ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাত হতে ১৯৭১ সনের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী গণহত্যার অধ্যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যে সকল বিভীষিকাময় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের গণহত্যা ইতিহাসকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। মঙ্গোল নেতা হালাকু খান, চেঙ্গিস খান, নাদির শাহ ও জার্মানির কুখ্যাত সর্বাধিনায়ক হিটলার হণহত্যার কৃতিত্বের দাবিদার, কিন্তু সমস্ত গণহত্যার বিভীষিকাময় কাহিনীর অস্তিত্বকে হারিয়ে গিয়েছে নর পিশাচ জংগী শাহীর অধিনায়ক ইয়াহিয়ার সুপরিকল্পিত বাঙালি গণহত্যা।
ঘটনাপ্রবাহ : ১৯৭০ সালে সাবেক পাকিস্তানে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সংসদীয় আইন অনুযায়ী দেশের শাসন ক্ষমতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে আসার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কারসাজিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেষে মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে অস্বীকার করে। নানা ধরনের তালবাহানা শুরু করতে থাকে। এতে বাঙালিদের মনে সন্দেহ জাগতে থাকে। কারণ ইতিপূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। নানাভাবে বাঙালি জাতিকে শাসনের নামে শোষণ করে আসছে।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক ময়দানে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে পাকিস্তানী কুচক্রীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ওয়াদা করেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে তথা ক্ষমতা ফিরিয়ে না দিলে আমরা সংগ্রাম করব। আমাদের এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
গণহত্যার তাণ্ডবলীলা : সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি, বরং বাঙালি জাতিকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য সশস্ত্র পশ্চিমা সেনাবাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে ঘুমন্ত ঢাকা নগরীর নিরীহ মানুষের উপর পশ্চিমা হানাদার নরপশুর দল ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস-গুলোতে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, পিলখানায় ই.পি.আর. ঘাটিতে গোলাগুলি চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। সাথে সাথে শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়।
পশ্চিম হানাদার বাহিনী সাধারণ মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালালে প্রাণভয়ে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। প্রায় এক কোটির মত মানুষ বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেয়। তবু তাদের মানুষ মারার নেশা কমেনি। শহরে-বন্দরে, গ্রামে গঞ্জে, হাটে-বাজারে, লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে তারা বিনা কারণে হত্যা করে। গণহত্যায় তারা মেতে ওঠে। এদেশের এক শ্রেণির স্বাধীনতা বিরোধী মীরজাফরের দল পশ্চিমা হানাদারদের হাতে হাত মিলিয়ে গঠন করে আলবদর, রাজাকার ও আলসাম্স; এরা যৌথভাবে সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এদের অত্যাচার মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়।
উপসংহার : সীমান্ত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর শিবির গড়ে উঠতে লাগল। বাংলার দামাল ছেলেরা সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগল। বিপুল বিক্রমে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল গণহত্যাকারী পশুদের ওপর। বন্ধু দেশ ভারত নানাভাবে সাহায্য করল। সুদীর্ঘ নয় মাস অবিরাম যুদ্ধ চালাবার পর অবশেষে বাংলাদেশ মুক্ত হল। আমরা ২৫ বছরের পাকিস্তানি শোষণের কবল থেকে মুক্ত হলাম। পৃথিবীতে আরও অনেক স্থানে গণহত্যা হয়েছে কিন্তু পাকিস্তানী হানাদারদের হত্যার সাথে তার তুলনা হয় না। এমন নৃশংস গণহত্যা পৃথিবীতে আর কোথাও কেহ দেখেনি। তাই সারা পৃথিবীর মানুষ তাদের ঘৃণা করেছে, তিরস্কার করেছে।
আরো দেখুন :
রচনা : স্বাধীনতা দিবস
আরো দেখুন :
রচনা : স্বাধীনতা দিবস