ভূমিকা : অপসংস্কৃতি সংস্কৃতির নেতিবাচক রূপ। সংস্কৃতি হলো একটি জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য। এটি সম্পূর্ণ মানবীয় একটি ব্যাপার। ব্যক্তির মানবীয় গুণাবলি ও জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে নিজ পরিবেশ ও সমাজকে সুরুচিসম্পন্ন, সমৃদ্ধ ও উন্নত করার যে প্রচেষ্টা তার মধ্যেই সুপ্ত থাকে সংস্কৃতির চেতনা। যে সংস্কৃতি মানুষের সুরুচি, বিবেক, স্বাভাবিক জীবনবোধ ও সুষ্ঠু মানস বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তারই অপর নাম অপসংস্কৃতি? সমাজে অপসংস্কৃতির প্রভাব মারাত্মক ও অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষ করে যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম নিয়ামক হলো অপসংস্কৃতি।
সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি : মানুষের সকল চিন্তা, কর্ম ও সৃষ্টিই তার নিজস্ব সংস্কৃতির বাহন। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সমাজজীবনে সংস্কৃতি হিসেবে বিকশিত হয়। কোনো সমাজ যখন ঐক্যবদ্ধভাবে একটি রাষ্ট্র গঠন করে তখন সেই জাতি ও তার সংস্কৃতি সেই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। আর তার প্রকাশ ঘটে দৈনন্দিন রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, শিক্ষা-সাহিত্য শিল্প প্রভৃতিতে। ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরেবেশ, ধর্মীয় বিধি-বিধান, নৈতিক অনুশাসন, অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা, দর্শন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এক একটি সংস্কৃতি। একটি জাতির প্রাণশক্তি নিহিত থাকে তার সংস্কৃতিতে। প্রত্যেক সংস্কৃতিরই রয়েছে নিজের মতো করে বিকশিত হওয়ার অধিকার। এক দেশ থেকে অন্য দেশে সংস্কৃতির আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও প্রভাবিত হয়। তবে দেশভেদে ও জাতিভেদে সংস্কৃতির উপাদান ভিন্ন ভিন্ন। যেমন পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি আর বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তাই বলে বিদেশি সংস্কৃতি মানেই অপসংস্কৃতি তা নয়। যে সংস্কৃতি মানুষের চিন্তা চেতনাবোধকে কলুষিত করে, মূল্যবোধের অবক্ষয় ডেকে আনে, নৈতিকতা বিনষ্ট হয় তাই অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি সংস্কৃতিরই বিকৃত রূপ।
বাঙালি সংস্কৃতি : বাঙালি সংস্কৃতির রয়েছে সুপ্রাচীনকালের ঐতিহ্য। গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে নানা রূপ- রূপান্তরের মাধ্যমে তা বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। প্রাচীন সাংলার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল বাংলার পরিবেশ, প্রকৃতি, ও সমাজ জীবনকে ঘিরে। এর মধ্যে যোগ হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাব। দ্রাবিড়-অস্ট্রিক প্রভৃতি জাতির মেলবন্ধনও ঘটেছিল বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতিতে। মধ্যযুগে এতে যোগ হলো ইসলামী সংস্কৃতি, বিশেষ করে সুফিতত্ত্বের ভাবধারা। প্রাচীন ও মধ্যযুগের পর বাঙালি সংস্কৃতির বর্তমান রূপ খানিকটা পাশ্চাত্যের প্রভাবে প্রভাবিত।
বাঙালি সংস্কৃতিতে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন : ড. আহমদ শরীফ তাঁর ‘বাঙ্গালীর সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে বলেছেন,
‘চলনে বলনে, মনে-মেজাজে, কথায়-কাজে, ভাবে-ভাবনায়, আচার-আচরণে অনবরত সুন্দরের অনুশীলন ও অভিব্যক্তি থেকে সংস্কৃতিবানতা।’
কিন্তু বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে অসুন্দর। ঊনিশ শতকের শুরু থেকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কুপ্রভাব বাঙালি সংস্কৃতির উপর পড়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতি পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি বাঙালি সংস্কৃতিকে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভালো দিক গ্রহণ করে অশুভকে পরিত্যাগ করার প্রজ্ঞায় উজ্জীবিত হয়েছিল বাঙালি। এ শুভ দিকটি বাঙালি সংস্কৃতিকে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভালো দিক গ্রহণ করে অশুভকে পরিত্যাগ করার প্রজ্ঞায় উজ্জীবিত হয়েছিল বাঙালি। এ শুভ দিকটি বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছিল। কিন্তু এদেশের কিছু অসৎ মানুষের চেষ্টায় পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি বাংলার চিরায়ত, কোমল সংস্কৃতিকে গ্রাস করছে। বিদেশি জীবনযাপন চর্চা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ অনুকরণ এখন বাঙালির কাছে আভিজাত্য প্রকাশের মাপকাঠি। সমাজজীবন থেকে সুস্থ বিবেকবোধ আর সততা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। আর বিনোদন মানে তো উৎকট সংগীত, উদ্দাম নৃত্য, রুচিহীন চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের কাহিনিগুলো হিংস্রতা, শঠতা আর পৈশাচিকতায় ভরা। উগ্র ভোগবিলাসী জীবনধারা, কুৎসিত সংলাপ আর স্থূল হাস্যরসে ভরপুর এসব চলচ্চিত্রে স্বাভাবিক জীবনবোধ একেবারেই অনুপস্থিত। আকাশ সংস্কৃতির এ অসুস্থ অনুপ্রবেশে চলছে বিনোদনের বাণিজ্যিকীকরণ। জীবন থেকে সুন্দর আর শুভবোধ যেন ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আর এ হীন মনোবৃত্তির পেছনে কাজ করছে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী শোষকশ্রেণি। বাংলাদেশের লোভী পুঁজিপতিদের সাথে রয়েছে এদের নিবিড় যোগাযোগ। সুকৌশলে এরা সুস্থ সংস্কৃতির উপর আঘাত হানতে চায়। সততা, ন্যায় আর সুন্দরের উপর অসত্য, অন্যায় আর অসুন্দরকে বাস্তবতা বলে মেনে নেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। কেননা সততা, মহত্ত্ব আর বিবেকবোধ গেলে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের সুযোগ আরও ত্বরান্বিত হবে।
অপসংস্কৃতি ও যুবসমাজ : অপসংস্কৃতি তারুণ্যের সুন্দর বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবক্ষয়, স্থূলতা আর মাদক নেশার করাল গ্রাসে নিমজ্জমান তারুণ্য অনিশ্চিত ভবিষ্যতেরই প্রতিচ্ছবি। পাশ্চাত্যের উদ্ভট পোশাক-আশাকে প্রলুব্ধ তরুণ সমাজ কথাবার্তায়, আচার-আচরণেও হারাতে বসেছে বাঙালি ঐতিহ্য। পাশ্চাত্যের ভোগবিলাসী জীবনধারায় তারা অন্ধভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতেও লেগেছে অপসংস্কৃতির হাওয়া। বিকৃত বাংলায় উপস্থাপনা, ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার, উদ্ভট পোশাক-পরিচ্ছদ - বাঙালি সংস্কৃতিকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাচ্ছে। স্বকীয়তা, মূল্যবোধ আর বিবেক বিসর্জন দিয়ে অপসংস্কৃতির এ বিলাসী স্রোহে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে আজকের তরুণ সমাজ। যে বাঙালি তরুণ সমাজের বীরগাঁথা ইতিহাস রয়েছে সেই তরুণ সমাজই আজ অনৈতিকতার অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে।
উপসংহার : ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন – ইতিহাসের সব প্রেক্ষাপটেই রয়েছে বাঙালির আত্মত্যাগ, বীরত্বগাথা ও যুবসমাজের অবদান। আর এ ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি। এর উপর অপসংস্কৃতির বিরূপ আগ্রাসন মানেই বাঙালি ঐতিহ্যকে পঙ্গু করে দেওয়া, সমূলে বিনষ্ট করা। তাই এর হাত থেকে তরুণ প্রজন্ম ও সমগ্র জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব সকল বাঙালির। বিশ্বের তাবৎ সংস্কৃতির ভালো দিক গ্রহণ ও মন্দ দিক বর্জন করেই আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। সংস্কৃতিবান জাতি হিসেবে অবশ্যই আমাদের সকলের লক্ষ্য হওয়া উচিত অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।