আমরা জনি দেশভ্রমণ যেমন আনন্দের তেমনি শিক্ষার অঙ্গও বটে। তাই, আমাদের ভ্রমণ করা একান্ত প্রয়োজন। সেবার তাই, বার্ষিক পরীক্ষার পরে কয়েক বন্ধুকে এ বিষয়ে উৎসারিত করি এবং প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে খুলনার খান জাহান আলীর দরগায় ভ্রমণে যাই। আমাদের সাথে যান আমাদের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ।
দরগাহ-দীঘি : খান জাহান আলীর দরগাহ খুলনা অঞ্চলের বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত। এখানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দীঘি আছে। যে দীঘিতে কতকগুলো বড় বড় কুমির বাস করে। এগুলো নাকি খান জাহান আলীর আমলের ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ নাকম দুটি কুমিরের সন্তান-সন্ততি। কথিত আছে, খান জাহান আলী নাম ধরে ডাকলেই কুমির দুটি তাঁর কাছে হাজির হয়ে খাবার গ্রহণ করত এবং কখনও কখনও কোনরূপ হিংস্রতার আশ্রয় নিত না। এখনকার কুমিরগুলোও “কালা পাহাড়” “ধলা পাহাড়” ডাকে সাড়া দেয় এবং দরগার খাদেমদের নিকট থেকে খাবার গ্রহণ করে। খাবার অবশ্য বেশির ভাগই দর্শনার্থীরা বিশেষ করে পুণ্যার্থী দর্শকেরা দিয়ে থাকেন। আমরাও কয়েকটি মুরগি কুমিরদের খেতে দিয়েছিলাম।
সমাধি সৌধ : দীঘির পাড়ে একটি সৌধের মধ্যে খান জাহান আলীর পবিত্র কবর অবস্থিত। সৌধটি বিচিত্র কারুকার্যময় বলে দেখতে খুবই সুন্দর এবং ছাদে গম্বুজ মাত্র একটি। সৌধের ভিতর পাথরের বেদীতে খান জাহান আলীর কবরে আরবিতে দোয়া লেখা আছে এবং এ কবর বেহেশ্তের অংশ বলে উল্লেখ করা আছে। এর গায়ে তারিখ লেখা আছে ৮৬৩ হিজরির ২৬শে জিলহজ্জ, খ্রিস্টীয় পঞ্জিকায় যা ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে অক্টোবর হয়।
পীর আলী সমাধি : সমাধি সৌধের পাশে একটি ছোট মসজিদ এবং তার কাছেই আছে খান জাহান আলীর প্রধান সাগরেদ মুহাম্মদ তাহির বা পীর আলীর সমাধি। সহকারী প্রধান শিক্ষক সাহেব জানালেন-মুহাম্মদ তাহির পূর্বে অমুসলিম ছিলেন। কিন্তু, মুসলমান হয়ে এমনই কামেল হয়ে যায় যে, পীর আলী বা শ্রেষ্ঠ পীর নামে পরিচিত হন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘পিরালী’ নামে যে বিশেষ শ্রেণি দেখা যায়, তা এই মুহাম্মদ তাহির বা পীর আলীর ধারা ধরেই চলে আসছে। ধর্মান্তরের আগে তাঁর একটি পুত্র ছিল। সেই পুত্রই হিন্দু পিরালীদের আদি গুরু।
ষাটগম্বুজ মসজিদ : খান জাহান আলীর দরগাহ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে বিখ্যাত ষাটগম্বুজ মসজিদ অবস্থিত, নাম ষাটগম্বুজ হলেও এতে গম্বুজ আছে সাতাত্তরটি। গম্বুজগুলো ধরে রাখার জন্য মসজিদের ভিতরে ষাটটি স্তম্ভ আছে। সম্ভবত অসাবধানতাবশত এগুলোর সংখ্যা অনুসারে গম্বুজের সংখ্যা নির্ধারণ করে “ষাটগম্বুজ” নামকরণ হয়েছে। মসজিদটির চার কোণায় চারটি মিনার, সম্মুখ ভাগের মধ্যস্থলে একটি বড় মিনার এবং তার দু’পাশে পাঁচটি করে ছোট মিনার আছে। ১৬০ ফুট দীর্ঘ, ১০৫ ফুট প্রস্থ ও ২২ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এ’মসজিদটি যে যুগের ছোট ইট দিয়ে তৈরি এবং এর প্রাচীরের বেধ প্রায় ৯ ফুট। কিন্তু, এর কারুকার্য সমাধি সৌধের কারুকার্যের মত তত সুন্দর নয়।
ঘোড়াদীঘি : ষাটগম্বুজ মসজিদের নিকটেও একটি বড় দীঘি আছে। এ’টির নাম ঘোড়াদীঘি। এ’টিতেও অনেক কুমির আছে। এছাড়া আছে ‘বিষপুকুর’ নামেম একটি পুষ্করিনী। খান জাহান আরীর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী সোনাবিবি অতিশয় শোকে বিষ খেয়ে এ’পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন এবং আর ওঠেননি। এ কারণে পুকুরটির এ নাম। ঘোড়াদীঘির পশ্চিম পাড়ে খান জাহান আলীর স্ত্রীর কবর বলে পরিচিত একটি কবর দেখা যায়। বিষ খাওয়ার ও ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনা যদি সত্য হয়, তবে ইনি সম্ভবত খান জাহান আলীল স্ত্রীই হবেন।
‘বেলদার’ বাহিনী : খান জাহান আলীর দরগাহ এবং ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রায় তিন মাইল এলাকা জুড়ে বহু ইমারতের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এগুলো সবই নাকি খান জাহান আমলে তৈরি হয়েছিল। সহকারী প্রধান শিক্ষক সাহেবের নিকট জানতে পারলাম যে, পঞ্চদশ শতাব্দীর এ সাধক পুরুষ খুলনা ও যশোরের আরও বহু স্থানে মসজিদ ও দীঘি নির্মাণ করেছিলেন। জনসাধারণের জলকষ্ট দূর করার জন্য পুকুর খননের উদ্দেশ্যে তাঁর ‘বেলদার’ নামে এক বিশেষ বাহিনী ছিল।
উপসংহার : আমরা প্রায় সারা দিনই দরগা ও ষাটগম্বুজ মসজিদ এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম। ভ্রমণে যে আনন্দ এবং শিক্ষণীয় বিষয় আছে, তা আমরা বাস্তবে বুঝতে পেরেছি। ভবিষ্যতেও সময়-সুযোগ করে এ’ধরনের শিক্ষা ভ্রমণ করা আমাদের প্রয়োজন। কারণ, আমাদের দেশে এ’রকম আরও অনেক ঐতিহাসিক স্থান বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। সেগুলোও দেখা ও উপভোগ করা দরকার।