চিঠির সংজ্ঞা
পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সংবাদ আদান-প্রদানের মাধ্যমে হিসেবে চিঠি পত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কাগজ আবিষ্কারের অনেক আগেই মানুষ গাছের পাতায়, বাকলে, চামড়ায়, ধাতব পাতে লিখত। পাতায় লিখত বলেই এর নাম হয় ‘পত্র’ আর চিঠির আভিধানিক অর্থ ‘স্মারক’ বা ‘চিহ্ন’। তবে ব্যবহারিক অর্থে চিঠি বলতে বোঝায়- একের মনের ভাব বা বক্তব্য অন্যের কাছে পৌঁছানোর জন্য লিখিত বিবরণীকে। নিকটস্থ মানুষের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতে হলে সরাসরি কথার মাধ্যমেই জানানো যায়। কিন্তু দূরবর্তী কারো কাছে প্রকাশ করতে হলে লেখার সাহায্য নিতে হয়। আমরা ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা সামাজিক প্রয়োজনে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছে চিঠি লিখে থাকি। সুলিখিত চিঠি অনেক সময় সাহিত্যের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হতে পারে। যেমন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’।
বাংলা ভাষায় লেখা সবচেয়ে প্রাচীন যে চিঠি পাওয়া গেছে সেটির রচনাকাল ১৫১৫ সাল। তৎকালীন অহোমরাজকে চিঠিটি লিখেছিলেন কুচবিহারের রাজা নারায়ণ। সেময় লোক মারফত চিঠি পাঠানো হতো। বর্তমানে ডাক ব্যবস্থার কল্যাণে চিঠিপত্র সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে এসেছে। সরকারি ডাক বিভাগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে পরিচালিত কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও আমরা দ্রুত চিঠিপত্র আদানপ্রদান করতে পারি। বর্তমানে টেলিফোন, ফ্যাক্স, মোবাইল, ই-মেইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহার যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। তবু চিঠিপত্রের আবেদন ফুরিয়ে যায়নি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে।
চিঠিকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রধান শ্রেণি তিনটিকে আবার বিষয়বস্তু ও কাঠামো অনুসারে ভাগ করা হয়েছে। চিঠির বিষয় ও কাঠামো অনুসারে চিঠি ছয়টি শ্রেণিতে বিভক্ত। যেমন-
ক. ব্যক্তিগত চিঠিখ. আবেদন বা দরখাস্ত
গ. সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য চিঠি
ঘ. মানপত্র ও স্মারকলিপি
ঙ. বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িক পত্র
চ. আমন্ত্রণ বা নিমন্ত্রণ পত্র
ব্যক্তিগত চিঠি : যে চিঠিতে সাধারণ কুশলাদি বিনিময়, ব্যক্তিগত প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের কথা ও লেখকের হৃদয়ানুভূতি প্রকাশ পায় তাকে ব্যক্তিগত চিঠি বলে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনের কাছে ব্যক্তিগত চিঠি লেখা হয়।
আবেদনপত্র বা দরখাস্ত : বিদ্যালয় বা অফিস কর্মকর্তাদের নিকট বিভিন্ন বিষয়ে আবেদন জানিয়ে যে পত্র লেখা হয় তাকেই আবেদন পত্র বলে।
সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য চিঠি : এলাকার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য যে পত্র লেখা হয় তাকে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য লিখিত পত্র বলে।
মানপত্র ও স্মারকলিপি : শিক্ষক, কর্মকর্তা অথবা সম্মানিত ব্যক্তিদের আগমন ও বিদায় উপলক্ষ্যে যে পত্র রচিত হয় তাকে অভিনন্দন পত্র, মানপত্র বা স্মারকলিপি বলা হয়।
বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িক পত্র : এক ব্যবসায়ী অন্য ব্যবসায়ীর নিকট বা কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যবসায়ীর নিকট ব্যবসা সংক্রান্ত যে পত্র লেখে তাকেই ব্যবসায়িক পত্র বলে।
আমন্ত্রণ বা নিমন্ত্রণ পত্র : বিয়ে, মিলাদ, পূজা ইত্যাদিতে দাওয়াদ দিতে যে পত্র লেখা হয় তাকে নিমন্ত্রণ পত্র বলে। এছাড়া আলোচনা সভা বা অন্যান্য অনুষ্ঠান উদ্যাপন উপলক্ষ্যে আমন্ত্রণ পত্র লেখা হয়।
চিঠির অংশ বিভাজন
চিঠি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত-
(ক) শিরোনাম বা বাইরের অংশ
(খ) পত্রগর্ভ বা ভিতরের অংশ।
চিঠি লেখার অনুসরণীয় পন্থা
চিঠি যে ধরনেরই হোক না কেন, তা লেখার সময় কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার:
১. বিষয়বস্তু বা প্রাসঙ্গিকতা ঠিক রাখতে হবে।
২. চিঠির মাধ্যমেই মানুষের রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। তাই অস্পষ্ট ও কাটাকাটি যেন না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
৩. ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এক্ষেত্রে নির্ভুল বানান, যথাযথ শব্দ, সঠিক বাক্য গঠনের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
৪. চিঠিতে নিজস্বতা থাকতে হবে। অর্থাৎ পাঠ্যবইয়ের নমুনা অনুসরণ করে নিজস্ব অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, অভিরুচির আলোকে চিঠি লিখতে হবে।
৫. সর্বোপরি, চিঠি লেখার সময় চিঠির কাঠামো ঠিক রাখতে হবে। নতুবা পরীক্ষায় ভালো নম্বর আশা করা যায় না।
লক্ষণীয়
চিঠির ছক
৬. শিরোনাম (চিঠির খামের ওপর প্রাপক ও প্রেরকের নাম ঠিকানা)
(খ) পত্রগর্ভ বা ভিতরের অংশ।
তবে সামগ্রিক বিচারে চিঠিতে সাধারণত ছয়টি অংশ থাকে। অংশগুলো নিম্নরূপ:
১. চিঠির ওপরের মঙ্গলসূচক শব্দ
২. চিঠির ওপরের ডান দিকে স্থান ও তারিখ
৩. চিঠির ওপরের বাঁদিকে সম্বোধন বা সম্ভাষণসূচক শব্দ
৪. চিঠির বক্তব্য বিষয় বা পত্রগর্ভ
৫. চিঠির শেষে লেখকের স্বাক্ষর
৬. চিঠির শিরোনাম।
১. চিঠির ওপরের মঙ্গলসূচক শব্দ
২. চিঠির ওপরের ডান দিকে স্থান ও তারিখ
৩. চিঠির ওপরের বাঁদিকে সম্বোধন বা সম্ভাষণসূচক শব্দ
৪. চিঠির বক্তব্য বিষয় বা পত্রগর্ভ
৫. চিঠির শেষে লেখকের স্বাক্ষর
৬. চিঠির শিরোনাম।
এছাড়া সংবাদপত্রে লিখিত চিঠিতে দুটি অংশ থাকে। একটি সম্পাদকের কাছে লেখা চিঠি ও অপরটি মূলবক্তব্য বিষয় বা প্রতিবেদন। এখানে বিভিন্ন অংশের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো-
১. মঙ্গলসূচক শব্দ : ব্যক্তিগত চিঠিতে মঙ্গলসূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়, তবে ব্যবহারিক পত্রে এর কোনো প্রয়োজন নেই। মঙ্গলসূচক শব্দের ব্যবহারে বিভিন্ন ধর্মে স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করা যায়। মুসলিম রীতিতে ইয়া রব, এলাহি ভরসা, আল্লাহু আকবর ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। আবার হিন্দু রীতিতে ওঁ, শ্রী শ্রী দুর্গা, শ্রীহরি সহায় ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার প্রচলিত। তবে আধুনিক চিঠিতে মঙ্গলসূচক শব্দের ব্যবহার প্রায়ই পরিহার করা হয়।
২. চিঠি লেখার স্থান ও তরিখ : আধুনিক নিয়মে ব্যক্তিগত ও সামাজিক পত্রের ওপরের অংশের বামকোণে পত্রলেখার স্থান ও তারিখ লিখতে হয়। আবেদনপত্রের নিচে বাম দিকে স্থান ও তারিখ লেখাই নিয়ম। তবে আধুনিক নিয়মে আবেদনপত্রের ওপরে বাম দিকে তারিখ লিখতে হয়।
৩. চিঠির সম্বোধন : প্রেরক তার বক্তব্য শুরুর আগে চিঠির ওপরের অংশের বাম দিকে প্রাপকের উদ্দেশ্যে সম্বোধনসূচক শব্দ লিখে থাকেন। যেমন : বড়দের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধাষ্পদেষু, শ্রদ্ধাভাজন, মান্যবরেষু, শ্রদ্ধেয়া, মাননীয়া ইত্যাদি। ছোটদের ক্ষেত্রে কল্যাণীয়, কল্যাণীয়া, স্নেহাষ্পদ, স্নেহাষ্পদেষু ইত্যাদি। সমবয়সিদের ক্ষেত্রে বন্ধুবর, সুপ্রিয়, সুহৃদ, প্রিয় ইত্যাদি।
৪. চিঠির বক্তব্য বা পত্রগর্ভ : পত্রের সম্বোধনের পর মূল বক্তব্য বিষয় লিখতে হয়। এটিই চিঠির সবচেয়ে দরকারি অংশ। তাই বক্তব্য লেখার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বক্তব্যের ভাষা স্পষ্ট, প্রাসঙ্গিক, সহজ সরল ও প্রাঞ্জল হতে হবে। বক্তব্যকে স্পষ্ট ও প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য অনুচ্ছেদে বিভক্ত করে লিখলে ভালো হয়। যেমন- প্রথম অনুচ্ছেদে সালাম বা শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি লেখার কারণ বা পটভূমি তৈরি করতে হয়। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে মূল বক্তব্যকে যথাসম্ভব স্পষ্ট বাক্যে লেখা উচিত। তৃতীয় অনুচ্ছেদে ইচ্ছা বা অভিপ্রায় প্রকাশ এবং প্রয়োজনে বক্তব্যকে আরো বিশ্লেষণ করে শেষ করা যেতে পারে।
৫. স্বাক্ষর : শিষ্টাচারমূলক বিদায় সম্ভাষণ লিখে স্বাক্ষর করতে হবে। শিষ্টাচারমূলক শব্দ শ্রেণিবিশেষে বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। যেমন-
- শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির প্রতি : খাকসার, প্রণত, স্নেহের ইত্যাদি।
- ছোটদের প্রতি : শুভার্থী, আশীর্বাদক ইত্যাদি।
- বন্ধু বান্ধবের প্রতি : প্রীতিমুগ্ধ, তোমার ইত্যাদি।
- সাধারণ : নিবেদক, বিনীত ইত্যাদি।
৬. চিঠির শিরোনাম : চিঠির খামের ওপর বাম দিকে প্রেরকের ঠিকানা ও ডানদিকে প্রাপকের ঠিকানা লিখতে হয়। তবে বর্তমানে সরকারি ডাক ব্যবস্থা কর্তৃক প্রবর্তিত খামের সামনের অংশে প্রাপকের ঠিকানা ও পেছনের অংশে প্রেরকের ঠিকানা লিখতে হয়। প্রাপকের ঠিকানা লেখার সময় তার এলাকার পোস্টকোড সঠিকভাবে লিখতে হবে। পোস্টকোড লিখলে চিঠি দ্রুত পৌঁছায়। ডাকে পাঠানো চিঠিতে প্রয়োজনানুসারে রেজিস্টার্ড, বুকপোস্ট ইত্যাদি লিখতে হয়। বিদেশে চিঠি পাঠানোর সময় খামের ওপর ইংরেজিতে প্রাপকের নাম ও ঠিকানা লেখা আবশ্যক।
চিঠি লেখার অনুসরণীয় পন্থা
চিঠি যে ধরনেরই হোক না কেন, তা লেখার সময় কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার:
১. বিষয়বস্তু বা প্রাসঙ্গিকতা ঠিক রাখতে হবে।
২. চিঠির মাধ্যমেই মানুষের রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। তাই অস্পষ্ট ও কাটাকাটি যেন না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
৩. ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এক্ষেত্রে নির্ভুল বানান, যথাযথ শব্দ, সঠিক বাক্য গঠনের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
৪. চিঠিতে নিজস্বতা থাকতে হবে। অর্থাৎ পাঠ্যবইয়ের নমুনা অনুসরণ করে নিজস্ব অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, অভিরুচির আলোকে চিঠি লিখতে হবে।
৫. সর্বোপরি, চিঠি লেখার সময় চিঠির কাঠামো ঠিক রাখতে হবে। নতুবা পরীক্ষায় ভালো নম্বর আশা করা যায় না।
লক্ষণীয়
আধুনিক রীতিতে এবং কম্পিউটারে অক্ষর বিন্যাসের ক্ষেত্রে চিঠিপত্রে বাম ঘেঁষা পংক্তি বিন্যাসের (Left Alignment) রীতি অনুসরণ করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পত্রে পত্রলেখকের কিছুটা স্বাধীনতা রয়েছে। পত্রলেখক ইচ্ছা করলে হাতে লেখা পত্রে উক্ত রীতি অনুসরণ নাও করতে পারেন।
চিঠির ছক
চিঠির খামে চাকরির জন্য কোন ঠিকানা লিখতে হবে।ববর্তমান নাকি স্থায়ি?
ReplyDeleteবর্তমান ঠিকানা লিখাই ভালো, কিন্তু যদি মনে হয় কিছুদিনের মধ্যেই আপনার বর্তমান ঠিকানা পরিবর্তন হতে পারে, তখন স্থায়ী ঠিকানা লিখুন।
Delete