আমি একটি রাজপথ। যেহেতু আমার অস্তিত্ব আছে, সেহেতু কাহিনী একটু তো থাকবেই। তাই তোমাদের শুনবার মত অবসর থাকলে শুনতে পারো।
বন-জঙ্গলে পূর্ণ একটি ছোট গ্রামে আমি তৈরি হই। গ্রাম বলতে-দু-চার ঘর লোকের বসতি মাত্র, আর বন, কেবল বন। গ্রামের পাশে একটি নদী ছিল। নদীর জোয়রের পানিতে ভরে উঠতে গ্রামটি, আর সেই পানি জঙ্গলের আনাচে-কানাচে, ডোবায়, নালায় গড়িয়ে পড়তো। ঘন জঙ্গলের জন্য সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছতে পারতো না। ডোবার পানিতে ঝরা পাতা পড়ে পচে উঠতো, আর সেই ঝরা পাতার পচা দুর্গন্ধ আমাকে সইতে হত। তার উপর চারিদিকের মাটি স্যাঁতসেঁতে, আধি-ব্যাধির অভাব ছিল না, বাঘ আর সাপের ছিল বাসস্থান। আর বাঘ অর্থে চিতা নয়, খাঁটি, ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’। এদের গোষ্ঠীগোত্র অবশ্য এখন সকলেই সুন্দরবনে আশ্রয় নিয়েছে।
তারপর আমি শহরের দিকে পা বাড়তে লাগলাম। শহরে এসে আমার রূপের ও আকৃতির পরিবর্তন ঘটল। শহরবাসীর যাতায়াতের জন্য আমাকে প্রসারিত (প্রশস্ত) করা হল। দু’পাশে ক্ষীণকায় নালা-নর্দমা পানি নিকাশের পথ। নালার ধার ঘেঁষে বসল খাড়া খাড়া ইট; তারই মাঝখানে খোয়া, সুরকি আর পানি ছড়িয়ে রোলার টেনে বসিয়ে দেয়া হল আমার বুকের উপর। যখন রোলার টানা শুরু হলো, ভয়ে আমার বুক ধড়ফড় করে উঠল। রোলারের টানে ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলাম। কিন্তু রোলার টানা শেষ হলে আনন্দ আমার দেহময় ছড়িয়ে পড়ল। হাসিতে মুখ আমার কৃষ্ণাভ হয়ে উঠল। এখনকার মত বড় সাত তলা, আট তলা না হলেও নতুন ধরনের সুন্দর সুন্দর কত বাড়ি নির্মিত হল আমার দু’ধারে। প্রায় বাড়ির সামনে বাগান, বাগানে কত দেশি-বিদেশি ফুল। আমি গৌরব বোধ করতাম। আমার মনে হতো, আমার পাশে আছে, তাই অতরূপ ওদের। কিন্তু গরুর গাড়িগুলো যখন গড়গড় করে চলতো আমার বুকের উপর দিয়ে আর গরুর ধারাল খুরের আঘাতে আমার দেহ হত ক্ষতবিক্ষত, তখন মনটা আমার অপমানে বিষিয়ে উঠতো।
তারপর কালের পরিবর্তন ঘটল। শহরে জন সমাগম দ্রুত বৃদ্ধি পেতে লাগল। ছোট শহর পরিণত হল নগরে। তারপর রাস্তার ধারে বড় বড় অট্টালিকা গড়ে উঠতে লাগল। আমার আয়তন পূর্বের চেয়ে আরও বৃদ্ধি পেল। পানি নিকাশের যে পথ ছিল আমার দু’পাশে, তা বন্ধ হয়ে গেল। আমার বুকের ভিতর দিয়ে প্রস্তুত হল পানি নিকাশের পথ। শুধু তাই নয়, অসংখ্য পাইপ-কোনোটা পানীয় জলে, কোনোটা অপরিষ্কৃত পানির, কোনোটা বা গ্যাসের দিকে চালিত হয়েছে স্পঞ্জের মত আমারই বুকের নিচে। বিদ্যুতের অগণিত আর ছুটে চলছে সেই পাইপগুলোর পাশে পাশে দু’ধারে বসলো বিজলীর বাতি, টেলিফোন থামের শ্রেণি। তারপর আমার বুকের রক্ত বদলানো হল। এখন পিচঢালা কাল বুকে উঠে আমার রৌদ্রতাপের তপ্ত নিশ্বাস। তাতে স্পর্শ করি রাতের প্রশ্বাস।
আজ আমর বুকের উপর দিয়ে ছুটে চলে ভিন্ন ধরনের অগণিত মোটরগাড়ি, রিক্সা আর লক্ষ লক্ষ মানুষ যাদের কোন কাহিনী আমি সম্পূর্ণ শুনতে পাইনি। খানিকটা শুনতে পেয়ে বাকিটুকু শুনবার জন্য যখন আমি কান পেতে থাকি, তখন দেখি সে লোক আর নেই। এমন কত বছরের কত ভাঙ্গা কথা, ভাঙ্গা গান আমার ধুলোর সাথে মিশে গিয়েছে, তা কেউই জানতে পায়নি। আমি চরণের স্পর্শে হৃদয় পড়তে পারি। আমি বুঝতে পারি, কে গৃহে যাচ্ছে, কে বিদেশ যাচ্ছে, কে কাজে যাচ্ছে, কে বিশ্রামে যাচ্ছে, কে উৎসবে যাচ্ছে, কে কবরে যাচ্ছে। যার সুখের সংসার আছে, স্নেহের ছায়া আছে, সে প্রতি পদক্ষেপে সুখের ছবি এঁকে চলে; সে প্রতি পদক্ষেপে মাটিতে আশার বীজ বপন করে যায়। মনে হয়, যেখানে তার পা পড়েছে সেখানে যেন মহূর্তের মধ্যে এক একটি করে লতা অঙ্কুরিত ও পুস্পিত হয়ে উঠবে। যার গৃহ নেই, আশ্রয় নেই, তার চরণ যেন বলতে থাকে আমি চলিই বা কেন, আসিই বা কেন।
আজ আমি অসীম ধৈর্যের সাথে ধুলোয় লুটিয়ে অন্তিমকালের জন্য প্রতীক্ষা করে আছি। আমি চিরদিন স্থির অবিচল চিরদিন একইভাবে শুয়ে থাকবো। কিন্তু তবুও আমার এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নেই। এতটুকু বিশ্রাম নেই যে কঠিন শুষ্ক শয্যায় একটিমাত্র কচি স্নিগ্ধ শ্যামল ঘাস উঠাতে পারি; এতটুকু শক্তি নেই যে, শিয়রের কাছে অতিক্ষুদ্র একটি নীলবর্ণের বনফুল ফুটাতে পারি। কথা বলতে পারি না, অথচ সকলই অনুভব করছি। রাত দিন পদ-শব্দ; কেবলই পদ-শব্দ আমার এই গভীর জড় নিদ্রার মধ্যে লক্ষ লক্ষ চরণের শব্দ অহর্নিশ দুঃস্বপ্নের মত আবর্তিত হচ্ছে।