আমার প্রিয় শিক্ষক
কালের যাত্রার ধ্বনি অনুরণিত হয়ে ওঠে শিক্ষকের কণ্ঠে। জীবনের প্রথম প্রভাতে ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ থেকে আজকের তারুণ্য দীপ্ত মুহূর্তে ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ স্বদেশচেতনায় উদ্দীপ্ত এ মানসিকতা অর্জনের পেছনে অকৃপণ অবদান রেখেছেন আমার শিক্ষকবৃন্দ। তাঁরা বৈচিত্র্যে ভিন্নতর, কিন্তু আকর্ষণে অনন্য। তাঁদের মিছিল থেকে একজনকে প্রিয় বলে পৃথক করতে পারি, তিনি নারায়ণ মজুমদার, পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। সেই ছোট্টবেলায় যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিদ্যালয়ে যেতাম তখন থেকে স্যারকে দেখে আসছি। তিনি ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির। দেখলে ভয় পেতাম। আর সে কারণে খুব একটা তাঁর সামনে পড়তাম না। যখন অষ্টম শ্রেণিতে উঠলাম আমরা তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম। তিনি আমাদের সমস্ত ধারণা ভেঙে দিলেন, মিশে গেলেন আমাদের সাথে। জ্ঞানের উৎসের উন্মোচন ঘটালেন তিনি। সাহিত্য তাঁর আলোচনার বিষয়। রসহীন পাঠ্যবিষয়কে তিনি করে তুললেন রসমধুর। তিনি সমকালীন থেকে ছুটে গেলেন অতীতে, লোভনীয় করে তুললেন প্রাচীন সাহিত্য থেকে আধুনিকতম সাহিত্য সৃষ্টির নিদর্শনকে, রস উৎসারিত হয়ে উঠল পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায়। নারায়ণ স্যারের অবদানের পুষ্প বৃষ্টি পাঠের আঙিনা ছাড়িয়ে আমাদের জীবনের নানাদিক সুরভিত করে তুলেছিল। শিক্ষা শুধু একটা পরীক্ষা পাসের সনদপত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, জীবনের প্রয়োজনে শিক্ষা, একথা তাঁর কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়ে আমাদের অর্জিত জ্ঞান হয়ে উঠেছে বাস্তবানুসারী। শৃঙ্খলাকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। সুআচরণকে তিনি সভ্যতা, সংস্কৃতির প্রকাশ বিবেচনা করতেন। সততা ও আন্তরিকভাবে তিনি জীবনের সাফল্যের উপায় ভাবতেন। সময়ানুবর্তিতাকে তিনি মনে করতেন জীবন গঠনের অনিবার্য বান্ধব। তাঁর কর্তব্যপরায়ণতা তাঁকে আমার কাছে অধিকতর প্রিয় করে তুলেছে। সম্পূর্ণ এক ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্য দেখেছিলাম নারায়ণ স্যারের পরিত্রে। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা ছিল না তাঁর, কিন্তু দশজনের বাইরে তিনি একাদশতম হয়ে উঠেছিলেন সহজেই। একটি পুষ্পিত মহীরূহ তিনি, যার ছায়ায় বিকশিত হয়েছে অনেক জীবন, যার সৌরভে বিমোহিত হয়েছে চারদিক, যার নির্ভয় আশ্রয় নিশ্চিত করেছে অনেকের জীবন গঠন। সেই মহৎ মানুষটিই আমার প্রিয় শিক্ষক।