বিশ্ব মানবতার মুক্তিবার্তা নিয়ে বছর পরিক্রমায় মুসলমানদের জীবনযাত্রায় মাহে
রমযান আবারও উপস্থিত। বিশ্ব মুসলিম জনগোষ্ঠী মহান আল্লাহ তা’আলার কাছ থেকে এ
মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মতো অফুরন্ত নিয়ামত হাসিল
করে। তাই মাহে রমযানের গুরুত্ব ও ফযিলতকে ঘিরে আমাদের এ আয়োজন।
মাহে রমযান
‘মাহে রমযান’ অর্থ রমযানের মাস। ‘রমযান’ শব্দটি আরবি ‘রময’ থেকে
এসেছে। ‘রময’ অর্থ দমন বা পোড়ানো। এ মাসে রোযা পালন করলে মানুষের মধ্য
থেকে লোভ-লালসা, পাপ-পঙ্কিলতা ও হিংসা-বিদ্বেষ দূরীভূত হয়। রোযা পালনকারী
রমযানে তার সব পাপ মুছে ফেলার সুযোগ লাভ করেন। রমযান মাসে পালিত রোযাকেই
রমযানের রোযা বলা হয়।
রোযা
রোযা ফারসি শব্দ। আর আরবি প্রতিশব্দ ‘সাওম’ বা ‘সিয়াম’। এর
আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থ ‘বিরত থাকা’। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় সাওম হলো সুবহে
সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা পালনের উদ্দেশ্যে সকল প্রকার পানাহার ও
ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করে দেয়া হয়েছে যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। আশা করা যায় এ থেকে তোমাদের মধ্যে তাক্বওয়ার গুণাবলি সৃষ্টি হবে। ---- [সূরা আল-বাকারা : ১৮৩]
মাহে রমযানের পুরো এক মাসের রোযা তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম ১০ দিন রহমত,
দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাত এবং তৃতীয় ১০ দিনকে নাজাতের সময় বলা হয়।
পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের রোযা
- হযরত আদম (আ.) প্রত্যেক আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোযা রাখতেন। (কানযুল উম্মাল, ৮ম খণ্ড)
- হযরত নূহ (আ.) দুই ঈদ ছাড়া সবসময় রোযা রাখতেন। (ইবনে মাজাহ, ২য় খণ্ড)
- হযরত দাউদ (আ.) একদিন পরপর রোযা রাখতেন।
- হযরত সোলায়মান (আ.) মাসের শুরুতে তিন দিন, মাসের মধ্যভাগে তিন দিন, মাসের শেষ ভাগে তিন দিন রোযা রাখতেন। (কানযুল উম্মাল, ৮ম খণ্ড)
- হযরত ঈসা (আ.) সবসময় রোযা রাখতেন, কখনও রোযা ছাড়তেন না। (মুসলিম)
মাহে রমযানের গুরুত্ব ও ফযিলত
মাহে রমযানের গুরুত্ব ও ফযিলত অসীম। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে এর গুরুত্ব
ও ফযিলত সম্পর্কে জানা যায়। রমযান মাসেই কুরআন অবতীর্ণ হয় ও রোযা ফরজ হয়। এটা
লাইলাতুল ক্বদরের মাস এবং রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এ মাসে জান্নাতের দরজা
খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু রমযানের জন্য বাকি
এগারো মাসে জান্নাতকে সাজানো হয় এবং এ মাসের একটি ফরজ অন্য মাসের সত্তরটি ফরজের
সমতুল্য, আর একটি নফল অন্য মাসের একটি ফরজের সমতুল্য। রোযার ফযিলত সম্পর্কে নবী
করীম (স) এরশাদ করেন-
- রমাদ্বান শরীফ-এ আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমল দশগুণ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়ে থাকে। (বুখারী ও মুসলিম)
- রাসূল (স) বলেছেন, যে লোক রমযান মাসে ঈমানসহ ছওয়াবের আশায় রোযা রাখবে তার পূর্ববর্তী গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। (বুখারী ও মুসলিম)
- রোযাদারের মুখে গন্ধ মহান আল্লাহর নিকট কস্তুরির সুগন্ধ হতেও অতি উৎকৃষ্ট। (বুখারী)
- যে ব্যক্তি রমযান পেল অথচ নিজের গোনাহ মাফ করাতে পারলো না, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক। (বুখারী, তিরমিযি)
- ইফতারের সময় যোযাদার যখন দু’আ করে তখন তার দু’আ ফিরিয়ে দেয়া হয় না। (ইবনে মাজাহ)
- রমযানের প্রথম রাত্রিতেই শয়তান ও বাধ্য জিনদেরকে শৃঙ্খলিত করে দেয়া হয়। (তিরমিযী)
- জান্নাতের একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’। রোযাদারকে এ দরজা দিয়েই ডাকা হবে। রোযাদার এ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, সে কখনও পিপাসিত হবে না। (তিরমিযী)
- যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একদিন রোযা রাখে, আল্লাহ তাকে দোযখ থেকে সত্তর বছরের পথ দূরে রাখবেন। (বুখারী)
- হাদীসে কুদসিতে রয়েছে, আল্লাহ তা’আলা বলেন, সাওম আমার জন্য। আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। (বুখারী ও মুসলিম) রোযা বিশ্বাসী বান্দাদের জন্য ঢাল স্বরূপ। রোযা সব সময় মানবিক বিপর্যয়কে ঠেকিয়ে রেখে এক সুস্থ ও গতিশীল জীবনযাপনের শক্তি জোগায়। এ শক্তি এক প্রকার আসমানি শক্তি, যা মহান ত্যাগী ও আত্মপ্রত্যাশী খাঁটি মুমিন বান্দা তৈরি করতে সক্ষম।