প্রকৃত পক্ষে পরিহিত ব্রত থেকেই জনসেবার প্রবণতার উৎপত্তি। ব্যক্তির মন যখন আপন স্বার্থকে অতিক্রম করে অপরের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে উদ্বোধিত হয় সেই মহান লক্ষ্যকেই বলা চলে সেবার লক্ষ্য, আর সেই লক্ষ্যে পরিচালিত কর্মসমূহের নামই জনসেবা।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব-আশরাফুল মাখলুকাত। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণের মূল্যমান কোথায় নিহিত? নিহিত মানুষের অন্তরে। সেখানে রয়েছে বিবেক। বিবেকের গুণেই মানুষ ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত চিন্তা করতে পারে। বিবেকই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। কথায় বলে
মানুষের মন আছে বলেই সে তার নিজের খাওয়া-পরা, সুখ-ভোগ, আনন্দ-উল্লাস ও স্বার্থরক্ষার চিন্তার বাইরেও অপরের সুখের জন্য চিন্তা করতে পারে। দরদী মানুষ অন্যের দুঃখে উদ্বেলিত হয়, মানুষের উদার হৃদয় দুঃখী দুঃখে আর্তের হাহাকারে, মুমুর্ষর আর্তনাদে কেঁদে ওঠে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মানুষই মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়-সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। মানুষের মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য, দুঃখ মোচনের জন্য মানুষের এই যে আগ্রহ, এই যে সহমর্মিতা-এর-ই নাম জনসেবা।
জনসেবা মানব জীবনের একটি মহান লক্ষ্য, সেবাধর্ম মানব চরিত্রের মহত্তম গুণ। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে শুধুমাত্র নিজের জন্য খেয়ে-পরে আমোদ-আহ্লাদ করে স্বার্থচিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থেকে জীবন কাটিয়ে দেবার জন্য পৃথিবীতে পাঠাননি। সৃষ্টিকর্তা জগৎ ও সৃষ্টি করেছেন মানুষও সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু, মানুষকে সৃষ্টির সেরা করে পৃথিবীতে পাঠানোর উদ্দেশ্য ভালো কাজের দ্বারা জগৎকে সুন্দর ও শান্তির আবাসভূমিরূপে গড়ে তোলা। স্বার্থবোধে অন্ধ থাকলে মানব জীবনের সেই উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এই জগৎ নানা সমস্যায় আকীর্ণ। মানুষের জীবনে সর্বক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা কখনোই থাকে না। নানা রকম অভাব-অনটন, দুঃখ-দৈন্য, হতাশা, মৃত্যু, শোক ইত্যাদি দ্বারা কারো কারো জীবন হয়ে উঠছে কণ্টক শয্যা। জগৎ ও জীবনের এই সমস্যা সমাধানের জন্য, জীবনের এই দুঃখ মোচন করে সর্বত্র সুখ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে মানুষকেই। পরের মঙ্গলের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। পরেরকল্যাণ হবে মানব জীবনের মহান ব্রত। কবি তাই বলেন-
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে কবির এই বাণী স্পষ্ট দিবালোকের মতোই মহাসত্য। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হলে মানুষের জীবন যাপন পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে। মানুষ একাকী কখন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। জীবন ধারণের নানা ও চাহিদা পূরণের জন্য মানুষকে নানাভাবে নানা জনের উপর নির্ভর করতে হয়। অর্থাৎ, সমাজের প্রত্যেক মানুষই প্রত্যেকের কাছ থেকে কোন না কোন ভাবে সাহায্য পাচ্ছে। কাজেই প্রত্যেক মানুষের তেমনি সমাজের সকল মানুষের জন্যই কোন না কোন দায়িত্ব রয়েছে। দরিদ্রের অভাব ঘুচানো, দীন দুঃখীকে সাহায্য করা, অন্ধকে পথ দেখানো, মুমূর্ষুর সেবা করা, আর্তের অশ্রুমোচন করা ইত্যাদি কল্যাণমূলক কাজের মধ্য দিয়ে-মানুষ সে দায়িত্ব পালন করতে পারে।
জনসেবার মহান ধর্ম একক ভাবে ভ্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যেমন পালন করা সম্ভব, তেমনি তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তা গোষ্ঠীগত প্রচেষ্টায়ও করা সম্ভব। জনসেবার এই প্রয়োজনীয়তা বিচার করে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
অন্যের জন্য কাজ করে, সমস্ত জীবনের সম্পদ ও শ্রম নিয়োজিত করে জনসেবার মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে জগতে অমর হয়ে আছেন অনেকে। হাজী মুহাম্মদ মহসীন, দাতা হাতেম তাই, দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা জনগণের সেবায় তাঁদের জীবনের সকল কিছু উৎসর্গ করেছিলেন। সেবাধর্ম মানুষের অন্তরকে মহান ও উদার করে। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। জীবনের নানা সমস্যা ও দুঃখ কষ্ট থেকে একে অন্যকে উদ্ধার করার প্রবণতায় জীবন হয়ে ওঠে সুন্দর ও সফল। সংকীর্ণ স্বার্থবোধ জীবনকে বিড়ম্বিত করে। স্বার্থচিন্তা নিজের সামান্য দুঃখ-কষ্টকে বড় করে দেখা, নিজের ভোগ বিলাসের লক্ষ্যে সর্বদা ব্যস্ত থাকা জীবনের মহত্তম উদ্দেশ্য সাধনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জনগণের সেবা করে, অন্যের দুঃখ মোচন করে নিজের দুঃখকে ভুলে থাকার মাধ্যমে অন্যের সুখেনিজে সুখী হওয়ার মানসিকতার উদ্বোধন ঘটিয়ে এই অমূল্য মানবজীবনকে অর্থময় করে তোলা যায়। এ জন্য বিশ্বের সর্বত্র সর্বকালে জনসেবা মহৎ কর্ম বলে নন্দিত হচ্ছে।