একাত্তরের ৩ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন
অনুষ্ঠানের কথা ছিল। পাকিস্তানের বিরোধী দল জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি
বিরোধিতা করছিল। এ অবস্থায় ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, সেনাশাসক জেনারেল
ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিলে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে
পড়ে। ঢাকার রাজপথে জনতার ঢল নামে। সবাই পল্টন ময়দানের (বর্তমানের আউটার
স্টেডিয়াম) দিকে যায়। হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের বৈঠক চলছিল। সেখানে
বঙ্গবন্ধু বিক্ষোভ আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেন। সামরিক শাসকেরা কারফিউ জারি করে।
মানুষ কারফিউ ভেঙে রাজপথে নামে। গভীর রাতেও বিভিন্ন এলাকা থেকে গণমানুষের উত্তাল
মিছিল বেরোতে থাকে। তারা পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচার গুলির সামনে বুক পেতে দেয়।
অসংখ্য মানুষ প্রাণ দেয়।
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু তাঁর
ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেন,
‘.....এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শুরু হয় অসহযোগ
আন্দোলন। শুধু আধা বেলা ব্যাংক খোলা থাকত। যানবাহন সামান্য কিছু চলত। আর সব বন্ধ।
তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।
পরদিন ৮ মার্চ থেকে প্রতিদিন ঢাকার রাজপথে মিছিল চলত। আদমজী-বাওয়ানি জুট মিল,
পোস্তগোলার বিভিন্ন ফ্যাক্টরি ও ঢাকার বিভিন্ন অফিস-আদালতের মানুষজন মিছিল নিয়ে
প্রতিদিন যেত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে। বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান তাঁর বাসার গেটে মিছিলকারীদের আন্দোলন-বিক্ষোভ-মিছিল অব্যাহত রাখার
আহ্বান জানিয়ে ভাষণ দিতেন। ঢাকা শহরজুড়ে গভীর রাত পর্যন্ত ছিল এই একই দৃশ্য।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও মাঠে চলত ঢাকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীদের রাইফেল ট্রেনিং। বলা যায়, সেটাই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির প্রথম
পর্ব।
দেখতে দেখতে চলে এল ২৫ মার্চ কালরাত। সেদিন বিকেলে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ও সব পাড়া-মহল্লায় খবর পাঠালেন, রাতে সেনাবাহিনী ট্যাংক নামাবে, মর্টার শেলিং
করবে। যার যার এলাকা পাহারার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু, যেন
সেনাবাহিনীর ট্যাংক ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরোতে না পারে। মর্টার শেলিং করতে না
পারে।
খবরটা বিকেলের দিকে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা কয়েকজন ছাত্রকর্মী সন্ধ্যার দিকে
যাই হাতিরপুল এলাকায়। সেখানে তখন পাড়া-মহল্লা প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে
গেছে।
হাতিরপুলে যাওয়ার একটু কারণ ছিল। ওই এলাকার কাছেই পাক মোটরকে (বর্তমানে
বাংলামোটর) কেন্দ্র করে কিছু প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটা প্রাথমিক পরিকল্পনা আমাদের
ছিল। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংকবহর ওই রাস্তা ধরেই ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানাইপিআর বাহিনীর (বর্তমান বিজিবি) ওপর
হামলা চালাবে। পকৃতপক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিকল্পনাও সে রকমই ছিল। ওরা
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ঘাঁটি গাড়ে। সে জন্যই আমাদের সেখানে যাওয়া। অবশ্য পরে
দেখা গেল, পাকিস্তানি বাহিনী যে বীভৎস গণহত্যা শুরু করে, সে তুলনায় আমাদের
প্রস্তুতি ছিল একেবারেই নগণ্য। তাদের নৃশংস রূপটি দেখে আমরা দ্বিগুণ
প্রতিরোধস্পৃহা নিয়ে উজ্জীবিত হলাম।
স সময় পাক মোটর মোড়ের সামান্য উত্তরে একটা কালভার্ট ছিল। যদি পাকিস্তানি বাহিনী
ঢাকা আক্রমণ করতে আসে, তাহলে সেই কালভার্ট বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া এবং
ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকের রাস্তা কেটে ট্যাংক ও সাঁজোয়া
বাহিনীর গতি রোধ করার একটা পরিকল্পনা আমাদের ছিল। সেটা মাথায় রেখে আমরা হাতিরপুল
এলাকায় গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এ সময়
কিছু তরুণ রাস্তায় সমবেত হয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকে যে বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান হানাদার বাহিনীকে রুখতে যার যার পাড়া-মহল্লায় স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ
গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
আমরা সবাই মিলে বৈঠকে বসি। ঠিক হয় পরীবাগের মোড়ে রাস্তা কেটে ফেলা হবে, যেন
পাঞ্জাবি সেনারা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ট্যাংক-জিপ নিয়ে যেতে না পারে।
কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়ার বিস্ফোরক পাওয়া গেল না। তবে আমরা কিছু বোতলে পেট্রল ও
সিসার টুকরা ভরে মলোটভ ককটেল বানালাম। হাতিরপুলের পশ্চিম পাশের রাস্তাটা আড়াআড়ি
কেটে ফেলার পরিকল্পনাও হয়।
তখন রাত ১০টা হবে। কয়েকজন তরুণ শাবল নিয়ে পরিবাগের মোড়ে চলে যায়। আরেকটি দল যায়
এলিফ্যান্ট রোডের দিকে। তারা রাস্তা কাটা শুরু করে। আমরা কয়েকজন হাতিরপুলের ঠিক
মোড়ে একটা চারতলা বাড়ির ছাদে মলোটভ ককটেলগুলো সাজিয়ে রাখতে শুরু করি। আমাদের সেই
তারুণ্যের উদ্ভাসিত চোখেমুখে তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। আমরা ভাবছি, পাঞ্জাবি
বাহিনীর ট্যাংক এলে ছাদ থেকে ককটেল ছুড়ে তাদের পরাস্ত করব। জীবনের শেষ রক্তবিন্ধু
দিয়ে লড়ব!
কিছুক্ষণ পর পরীবাগের দিক থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। এর পরপরই সেই তরুণেরা,
যারা পরীবাগের রাস্তা কাটতে গিয়েছিল, চোখেমুখে ভয় নিয়ে ফিরে আসে। তারা জানায়,
রাস্তা খুঁড়তে দেখে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যাওয়ার পথে একটি জিপ থেকে সেনারা
গুলি করে দুই তরুণকে হত্যা করেছে। একের পর এক ট্যাংক আসছে দেখে ওরা ফিরে এসেছে।
এর পরপরই থেমে থেমে মটার শেলিংয়ের শব্দ শুনি। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ওপর
থেকে ট্রেসার বুলেট ছুড়তে দেখি। হোটেলের বিপরীত পাশের গলিতে ছিল ‘দি পিপল’
পত্রিকার অফিস। পত্রিকাটি ছয় দফা-এগারো দফার সমর্থনে সোচ্চার ছিল। কামানের কয়েকটি
গোলায় পত্রিকা অফিসটি ভস্মীভূত করা হয়। তার পেছনের বস্তিতে আগুন ধরে যায়। কিছু
লোক তৎক্ষণাৎ মারা যায়। দূর থেকে ভেসে আসে অজস্র গুলি ও মর্টার শেলিংয়ের শব্দ।
তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান শুরু হয়ে গেছে।
মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকায় নীরবতা নেমে আসে। আমরা কয়েকজন হাতিরপুল মোড়ে আমাদের
এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিই। কোলে-পিঠে বাচ্চা নিয়ে বস্তির গরিব মানুষ নিঃশব্দে
হাতিরপুলের বিভিন্ন বাসায় আশ্রয় নেয়।
সারা রাত গোলাগুলি চলতে থাকে। পরের দিন কারফিউ ছিল। বিকেলে একটি ট্যাংক আসে।
সেনারা নেমে নির্বিচারে গোলাগুলি করে কয়েকজনকে হত্যা করে। তার পরদিন সকালে
কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ উঠিয়ে নিলে আমরা বেরিয়ে পড়ি। ইকবাল হল (বর্তমানে
সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হল ঘুরে শহীদ মিনারে যাই। রাজারবাগ পুলিশ
লাইনস। সবখানে লাশ আর লাশ।
শুরু হয় আমাদের পত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ।
আব্দুল কাইয়ুম : সম্পাদক,
চলতি ঘটনা।
Khob ভালো
ReplyDelete