা ঝাপটানোও শুনলাম। শেসে যা আবিষ্কৃত হলো তা দেখে সবার সাথে আমিও হেসে ফেললাম। ওটা ছিল একটা বেজির বাচ্চা।

যতই চলছি বন ততই গভীর হচ্ছে। এখন আর সুর্যের প্রখর আলো ভেতরে আসছে না। এই বনের পাশ ঘেঁষেই বঙ্গোপসাগরের শুরু। সেও এক অসাধারণ দৃশ্য। যতই দেখি তৃষ্ণা মেটে না। আরো গভীরে যাওয়া নিরাপদ ছিল না, আমরা ফিরে এলাম।

এক পাল হরিণের স্বাধীন বিচরণ দেখলাম বন বিভাগের অবজারভেশন টাওয়ার থেকে। এটি ‘কটকা’ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। সেখানে গেলাম অন্য একটি লঞ্চে চেপে। টাওয়ার থেকে দেখলাম, অসংখ্য হরিণ নিঃশঙ্কচিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা করছে। আমার মনে হচ্ছিল টেলিভিশনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখছি। ইচ্ছে হচ্ছিল, এই রাতটা থেকে যাই। আজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় সুন্দরবনকে কী মনোরমই না দেখাবে। কিন্তু উপায় নেই। ফিরতে হবে, ফিরতেই হবে।

বিকেল গড়িয়ে গেল। সূর্যের রঙ লাল। বাঘের দেখা পেলাম না। টাইগার না দেখে ‘টাইগার পয়েন্ট’ থেকে ফিরে যাব। খুব খারাপ লাগছিল। একটু পরেই নিসর্গ ঢেকে যাবে আঁধারে। আমরা ফিরে এলাম ‘এমভি যাত্রা’য়। আমাদের অনেক কল্পনাই আজ বাস্তব হলো। আর সেই বাস্তবতার কিছুটা ক্যামেরাবন্দি করে আর স্মৃতির সমৃদ্ধি নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। আবার মিশে যাব যান্ত্রিক ব্যবস্থায়, নগরের কোলাহলে -আরেক বাস্তবে। সন্ধ্যের আঁধার পেরিয়ে গেল ‘এমভি যাত্রা’র যাত্রা শুরু হলো। মংলা বন্দরে পৌঁছলাম পরদিন ভোরে। মংলার মাটিতে পা রেখে কোনো আনন্দের অনুভূতি হলো না, জাগল না শিহরণ।


আরো দেখুন :

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post