অর্থ অনুসারে শ্রেণিবিভাগ
অর্থগতভাবে বাংলা ভাষার শব্দসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—
১. যৌগিক শব্দ
২. রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ
৩. যোগরূঢ় শব্দ
১. যৌগিক শব্দ : যে—সব শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, অর্থাৎ একই রকম, সে সব শব্দকে যৌগিক শব্দ বলে। যেমন— চালক। শব্দটির গঠন এভাবে হয়েছে— ‘চল্’ (ধাতু) + ‘অক’ (প্রত্যয়)। এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে চালায়। আর চালক শব্দটার ব্যবহারিক অর্থও তাই। সুতরাং ‘চালক’ শব্দটা বাংলাতে যৌগিক শব্দ। এসকল শব্দ প্রকৃতি প্রত্যয় দ্বারা অর্থবোধক। তাই বলা যায়— যে সকল শব্দের অর্থ প্রকৃতি — প্রত্যয়ের অর্থ অনুসারে হয়ে থাকে, তাদের যৌগিক শব্দ বলে। আরো কিছু উদাহরণ—
গায়ক = গৈ + অক
গান করে যে।
কর্তব্য = কৃ + তব্য
যা করা উচিত।
বাবুয়ানা = বাবু + আনা
বাবুর ভাব।
মধুর = মধু + র
মধুর মতো মিষ্টি গুণযুক্ত।
দৌহিত্র = দৃহিতৃ + অ
কন্যার পুত্র, নাতি।
চিকামারা = চিকা + মারা
দেওয়ালের লিখন।
বাবুগিরি = বাবু + গিরি
বাবুর আচরণ।
জলযান = জল + যান
জলে চলে যে যান (যাতে চড়ে যাওয়া যায়)
পড়ুয়া = পড়্ + উয়া
যে পড়ে।
এসব ছাড়াও— নায়ক, নয়ন, শয়ন, বাঁদরামি, গুণবান, মিতালি, পাঠক, ভাড়াটে, মেয়েলি ইত্যাদি হলো যৌগিক শব্দ।
২. রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ : সাধিত শব্দ কেবল তার যৌগিক অর্থেই ব্যবহৃত হয় না। মানুষ তাকে নিজের মতো করে নতুন কোনো বিশেষ অর্থে ব্যবহার করে। যে সকল শব্দ তার গঠনের উপাদান (প্রকৃতি ও প্রত্যয়) অনুসারে যে যৌগিক অর্থ, সে অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে কোনো বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাকে রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ বলে। অথবা, যে—সব শব্দ বুৎপত্তিগত অর্থ না বুঝিয়ে অন্য কোনো বিশিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে, তাকে রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ বলে। অথবা, যেসব শব্দ প্রকৃতি—প্রত্যয় অর্থকে না বুঝিয়ে অন্য কোনো বিশিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে, তাকে রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ বলে। যেমন— হস্তী = হস্ত + ইন্, অর্থ— হস্ত (হাত) আছে যার; কিন্তু হস্তী বলতে এক শ্রেণির বিশেষ পশুকে বুঝায়। তেমনি, গবেষণা (গো+ এষণা) অর্থ— গরু খোঁজা। গভীরতম অর্থ— ব্যাপক অধ্যয়ন বা পর্যালোচনা। এরকম আরো উদাহরণ—
বাঁশি = বাঁশ দিয়ে তৈরি যেকোনো বস্তু নয়, শব্দটও সুরের বিশেষ বাদ্যযন্ত্র। বিশেষ অর্থে প্রযুক্ত হয়।
তৈল = শুধু তিলজাত স্নেহপদার্থ নয়, শব্দটি যেকোনো উদ্ভিজ্জ পদার্থজাত স্নেহপদার্থকে বোঝায়। যেমন— বাদাম তেল।
প্রবীণ = শব্দটির অর্থ হওয়া উচিত ছিল প্রকৃষ্ট রূপে বীনা বাজাতে পারেন যিনি। কিন্তু শব্দটি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বয়স্ক ব্যক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
সন্দেশ = শব্দ ও প্রত্যয় অর্থে ‘সংবাদ’। কিন্তু রূঢ়ি অর্থে ‘মিষ্টান্ন বিশেষ’।
এছাড়া— কুশল, হরিণ, ঝি, পাঞ্জাবি, মন্দির, ফলাহার, থ, কারচুপি, শুশ্রূষা, বৎস, রাখাল, কদর্য ইত্যাদি রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ।
৩. যোগরূঢ় শব্দ : একাধিক শব্দ বা ধাতুর যোগে নিষ্পন্ন শব্দ অথবা সমাসবদ্ধ কোনো শব্দ যদি যৌগিক অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে অন্য বিশেষ কোনো অর্থ বুঝায়, তখন তাকে যোগরূঢ় শব্দ বলে। অথবা, সমাসনিষ্পন্ন যে সব শব্দ সম্পূর্ণভাবে সমস্যমান পদসমূহের অনুগামী না হয়ে কোনো বিশিষ্ট অর্থ গ্রহণ করে, তাদের যোগরূঢ় শব্দ বলে। যেমন— পঙ্কে জন্মে যা (উপপদ তৎপুরুষ সমাস)। শৈবাল, শালুক, পদ্মফুল ইত্যাদি উদ্ভিদ পঙ্কে জন্মে। কিন্তু এখানে ‘পঙ্কজ’ শব্দটি কেবলমাত্র ‘পদ্মফুল’ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। তাই ‘পঙ্কজ’ একটি যোগরূঢ় শব্দ। এরমক আরো উদাহরণ—
রাজপুত = রাজার পুত্র অর্থ পরিত্যাগ করে যোগরূঢ় শব্দরূপে অর্থ হয়েছে ‘জাতিবিশেষ’।
মহাযাত্রা = মহাসমারোহে যাত্রা অর্থ পরিত্যাগ করে যোগরূঢ় শব্দরূপে অর্থ ‘মৃত্যু’।
জলধি = ‘জল ধারণ করে এমন’ অর্থ পরিত্যাগ করে একমাত্র ‘সমুদ্র’ অর্থে ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া— জলদ, দশানন, পরিবার, বহুব্রীহি, গোঁফখেজুরে, অসুখ (এখানে সুখ—এর অভাব না বুঝিয়ে রোগ বোঝায়) ইত্যাদি হলো যোগরূঢ় শব্দের উদাহরণ।
Nice Post
ReplyDelete