↬ কোভিড-১৯
↬ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের থাবা
ভূমিকা : করোনা মহামারির ভয়াল থাবা দিন দিন সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করছে। এর
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন অঞ্চল। সম্প্রতি
WHO এক অধিবেশনে করোনাভাইরাসকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে
আখ্যায়িত করেছে।
করোনাভাইরাস কী? : করোনা শব্দের অর্থ 'পুষ্পমাল্য' বা 'পুষ্পমুকুট'।
ইলেকট্রনিকস অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটির আবরণে বিদ্যমান প্রোটিনের কাঁটাগুলোর
কারণে এটি দেখতে অনেকটা মুকুটের মতোই দেখায়। এটি একটি RNA ভাইরাস,যার সারা গায়ে
অসংখ্য প্রোটিন সমৃদ্ধ স্পাইক আছে। ভাইরাসটি মানবদেহে প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৬০ এর
দশকে,যা SARS ও MARS ভাইরাসের সমগোত্রীয়।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে অজ্ঞাত কারণে নিউমোনিয়ার মতো
রোগ ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়। এরপর ১১ জানুয়ারি ২০২০ প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।
বিশ্ব সংস্থা (WHO) দাবি করে, এ ভাইরাস মানুষের দেহে আসার আগে কোনো প্রানীর দেহে
অবস্থান করছিল। হয়তো ভাইরাসটি বাদুড় এর মাধ্যমে মানুষে সংক্রমিত হয়েছে। গবেষকরা
বলেন মানবদেহের বাইরে এ ভাইরাসটি খুব অল্পসময় বেঁচে থাকতে পারে। বর্তমান বিশ্বে
ভাইরাসটি এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যা অকল্পনীয়।
COVID- 19 নামকরন : ৭ জানুয়ারি ২০২০ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) চীনের
উহানে প্রাপ্ত SARS ও MERS পরিবারের সদস্য করোনাভাইরাসের সপ্তম প্রজাতির নামকরন
করে 2018 Novel coronavirus (2019-nCOV)। এরপর ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২০ WHO
ককরোনাভাইরাসের সংক্রমনে ফ্লু'র মতো উপসর্গ নিয়ে যে রোগ হয়,তার নামকরণ করে
COVID-19। এ নামের CO দিয়ে Corona, VI দিয়ে Virus ও D দিয়ে
Disease (রোগ) বোঝানো হয়। আর ভাইরাস ছড়ানোর সময় হিসেবে ২০১৯ সালকে চিহ্নিত
করার জন্য ব্যবহার করা হয় 19।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি : বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২২১টি দেশ ও অঞ্চলে পৌঁছে
গেছে করোনাভাইরাস। মে ২০২১ পর্যন্ত বিশ্বে করোনাভাইরাস মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৬
কোটির অধিক, আর মৃত্যু ৩৩ লাখের উপরে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সকল দেশ। সবচেয়ে
ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র, দেশটির নাগরিকদের ৫২ শতাংশের অধিককে ভ্যাকসিনের
আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর আক্রান্তের তালিকায় দ্বিতীয় ও
তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারত এবং ব্রাজিল।
বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি :
Institute of Epidemiology Disease Control and Research (IERDCR)-এর
তথ্যমতে,বাংলাদেশে ৮ মার্চ ২০২০ প্রথম তিনজব করোনা রোগী শনাক্ত হয় যাদের মধ্যে
দুইজন ইতালি ফেরত এবং একজন তাদের আত্নীয়। এরপর ১৮ মার্চ ২০২১ করোনাভাইরাসে
আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর
প্রথম দিকে এর সংক্রমণের হার কম ছিল। জুলাই মাসে সেটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে
পৌঁছায়। এ সময় ২ জুলাই সর্বোচ্চ ৪,০১৯ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর আগস্ট
মাসের পর থেকে শনাক্ত আর মৃত্যুর হার কমে আসে। আবার মার্চ ২০২১ থেকে করোনার
দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। ১৬ এপ্রলি করোনায় একদিনে মৃত্যু একশো অতিক্রম করে। এ সময়
দক্ষিন আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। এ ভ্যারিয়েন্ট
দ্রুত ছড়ানোর প্রভাব ও অনেকের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতায় দেশে
করোনাভাইরাসের সংক্রমন ও মৃত্যু দুটোয় বেড়ে যায়। একই সময় পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে নাজুক পরিস্থিতির বিচার করে। সরকার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে জনগণকে
বাঁচাতে ৫ এপ্রিল ২০২১ সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানা
সাপেক্ষে শিল্প প্রতিষ্ঠান এ লকডাউনের আওতামুক্ত থাকে,যা দেশের অর্থনীতির চাকা
সচল রাখতে সহায়তা করে। বাংলাদেশে মে ২০২১ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ রোগী শনাক্ত হয় এবং
মৃত্যুবরন করে ১২ হাজারের মতো।
করোনা ভ্যাকসিন কার্যক্রম : এর মধ্যে বিশ্বে কয়েকটা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়
এবং বাংলাদেশেও এ ভ্যাকসিন কার্যক্রম হাতে নেয়। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান
কর্মসূচি উদ্বোধন করা হয় ২৭ জানুয়ারি ২০২১। আর ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১ বাংলাদেশ
বিশ্বের ৫৪তম দেশ হিসেবে করোনার গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করে। বাংলাদেশে
করোনা প্রতিরোধে যে টিকা দেওয়া হয় তা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি
ভ্যাকসিন 'কোভিশিল্ড'। এ ভ্যাকসিন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছে বিশ্বের বৃহত্তম
টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। এছাড়া রাশিয়ার তৈরি
স্পুটনিক -ডি এবং চীনের তৈরি সিনোফার্মের টিকাও এ টিকাদান কার্যক্রম সর্বোচ্চ
অগ্রাধিকার পায়।
করোনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি : কোভিড-১৯ এ বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। বড়
অর্থনীতি দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র চীন ছাড়া ধনী-গরিবসব দেশই অঅর্থনৈতিক সংকটে
পড়েছে। বাংলাদেশের করোনা মহামারিতে অনেকের আয় কমেছে,অনেকে কর্মহীন হয়ে
পড়েছে,ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। আবার অন্যদিকে প্রবাসী আয়ে রেকর্ড গড়ছে। ফলে দেশের
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্প,স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সেবা, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে
ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাব বিরাজমান।
করোনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি : ২০২০-২১ অর্থবছর ৮.২% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য
নির্ধারণ করেছে সরকার। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ-এর পরিস্থিতি বিবেচনা করে দাতা
দেশগুলোর জানায় এই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে
সংকটকালীন সময়েও ৫.২৪% প্রবৃদ্ধি কিন্তু কম নয়। এছাড়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কতটা
গভীর হয় এর উপর নির্ভর করছে প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টা। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে
দু'ভাগে ভাগ করা যায়। একটি কৃষি খাত অন্যটি অকৃষি খাত। কৃষি খাতকে বলা হয়
ভিত্তি কাঠামো এবং অকৃষি খাতকে বলা হয় উপরি কাঠামো। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা
২০২০ অনুযায়ী জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৩.৩৫%,শিল্পখাতে ৩৫.৩৬% এবং সেবাখাতে
৫১.৩০%। এই করোনাকালেও ২০২১সালের জুন মাসের মধ্যে আমাদের অর্থনীতি
৬০%,সেপ্টেম্বর মাসে ৭০% এবং ডিসেম্বর মাসে গিয়ে ৮৫-৯০% সক্রিয় হবে বলে আশা করা
যায়।
সামাজিক সম্পদ : আমাদের দেশে দুটি বড় সামাজিক সম্পদ আছে। এর একটি হচ্ছে
মানুষ, যারা করোনাকে ভয় পেয়ে ভীত হয়ে যায়নি,সবকিছু বন্ধ করে দেয়নি। বরং শত
প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের কর্মচাঞ্চল্য অব্যাহত ছিল। এর দ্বিতীয়টি হচ্ছে এখানে
মানুষ প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে কুন্ঠাবোধ করে না। ভারতের যেমন প্রধান সমস্যা হচ্ছে
মদ্যপান এবং খরচ না করা; আমাদের দেশে তা নেই। তাই এ দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা
হবেই।
করোনায় মানুষের জীবন না অর্থনীতি : একটি দেশের অর্থনীতি কেমন হবে সেটি
কেবল অর্থনৈতিক সূচক নয়,আর্থিক কাঠামো,আয় কাঠামো,সম্পত্তি কাঠামো,পরিবার
কাঠামো,জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য, মানুষের আচরণ এবং পেশার ওপর নির্ভর করে।
যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ মারা যাচ্চে,তবু সে দেশের কিছু কিছু অর্থনৈতিক ককর্মকান্ড
চালু রাখা হয়েছে। আমজনতার অর্থনীতিকে বুঝতে হবে। মানুষের জীবন বা
অঅর্থনীতি কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত? - এ প্রশ্নটি অনেক আগে থেকেই
ছিল। এর একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই জীবনও চলবে জীবিকাও
অর্জন করতে হবে।
অর্থনৈতিক শক্তি : বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি ভোক্তা। দেশের
অঅর্থনীতিতে ভোক্তা ব্যয় হচ্ছে ৬৯%,যাত মধ্যে অন্তত ৫০% সচল রয়েছে। শহরে
বসবাসরত ২০-২৫% মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে তাদের কেনাকাটা কিছুটা
কমিয়ে হলেও অব্যাহত রেখেছে। গ্রাম এলাকার মানুষ আর রোজগার কমে যাওয়ার কারণে
হয়তো আগের মতো ক্রয় করছে না। কিন্তু একেবারে বন্ধও করেনি।
তৈরি পোশাক শিল্পে করোনার প্রভাব : বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড়
উৎস তৈরি পোশাক শিল্প। ধারণা করা হয়েছিল যে করোনা মহামারির কারণে পোশাক শিল্পে
বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। তারপরও এ শিল্প প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০ অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর এ খাত থেকে আয়
হয়েছে ৩৩,৬৭৪.২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের ১৬.৯৩% কম।
রেমিট্যান্সে উল্লস্ফন : করোনাকালীন বিশ্ব যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে হোঁচট
খাচ্চে,ঠিক সেই সময়ই বাংলাদেশের রেমিট্যান্সে নতুন নতুন রেকর্ড যোগ হয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে তিন মাসে ৭৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে যা
গত বছরের পুরো সময়ের অর্ধেক। যদিও এর মধ্যে ৮-৯ লাখ লোক করোনায় কর্মহীন হয়ে
দেশে ফিরেছে। বাংলাদেশের এক কোটি পরিবার প্রত্যক্ষভাবে রেমিট্যান্স আওতায়
রয়েছে। যা তাদের পরিবারকে আর্থিক নিরাপত্তা দিচ্ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার
রিজার্ভ বেড়ে বর্তমানে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নতি হয়েছে।
দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা : শুধু বাংলাদেশেই নয়,বড় ধরনের
অঅর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে সারাবিশ্ব। করোনার কারণে দেশে দেশে এ সংকট তীব্র
হচ্ছে,ধনী-গরিব সকল দেশেই এ প্রভাব পড়ছে। বেশির ভাগ দেশের মোট দেশজ উৎপাদন
(GDP) সংকোচন হবে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এর পূর্বাভাস দিয়েছে। পাওয়ার
অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (PPRC) ও ব্র্যাক এক জরিপের ফল প্রকাশে
করে জানায়,বাংলাদেশে করোনায় ২কোটি ৫০লাখ লোক বেকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
নতুনভাবে দারিদ্র্যের হার জনসংখ্যার ১৪.৭৫% হয়েছে এবং তারা বলেছে ৪% চরম
দারিদ্র্যের বেড়েছে এবং আয় কমেছে ১১% মানুষের। তবে সরকারের বিভিন্ন ধরনের
কর্মসূচির জন্যে মানুষ কোনো মতে জীবন নির্বাহ করতে পারছে। যেমন বর্তমান সরকার
৯১ লাখ লোককে সামাজিক বিভিন্ন সুবিধার আওতায় নিয়ে এসেছে। যার জন্য দারিদ্র্যের
হার বাড়লেও মানুষ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির সুবিধা কিছুটা হলেও ভোগ করছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়,বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। চাহিদা
থাকলে যোগান থাকবেই। একজন লোক অসুস্থ হলে তার অবস্থা যা হয়,তেমনি অর্থনীতি যদি
অসুখে পড়ে তার আকারও ছোট হয়,প্রবৃদ্ধি কমে যায় এটাই স্বাভাবিক। তবে সময়ের
ব্যবধানে তা আগের অবস্থানে ফিরে যাবে।
আরো দেখুন :