রচনা : অধ্যবসায় (30+ Points) - PDF

↬ ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব

↬ ছাত্রজীবন ও অধ্যবসায়



ভূমিকা :
“জীবনের প্রতি অধ্যায়/ চাই দৃঢ় প্রত্যয়,
চাই ঘাত–প্রতিঘাত/ লৌহ কঠিন সত্য হৃদয়।”

কবিতার এই ছত্রেই লুকিয়ে আছে অধ্যবসায়ের সারাংশ। তাই বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন,

“Our life is full of struggle.”
অর্থ : আমাদের জীবন সংগ্রামপূর্ণ।

জীবনে সাফল্য লাভের একমাত্র হাতিয়ার হলো অধ্যবসায়। এটি মানুষের একটি মহৎ গুণ। তাই জগতে যে অধ্যবসায়ী সে–ই জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে পারে। কোনো কাজে সাফল্য লাভের জন্য বারবার চেষ্টা করার নাম অধ্যবসায়। তাইতো কবির উচ্চারণ,

“পারিব না এ কথাটি বলিও না আর,
একবার না পারিলে দেখ শতবার।”

কবির এ উদ্দীপনামূলক বাণীই অধ্যবসায়ের মূলকথা এবং সাহস যোগায় তাকে। সত্যিকার অর্থে কাজে বিফলতা সত্ত্বেও অসাধ্য কাজটি সুসম্পন্ন করার জন্য অবিচল উৎসাহ, দৃঢ় সংকল্প, অসীম ধৈর্য— সবই অধ্যবসায়। অধ্যবসায় ছাড়া পৃথিবীতে কোনো মহৎ কাজ সাধিত হয় না।

অধ্যবসায় কী ? : অধ্যবসায় শব্দের অর্থ চেষ্টা বা সাধনা করা। কৃতকার্যতার জন্যে বারবার চেষ্ঠা করার নাম হল অধ্যবসায়। ডা. লুৎফর রহমানের উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তিনি বলেন,

“সাধনার কোনো কোনো ব্যাপারে যদি প্রথমবারে ব্যর্থ মনোরথ হও, তবে তড়িৎ যেওনা–বারেবারে আঘাত কর, দুয়ার ভেঙে যাবে।”

আবার ইংরেজিতে একটি কথা আছে— Try again and again. অর্থাৎ একেই বলে অধ্যবসায়। মানবজীবনে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করা যায় না। দৃঢ় মনোবল হল অধ্যবসায়ের মূল। সহজ কাজ প্রথম চেষ্টাতেই শেষ করে ফেলা যায়। কিন্তু মানুষের জীবনে সফলতা নির্ভর করে কঠিন কাজের সফলতার মধ্যে। আর এই কঠিন কাজের সফলতার জন্য প্রয়োজন অধ্যবসায় অর্থাৎ দৃঢ় পরিশ্রম ও ধৈর্য। সেজন্য দৃঢ় মনোবল ধারণ করে কাজে আত্মনিয়োগ করার সাথে সাথে চরিত্রের অন্যান্য গুণাবলী যখন কাজে লাগানো হয় তখনই অধ্যবসায়ের পরিচয় পাওয়া যায়।

অধ্যবসায়ের গুরুত্ব : উদ্যম ব্যতিরেকে জগতে কোনো কাজই সম্পন্ন হয় না।কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার বলেছেন,


সময়ের সঙ্গে জীবন, জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে কর্ম। ভালো এবং উত্তম কর্মের জন্য প্রয়োজন অধ্যবসায়। অধ্যবসায় মানব জীবনের মূল প্রেরণা এবং চালিকাশক্তি। সংগ্রামে জয় আছে, আছে পরাজয়। কিন্তু এই পরাজয় শেষ কথা নয়। পরাজয় হচ্ছে নতুন জয়ের সোপান। অতএব

“ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো, বাঁধো বাঁধো বুক।”

মানুষের চলার পথে বাধাবিপত্তি আসবেই। এ বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। রাতের ঘন অন্ধকার কাটার পরে সোনালি প্রভাত দেখা দেওয়া এক বাস্তবতা। পুনঃপুন চেষ্টা করার ফলে মানুষের ভাগ্যাকাশে তেমনি উদিত হয় সাফল্যের শুকতারা। জীবনের প্রথম ব্যর্থতাকে সবসময়ই মনে করতে হবে এটাই সফলতার প্রথম সিঁড়ি। ইংরেজিতে একটি কথা আছে,

Failure is the pillar of success.

অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ ব্যর্থতাকে জয় করে, অসাধ্যকে সাধন করতে পারে। জগতের কোনো কিছু অর্জন সাধনা ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। চলার পথে যে জিনিস যত মূল্যবান, যত দুষ্প্রাপ্য, যত রহস্যময়, যত আকাঙ্ক্ষিত তাকে লাভ করার জন্য চাই তত বেশি পরিশ্রম, ধৈর্য এবং সাধনা। এসবই হচ্ছে অধ্যবসায় নামক চরিত্র শক্তির একটি বিন্দু। জগতে যেসব ব্যক্তি উন্নতি করে সুনাম অর্জন করেছেন, তারা সবাই অধ্যবসায়ী ছিলেন। বড় বড় শিল্পী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, সেনানায়ক, ধর্ম প্রবর্তক সবাই ছিলেন অধ্যবসায়ের এক একটি মূর্তমান প্রতীক। তারা বারবার ব্যর্থ হয়েও নিরলস পরিশ্রম করে অসীম ধৈর্য সহকারে নিজ নিজ আদর্শের পথে অগ্রসর হয়েছেন। এজন্য মানব জীবনের প্রতিটি স্তরে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনে সাফল্য এবং ব্যর্থতা দু–ই আসবে। কিন্তু সব ব্যর্থতাই সাময়িক। ব্যর্থতাকে জয় করার জন্য প্রয়োজন বার বার চেষ্টা তথা অধ্যবসায়।

অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা : অধ্যবসায় কৃতকার্যতার চাবিকাঠি। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করাই জীবনের লক্ষ্য। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথকে সহজ করার জন্য প্রয়োজন অধ্যবসায়। একটা কথা আছে,

”একবার না পারিলে দেখ শতবার, পারিবনা বলে মুখ করিও না ভার”

পারতে—ই হবে এরূপ মনোভাব আমাদের সবার থাকা উচিত। তবেই কেবলমাত্র জীবনের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। অধ্যবসায় ব্যক্তি জীবনকে উন্নত করে। মানুষ সুখ চায়। কিন্তু এই সুখের উপকরণ কারো জন্যে তৈরি করে রাখা হয় না। মানুষকে তার স্বীয় যোগ্যতা দিয়ে এই সুখ অর্জন করে নিতে হয়। আর এর জন্য চাই অধ্যবসায়। জাতীয় জীবনেও অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এটি ছাড়া কোনো জাতি কখনো উন্নতির শিখরে পৌছাতে পারে না। জাতির মঙ্গল প্রতিষ্ঠার জন্য সামগ্রিকভাবে সকল নাগরিককে অধ্যবসায়ী হতে হবে। বিশ্বচরাচরের জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার অধ্যবসায়।অধ্যবসায়ী ব্যক্তির নিকট অসম্ভব বলে কিছু নেই। সেজন্য সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছেন,

“Impossible is a word only found in the dictionary of the fools.”
অর্থ : অসম্ভব কথাটি / শব্দটা কেবল বোকার অভিধানেই পাওয়া যায়।

মানব সভ্যতায় অধ্যবসায় : আজকের সভ্য জগৎ আমাদের পূর্ব পুরুষদের অধ্যবসায়ের ফল। এ পৃথিবী একদিন ছিল মানুষের বসবাসের অনুপযোগী। মানুষ ছিল বনচর জন্তুর মতো। তখন তাদের ভাষা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, নির্মাণকৌশল ইত্যাদি কোনো কিছুই ছিল না। গুহাবাসী মানব অনন্ত সাধনা ও অধ্যবসায়ের গুণে আজ সভ্যতার চরম শিখরে আরোহণ করেছে। যুগ যুগ ধরে মনীষীদের সাধনালব্ধ জ্ঞানের সমন্বয়ে আজ প্রকৃতি এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। যাত্রা করেছে মানুষ গ্রহ হতে গ্রহান্তরে। প্রাচীন বিবস্ত্র মানুষ বস্ত্রের আলোকে বানিয়ে নিয়েছে সভ্য জগত। যাযাবর ছেড়ে মানুষ আজ উন্নত জীবনের সর্বোচ্চ বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। এসবের সবই সম্ভব হয়ে অধ্যবসায় নামক শব্দের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সাধনায়।

ছাত্রজীবনে অধ্যবসায় :

“Students are the future of the country and the nation.”
অর্থ : ছাত্ররাই দেশ এবং জাতির ভবিষ্যৎ।

ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সর্বাধিক। ছাত্ররাই ভবিষ্যতের কর্ণধার। তাদের উপর নির্ভর করে দেশ এবং জাতির গৌরব। একজন ছাত্র একবার — দুবার নাও কৃতকার্য হতে পারে। এতে তার হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে— সৎশ্রম কখনো বৃথা যায় না। তাকে পূর্ণবার দ্বিগুন উৎসাহে অধ্যয়নে মনোনিবেশ করতে হবে। কেননা অধ্যবসায়ই পারে ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দিয়ে সাফল্যের পথ দেখাতে। এজন্য ছাত্রদের অবশ্যই অধ্যবসায়ী হওয়া উচিত। অধ্যবসায় ছাড়া ছাত্র জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছা কখনোই সম্ভব না। ধৈর্য করে কঠিন অধ্যবসায় করলে যে কোনো খারাপ ছাত্র কালক্রমে একজন ভাল ছাত্রতে বা মেধাবীতে পরিণত হতে পারে। একজন অধ্যবসায়ী ছাত্র অল্প মেধাসম্পন্ন হলেও সে সাফল্য পেতে পারে। পবিত্র হাদীসে বর্ণিত আছে,

“মানজাদ্দা ফাওয়াজাদা”

— অর্থাৎ যে চেষ্টা করে সেই পায়। ছাত্রজীবন হল জীবন গঠনের বীজ বপনের সময়। এই জীবন হল অধ্যবসায়ের জীবন।অধ্যবসায়ী ছাত্ররাই জীবনের গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত হয়। কারণ এ নিয়ে একটি ইংরেজি প্রবাদ আছে,

Practice makes a man perfect.

ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব : ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অত্যধিক। সব মানুষের শক্তি সমান নয়। কিন্তু সবাইকে উন্নত জীবনের সন্ধানে যেতে হয়। সেখানে যদি অধ্যবসায়ের যথার্থ প্রয়োগ করা যায় তবে শক্তির স্বল্পতা সাফল্যের পথে কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষই প্রতিভা নিয়ে জন্মলাভ করে।এক্ষেত্রে কারো প্রতিভা থাকে জাগ্রত কাহারো বা সুপ্ত। এই সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে প্রয়োজন সাধনা এবং কঠোর পরিশ্রমের। তাই শুধু প্রতিভা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। কেননা একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি জীবনযুদ্ধে পরাজীত হতে পারেন যদি না তিনি অধ্যবসায়ী হন। অধ্যবসায় মানব চরিত্রের এক উৎকৃষ্ট গুণ। মানবসভ্যতার সেই অস্ফুট মুহূর্ত হতে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল আজও তার শেষ হয়নি। এ সংগ্রামই মানুষের অভিজ্ঞানপত্র। জীবন যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে দরকার সাহস ও অধ্যবসায়ের। এ শক্তি মানুষের এক মহান চারিত্রিক লক্ষণ। দুর্বলচিত্র মানুষ কখনো অধ্যবসায়ী হতে পারে না। কারণে—অকারণে সামান্য প্রতিকূলে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। অধ্যবসায় ব্যক্তিজীবনে সফলতা এনে দেয়। ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য প্রয়োজন কাজের আগ্রহ, বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ এবং সুদূর সংকল্প। জীবনে কোনো কিছুই সহজলভ্য নয়। অধ্যবসায় ব্যক্তিজীবনের সকল আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে দেয়। তাই ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

ধর্মের মূল স্তম্ভে অধ্যবসায় : সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভই ধর্মের মূল উদ্দেশ্য। আর এই সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করতে প্রয়োজন অধ্যবসায়। অধ্যবসায় ছাড়া সৃষ্টিকর্তার সন্নিধ্য পাওয়া যায় না। নিচে বহু-প্রচলিত কিছু ধর্মের মূল স্তম্ভ ও অধ্যবসায়ের যোগসূত্র আলোচনা করা হলো।

হিন্দুধর্মে অধ্যবসায় : হিন্দু ধর্মে অধ্যবসায়ের গুণটিকে “ধৈর্য” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ধৈর্য হলো এমন একটি গুণ—যা আমাদেরকে কঠিন পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে ও আমাদের লক্ষ্যগুলি অর্জনে অবিচল থাকতে সাহায্য করে। হিন্দুধর্মের অনেকগুলি দেবতা এবং দেবীকে ধৈর্যের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়, যেমন দেবী দুর্গা।

খ্রিস্টধর্মে অধ্যবসায় : খ্রিস্ট ধর্মে অধ্যবসায়ের গুণটিকে “বিশ্বাস” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। বিশ্বাস হলো এমন একটি গুণ যা আমাদেরকে আমাদের অধ্যবসায় এর মাধ্যমে অর্জন করতে হয় এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও আমাদের লক্ষ্যগুলি অর্জনে আশাবাদী থাকতে সাহায্য করে। খ্রিস্টধর্মের অনেকগুলি পয়গম্বর এবং সাধুকে বিশ্বাসের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়, যেমন- যীশু খ্রিস্ট।

ইসলামে অধ্যবসায় : অধ্যবসায়ের গুণটিকে “ঈমান” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ঈমান হলো এমন একটি গুণ যা আমাদেরকে আমাদের আল্লাহ্ এর উপর বিশ্বাসে নির্ভর করে এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও আমাদের লক্ষ্যগুলি অর্জনে আশাবাদী থাকতে সাহায্য করে। ইসলামে নবী এবং সাহাবিকে ঈমানের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়, যেমন- মুহাম্মদ (সা.)।

বৌদ্ধধর্মে অধ্যবসায় : অধ্যবসায়ের গুণটিকে “ধ্যান” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ধ্যান হলো এমন একটি গুণ যা আমাদেরকে আমাদের মনকে শান্ত করতে এবং আমাদের লক্ষ্যগুলি অর্জনে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে। বৌদ্ধধর্মের অনেকগুলি শাস্ত্রে ধৈর্যের গুণের প্রশংসা করা হয়েছে।

এইগুলি হলো অধ্যবসায়ের গুণের মাত্র কয়েকটি উদাহরণ যা ধর্মের সমস্ত প্রধান শাখাগুলিতে পাওয়া যায়।

জাতীয় জীবনে অধ্যবসায় : জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কোনো জাতি যদি অধ্যবসায়ী হয়, তবে সে জাতি অবশ্যই মর্যাদার আসনে আরোহন করতে পারবে। যেমন: জাপান একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হয়েও পৃথিবীর একটি উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত, যা সম্ভব হয়েছে অধ্যবসায়ের দ্বারা। যে জাতি যত বেশি অধ্যবসায়ী, সে জাতি ততো বেশি উন্নত। জাতি সগৌরবে আরোহন করতে হলে সকল নাগরিককে সামগ্রিকভাবে অধ্যবসায়ী হতে হবে। সকলের একনিষ্ঠ সাধনার দ্বারা উন্নত জাতিতে পরিণত হতে পারবে এবং বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হতে পারবে। পৃথিবীর কোনো সভ্যতাই একদিনে কিংবা একক কোনো প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠেনি। বারবার চেষ্টা এবং সাধনা দিয়ে সম্ভাবনার ভিত্তি করতে হয়। সৃষ্টির প্রথম মানবগোষ্ঠীর সভ্যতাও স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে। কোনো একটি জাতি তখনই পৃথিবীর বুকে মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে সগৌরবে আত্নপ্রকাশ করতে পারবে যখন জাতীয় উন্নয়নে দল–মত নির্বিশেষে সবাই সর্বশক্তি দিয়ে নিজেদের আত্মনিয়োগ করবে। তাই জীবনে অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মনীষীদের জীবনে অধ্যবসায় : জগতে যারা মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার আদর্শ হয়েছেন ব্যক্তিজীবনে তারা সবাই অধ্যবসায়ী ছিলেন। মহাকবি ফেরদৌসীর অমর মহাকাব্য “শাহনামা” তার সুদীর্ঘ তিরিশ বছরের সাধনার প্রয়াস। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস বিশ বছরের একক প্রচেষ্টায় রচনা করেন বাংলা সাহিত্যে পঞ্চাশ হাজারের বেশি শব্দ সংবলিত বাংলা ভাষার অভিধান। আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই নিজের চেষ্টা ও সাধনার জন্য দরিদ্রতার সাথে লড়াই করে সংগ্রহ করেছিলেন দু'হাজার প্রাচীন পুঁথি। যার জন্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রায় চারশ বছরের ইতিহাস জানা যায়। মনীষী কার্লাইল অনেক বছরের শ্রমে ফরাসি বিপ্লবের অসামান্য ইতিহাস লিখেছিলেন। মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন নিজেই স্বীকার করেছেন বিজ্ঞানে তার অবদানের মূলে রয়েছে তার সাধনা। সেজন্য বলা যায় — সাধারন মানুষ অপেক্ষা মনীষীদের জীবন অত্যধিক ত্যাগ, পরিশ্রম, সাধনা এবং অধ্যবসায়ের। সেজন্যই সাধারন মানুষদের ভেতর থেকে তারা হয়েছিলেন অসাধারণ। যার মূলে রয়েছে তাদের অধ্যবসায়ের মূলমন্ত্র।

বিজ্ঞানে অধ্যবসায় : পৃথিবীর সবক্ষেত্রেই অধ্যবসায়ের গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে অধ্যবসায়ের উজ্জল দৃষ্টান্ত। অধ্যবসায়ের ফলেই বর্তমান বিশ্ব এতোটা মানব কল্যাণে পরিণত হয়েছে। বৈজ্ঞানিকদের অনেক পরিশ্রম, সাধনা ও অধ্যবসায়ের ফলেই তারা আবিষ্কার করতে পেরেছেন নতুন কিছু। তারা বছরের পর বছর ধরে সাধনার মাধ্যমে যেটুকু অর্জন করেছেন তার পুরোটা ঢেলে দিয়েছেন মানব সভ্যতার কল্যাণে। একটি অলস মস্তিষ্কের থেকে কিছু করা উত্তম মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েই হয়তোবা তারা এতোটা শ্রম ঢেলে দিতেন তাদের সাধনালব্ধের পেছেনে। সেজন্যই প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সহমত পোষণ করে বলেছিলেন,

“কোনো কাজ ধরে যে উত্তম সেইজন/
হউক সহস্র বিঘ্ন ছাড়ে না কখন।”

আর তাই কৌতুহলবশত কোনো কাজও অনেকসময় এমন এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয় যা অভাবনীয়। এজন্যই মানুষ আজ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে দূর করেছে অন্ধকার, বিমান আবিষ্কার করে দূর করেছে আকাশ জয়ের আকাঙ্ক্ষা, রকেটের সাহায্যে আয়েশ মিটিয়েছে চন্দ্র বিজয়ের গৌরব। হিসাব—নিরীক্ষার কাজের বশে কম্পিউটার আবিষ্কারের সাফল্য কিংবা ইন্টারনেটের প্রয়োজনীয়তা একবিংশ শতাব্দীতে আর বলার প্রয়োজনীয়তা রাখে না। এসকল সাফল্য আর আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিকদের যুগ–যুগান্তরের সাধনা আর অবিরাম অধ্যবসায়ের গল্প।

অধ্যবসায়হীন ব্যক্তির পরিণাম : যাদের জীবনে অধ্যবসায় নেই, তাদের জীবন ব্যর্থতায় পূর্ণ। যেকোনো কাজ প্রাথমিক অবস্থায় কঠিন মনে হয়। কিন্তু দৃঢ়সংকল্প নিয়ে কাজে অগ্রসর হলে হাজার বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। অধ্যবসায়হীন মানুষ জীবনে সাফল্য লাভ করতে পারে না। একসময় তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। একমাত্র অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করতে পারে।

অধ্যবসায় ও প্রতিভা : অসাধারন প্রতিভার অধিকারী না হলে বড় কাজ সাধন করা যায় না— এমন ধারণা পোষণ করা মোটেই উচিত নয়। কারণ অধ্যবসায় বা পরিশ্রম ছাড়া প্রতিভা কোনো কাজে আসে না। জগতে বহু লোক জন্মেছে যাদের বেশিরভাগ প্রতিভাবান অপেক্ষা অধ্যবসায়ী ছিলেন বেশি। এজন্য ভলতেয়ার বলেছেন— 

“প্রতিভা বলে আসলে কিছু নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও। তাহলে প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।”

মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন বলেছেন—
“আমার আবিষ্কারের কারণ প্রতিভা নয়, বহু বছরের চিন্তাশীলতা ও পরিশ্রমের ফলে দুরূহ তত্ত্বগুলোর রহস্য আমি ধরতে পেরেছি।”

বিখ্যাত বিজ্ঞানী জন ডাল্টন স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন —
“লোকে আমাকে প্রতিভাবান বলে, কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া কিছুই জানি না।”

আসলে বিধাতা প্রত্যেক মানুষকে সমান প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু বাস্তব জগতে কারো এই প্রতিভা থাকে জাগ্রত আবার কারো সুপ্ত অবস্থায়। যারা এই সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে পারেন পরবর্তী জীবনে তারাই হয়ে ওঠেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। পরিশ্রম ছাড়া কেউ কখনো সাফল্য লাভ করতে পারে না। এজন্য আমরা বলে থাকি—

Industry is the mother of good luck.

তাই বলা যায়— পরিশ্রমই হল মূল। পরিশ্রম ছাড়া সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে ওঠা অকল্পনীয়। অর্থ বল আর বিদ্যাই বল এগুলো অর্জন করতে পরিশ্রম প্রয়োজন। তাই প্রতিভার দিকে না তাকিয়ে আমাদের দৃঢ়তার সাথে পরিশ্রম করতে হবে। তবেই স্বীয় জীবন ধন্য এবং সার্থকতা পাবে।

অধ্যবসায়ের মূল্য : আমাদের প্রত্যেকের জীবনে অধ্যবসায়ের মূল্য অপরিসীম। ভারতীয় দর্শন মতে যদিও আমরা দুঃখবাদী এবং দুঃখে আমাদের জীবন গড়া তথাপি আমাদের মধ্যে অনেকে দুঃখ–দৈন্যের সাথে পাঞ্জা লড়ে। আমাদের বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ব–দ্বীপ হওয়ায় প্রতিবছর বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, বৃষ্টিপাত, ভূমি ধস এবং বন্যায় সমগ্র উপকূল সহ সারাদেশে ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তথাপি এখানকার মানুষ এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভীত না হয়ে এদের সাথে লড়াই করে জীবন অতিবাহিত করে। এসব সাহসীকতা এবং লড়াইয়ের মূলমন্ত্র তাদের জীবনের স্বীয় অভিজ্ঞতা এবং অধ্যবসায়ের মূলমন্ত্র। অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করা বাঙালী অধ্যবসায়ের বীজ জীবনে বপন করে পৃথিবীর বুকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

অধ্যবসায় জীবনের চিরায়ত সংগ্রামী শক্তি : কোনো কাজে অধ্যবসায়ী হওয়া মানে জীবন দিয়ে সংগ্রাম করা। জীবনের প্রতিটি কর্মে অধ্যবসায় ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনের পথরেখা আমাদের সামনে হাজির হবে।

অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাস : জগতে বড় হতে প্রতিভাবান হতে হবে এটা নিছক অমূলক একটি কথা। আত্মবিশ্বাসের সাথে সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে পরিশ্রমী ব্যক্তিই জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। উন্নত বিশ্বের প্রতিটি বড় বড় সাফল্যের পেছনে কাজ করে তাদের আত্মবিশ্বাস।

শৈশবে আইনস্টাইনকে দেখে তার শিক্ষকরা বলে দিয়েছিলেন তাকে দিয়ে কিছু হবে না। অথচ পরবর্তী জীবনে তিনি তার অসাধারন মেধা আর আত্মবিশ্বাসের জোরে কোয়ান্টাম তত্ত্বের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি তত্ত্ব দিয়ে পৃথিবী বুকে অমর হয়ে রয়ে গেলেন।

২৩ বছট বয়সে হিটলার সৈনিক হওয়ার ভিয়েনা একাডেমিরতে ভর্তি হতে গেলে তাকে ভর্তির অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অথচ পরবর্তী জীবনে তিনি ভীত না হয়ে আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়ে অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা হয়েছিলেন।

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী ব্যক্তি ও মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস যখন কলেজ থেকে ড্রপ আউট হয়েছিলেন তখন শিক্ষকরা ভেবেছিল ছেলেটা গোল্লায় গেল। অথচ তিনি আজ পৃথিবীর অন্যতম একজন ধনী হতে পেরেছেন তার স্বীয় আত্মবিশ্বাসের বলয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে।

এজন্যই হয়তোবা ইউলিয়ন হ্যাজলিট বলেছেন —

If you think you can win, you can win. Faith is necessary to victory.

অধ্যবসায়ই উন্নতির মূলমন্ত্র : সৃষ্টির আদি লগ্নে মানুষ ছিল অসহায়। পদে পদে তারা বিপদগ্রস্ত ছিল। কিন্তু এসব বাধা বিপত্তি ও বিপদকে তারা ভয় না পেয়ে, হতোদ্যম না হয়ে, বরং অবিচল ধৈর্য, একনিষ্ঠ চেষ্টা ও অপরিসীম শ্রমের মাধ্যমে এসব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে। অর্থাৎ জীবনে চলার পথে বাধা আসবেই। সুতরাং এতে ভয় না পেয়ে তা উতরে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। জীবনে অসাধ্য বলে কিচ্ছু নেই। ধৈর্য ও সাহস নিয়ে মানুষকে জীবনের ঘাত–প্রতিঘাতময় পথ অতিক্রম করতে হয়। দুঃখ দৈন্যের সাথে লড়াই না করে এবং বিপদকে মোকাবিলা না করে জীবনে সাফল্য অর্জিত হয় না। এজন্যই বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন —


তাই জীবনে সফল হতে হলে অবশ্যই অধ্যবসায়ী হতে হবে। তবেই বিশ্ব খুঁজে পাবে সার্থক দেশ, দেশ পাবে সার্থক জাতি, সমাজ পাবে সার্থক নাগরিক। সমগ্র মানবতা খুঁজে পাবে অগ্রগতির পথ।

সংগ্রামের লক্ষ্য জীবনের সাফল্য : প্রতিটি মানুষের জীবনে নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা উচিত। শুধু লক্ষ্য থাকলেই হবে না, তাকে ধরে নিতে হবে জীবনের লক্ষ্যে পৌছানো মানে সংগ্রামের সাগর পাড়ি দিয়ে কূল খুঁজে পাওয়া। তাই জীবনের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে হবে।

অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্ত : সাফল্যের মুকুট পরে আজ যারা পৃথিবীর বুকে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের মূলে ছিল অধ্যবসায়। ধৈর্যশীল এবং পরিশ্রমী ব্যক্তিরাই মানব জীবনকে সার্থক করতে পেরেছিলেন। তাদের ভেতর অন্যতম ও খ্যাতনামা কয়েকজন হলে—

(১) হযরত মুহম্মদ (সঃ) : মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহম্মদ (সঃ) পৃথিবীতে শান্তি ও সাম্যের বাণী প্রচারে অগ্রসর হলে তাকে সত্যবাদী (তথা আল আমিন) বলা আরবের লোকেরা এর বিরোধিতা শুরু করেছিলেন। তাকে হাজার রকমের দুঃখ–কষ্ট অমানবিক অত্যাচার করা এবং সর্বশেষে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হন নি। বরং সকল রকমের বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে স্বীয় পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাস তথা অধ্যবসায়ের বলয়ে তিনি সমগ্র মানবমন জয় করে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলাম নামক শান্তির জীবন ব্যবস্থা।

(২) গৌতম বুদ্ধ : রাজার দুলাল গৌতম বুদ্ধও একদিন জীবনে সত্যের সন্ধানে বের হন তার বিলাসবহুল রাজপ্রসাদ ছেড়ে পথের ধুলায়। সেদিও কি কপিলা বস্তুর রাজপুরীতে কম ঝড় উঠেছিল? কে জানতো এই দুলালই একদিন বিশ্বের বৃহত্তম একটি ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক হবেন। এই ত্যাগ আর তিতিক্ষার পেছনে অধ্যবসায়ের অবদান হয়তো কলমের কালিতে লিখে শেষ করা সম্ভব নয়।

(৩) স্যার আইজ্যাক নিউটন : বিজ্ঞানী নিউটন দীর্ঘ ১২ বছর ধরে সাধনা আর পরিশ্রমের বিনিময়ে যে গবেষণা কাজ করেছিলেন তা তার পোষা কুকুরের কারণে মোমবাতির আগুনে পুড়ে গেলে তিনি বিচলিত না হয়ে পুনরায় দ্বিগুণ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তা আবার লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

(৪) কলম্বাস : অধ্যবসায়ের এক মূর্তমান প্রতীক হলেন আমেরিকার আবিস্কারক কলম্বাস। তিনি অনেক বাধা–বিপত্তি অতিক্রম করে এবং তার সহযাত্রীদের নানা রকম হতাশা, চক্রান্তের মধ্যে দুঃসাহসিক নেতৃত্ব দিয়ে তিনি স্পেন থেকে সাগর পথে আমেরিকা পৌছেছিলেন। অতঃপর তিনি পর্তুগীজ রাজসভায় তার আমেরিকা আবিষ্কারের কথা বললে সে দেশের রাজা তা হাসিতেই উড়ে দিলে তিনি আবারও মাত্র কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে আবারো আমেরিকা জয় করেছিলেন।

(৫) তেনজিং ও হিলারি : পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পর্বত হলো মাউন্ট এভারেস্ট তথা হিমালয় পর্বত। যার শীর্ষ চূড়ায় মানুষের পদধূলি দেওয়া কল্পনাতীত ছিল। কিন্তু অদম্য কৌতূহলী মানুষ হিমালয় জয়ের নেশায় বারবার সেখানে ছুটে গিয়েছেন। তথাপি অনেক প্রাণের মৃত্যু আর প্রতি পদে পদে মৃত্যুর বিভীষিকাময় গল্পের ফাঁদ থাকা সত্ত্বেও নেপালের তেনজিং নেরগো এবং তার শেরপা নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারি হিমালয়ের চূড়ায় পৌছেছিলেন তাদের অদম্য সাহসিকতা এবং অধ্যবসায়ের মন্ত্রে।

(৬) নেপোলিয়ন : সম্রাট নেপোলিয়ন অত্যন্ত দরিদ্র ঘরে জন্মে ছিলেন বটে কিন্তু কখনো পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের হাল ছাড়েননি। তার অধ্যবসায় তাকে ফরাসি জাতির ভাগ্যবিধাতা হিসেবে নির্বাচন করেছে। এজন্য তিনি স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে বারবার একটি বাণীই বলতেন, " অসম্ভব বলে কিছু নেই এটি কেবল বোকারাই বলে থাকে।"

(৭) রবার্ট ব্রুস : স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস অধ্যবসায়ের আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তিনি ইংরেজদের সাথে ছয় বার যুদ্ধ করে পরাজিত হন। একবার তিনি এক গুহায় আত্নগোপনে গেলেন এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছিলেন। হঠাৎ সেখানে একটি মাকড়সা তার দৃষ্টিগোচর হল। যেটি তার তৈরি জাল বেড়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করতেছিল। কিন্তু মাকড়সাটি উপরে উঠতে পারছিলো না। এভাবে ১৬ বার ব্যর্থ হওয়ার পর মাকড়সাটি ১৭ তম বারে উপরে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। আর তখন তিনি এই ক্ষুদ্র প্রাণী থেকে অধ্যবসায়ের শিক্ষা লাভ করে নতুন উদ্যমে সৈন্য যোগাড় করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং সপ্তম বারে তিনি জয়লাভ করেছিলেন।

(৮) অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ : এসব ছাড়াও অন্যান্য মনীষীদের জীবনের ওপর দিয়ে কত কালবৈশাখীর ঝড় গেছে তা অকল্পনীয়। তারা জীবনে কত অপমান, লাঞ্ছনা সয়েছেন। চরম ত্যাগ ও ধৈর্যের মাধ্যমে তাদের অর্জিত সাধনালব্ধ নামক অমৃতের পাত্র তুলে দিয়েছেন মানুষের হাতে। নিজেরা পান করেছেন জীবন মন্থনের গরল সুধা। সেইসব নীলকন্ঠ মহামানবের পূর্ণষ্পর্শে সাধারন মানুষের জীবন ধন্য হয়েছে। করুণা–সাগর ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনে সফলতা লাভ করতে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা সহ্য করেন। এছাড়া সাহিত্য –বিজ্ঞান সাধনায় মানুষের অধ্যবসায়ের শেষ নেই। ম্যাস্কিম গোর্কি, দস্তয়েভস্কি'র কি জীবনে কম দুঃখ কষ্ট এসেছিল? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কি কম নিন্দা–সমালোচনার বাক্যবাণে জর্জরিত হয়েছিলেন!চরম দারিদ্র্য, হতাশার মধ্যেও কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পাওয়া কবি নজরুল কি জীবনে কম আঘাত পেয়েছেন। তবুও তারা আমাদের জন্য অনেক সুন্দরের সাহিত্য আরাধনা করে গেছেন। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ কিংবা জ্যাক মা'রা কি জীবনকে এতোটা সহজ করে পেয়েছিলেন!সর্বযুগের সেরা বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের সবক্ষেত্রেই যার কোনো না কোনো ছোঁয়া রয়েছে সেই মহান বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা কি খুব সুন্দর করে আরাম আয়েশে জীবন অতিবাহিত করতে পেরেছেন!এমনই কত বিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিককে বারবার অধ্যবসায়ের অগ্নিপরিক্ষা দিতে হয়েছে। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও, মাইকেল ফ্যারাডে, লুই পাস্তুর, পিয়েরে কুরি, মাদাম কুরি, রাদারফোর্ড কিংবা নীলস বোর জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছেন। মাইকেল এঞ্জেলা কিংবা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো শিল্পীর জীবনে হয়েছে অনেক সমালোচনা।

উপসংহার : কথায় আছে— A man's best friend is his ten fingers. তাইতো অধ্যবসায়ই বিশ্বের সব তোরণ খুলে দেয়। সেজন্য অধ্যবসায়কে আমাদের সকলকে আঁকড়ে ধরা উচিত। কেননা অধ্যবসায়ের গুণেই ছেঁড়া ন্যাকড়ার পৃথিবী আজ সোনার পুতুল। অধ্যবসায়ের জাদুতে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করারই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। অধ্যবসায়ের জন্য চাই আত্মবিশ্বাস ও সুদৃঢ় মনোবল। পরিশেষে আমাদের সকলের মন্ত্র হওয়া উচিত —

“ভেঙে যাবে বাঁধন
ভাঙবে না তবু প্রত্যয় সাধন

ভাঙবে না কভু সৃজন মনন।
ধিক! শত প্রলশ মহা প্রলয়

দীপ্ত বাহুতে উড়াও আজি
আত্মার মহাবিজয়।”

Download PDF


25 Comments

  1. ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে কথা শেষ।

    ReplyDelete
  2. very nice..... keep it up.

    ReplyDelete
  3. I love it.🥰😘😍

    ReplyDelete
  4. অসংখ্য ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  5. Thanks a lot 😊🌼

    ReplyDelete
  6. bai ata pdf namano jabe kibabe

    ReplyDelete
  7. thank you 🫰💝 -!!!

    ReplyDelete
  8. This one is the best I've read still in my life time I don't wanna give a million of thanks to the author hope he or she do more Better in future

    ReplyDelete
  9. এক কথায় দারুণ হয়েছে

    ReplyDelete
  10. Anonymous vai or apu to ei page er best fan hoea geche onake Nobel dite Hobe best follower er jonno...🤣😂

    ReplyDelete
  11. "অধ্যবসায়" এমন একটি গুণ যা মানুষকে জীবনের প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে মানুষ তার লক্ষ্যে অবিচল থেকে কঠোর পরিশ্রম ও মনোবল দিয়ে যেকোনো বাধাকে পরাস্ত করতে পারে। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তির নিজস্ব উন্নতির জন্য নয়, সমাজ ও দেশের উন্নতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যবসায়ই মানুষকে তার পরিশ্রমের ফল স্বরূপ সাফল্য এনে দেয়।

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post