দ্বিরুক্ত শব্দ বা শব্দদ্বিত্ব
দ্বিরুক্ত অর্থ দুবার উক্ত হয়েছে এমন। বাংলা ভাষায় কোনো কোনো শব্দ, পদ বা অনুকার শব্দ, একবার ব্যবহার করলে যে অর্থ প্রকাশ করে, সেগুলো দুবার ব্যবহার করলে অন্যকোনো সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে। এ ধরনের শব্দের পরপর দুবার প্রয়োগেই দ্বিরুক্ত শব্দ গঠিত হয়। যেমন—
আমার জ্বর জ্বর লাগছে।
(এর অর্থ: ঠিক জ্বর নয়, জ্বরের ভাব এই অর্থে প্রয়োগ।)
সংজ্ঞা : একই শব্দ বা সমার্থক শব্দ পরপর দুবার ব্যবহৃত হয়ে অর্থগত বৈচিত্র্যের সম্পাদন করলে, ওয় শব্দদ্বয়কে বলা হয়ে থাকে দ্বিরুক্ত শব্দ। যেমন—
আমার শীত শীত লাগছে।
(এর অর্থ: ঠিক শীত নয়, শীতের ভাব এই অর্থে প্রয়োগ।)
এসব ছাড়াও— ভরা ভরা, ভিজে ভিজে, ভাসা ভাসা, হাসি হাসি, কাঁদো কাঁদো, যাব যাব ইত্যাদি অনেক দ্বিরুক্ত শব্দ বাংলা ভাষায় রয়েছে।
দ্বিরুক্ত শব্দ শব্দের প্রকারভেদ : দ্বিরুক্ত শব্দ ৩ প্রকার। যথা—
(১) শব্দের দ্বিরুক্তি বা শব্দদ্বৈত
(২) পদের দ্বিরুক্তি বা পদদ্বৈত
(৩) ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি।
(১) শব্দের দ্বিরুক্তি বা শব্দদ্বৈত : একই শব্দ পরপর দুইবার ব্যবহৃত হয়ে বিশিষ্ট অর্থ প্রকাশ করলে তাকে শব্দের দ্বিরুক্তি বা শব্দদ্বৈত বলে। শব্দের দ্বিরুক্তি বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন—
১. একই শব্দ পরপর দুবার ব্যবহার করা হয় এবং শব্দ দুটি অবিকৃত থাকে। যেমন— ভালো ভালো ফল; ফোঁটা ফোঁটা পানি; বড় বড় বই।
২. একই শব্দের সাথে সমার্থক আর একটি শব্দ যোগ করে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন— ধন—দৌলত, খেলা—ধুলা, লালন—পালন, বলা—কওয়া, খোঁজ—খবর ইত্যাদি ।
৩. দ্বিরুক্ত শব্দ—জোড়ার দ্বিতীয় শব্দটির আংশিক পরিবর্তন হয়। যেমন— মিট - মাট, ফিট - ফাট, বকা - ঝকা, তোড় - জোড়, গল্প - স্বল্প, রকম - সকম ইত্যাদি।
৪. সমার্থক বা বিপরীতধর্মী শব্দ যোগ করে। যেমন— লেন - দেন, দেনা - পাওনা, টাকা - পয়সা, ধনী - গরীব, আসা - যাওয়া ইত্যাদি।
বাংলা ভাষায় নানা অর্থে দ্বিরুক্ত শব্দ প্রয়োগ হতে পারে। যেমন—
ক. পুনরাবৃত্তি
খ. দীর্ঘকাল বর্তিতা
গ. ব্যাপকতা বা প্রসারতা
ঘ. বাহুল্যতা।
(২) পদের দ্বিরুক্তি বা পদদ্বৈত : বাংলা ভাষায় কখনো কখনো বাক্যের মধ্যে বিভক্তি যুক্ত পদের পুনরাবৃত্তি ঘটে। পদের এই পুনরাবৃত্তিকে পদের দ্বিরুক্তি বা পদদ্বৈত বলে। যেমন— ঘরে ঘরে আজ উৎসবের আমেজ।
পদের দ্বিরুক্তি নানা ধরনের হতে পারে। যেমন—
১. দুটি পদে একই বিভিক্তি প্রয়োগ করা হয়, শব্দ দুটি ও বিভক্তি অপরিবর্তিত থাকে। যেমন— ঘরে ঘরে লেখাপড়া হচ্ছে। দেশে দেশে ধন্য ধন্য হতে লাগল। মনে মনে আমিও এ কথাই ভেবেছি।
২. দ্বিতীয় পদের আংশিক ধ্বনিতগত পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু পদ বা বিভক্তি অবিকৃত থাকে। যেমন— চোর হাতে নাতে ধরা পড়েছে। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
পদের দ্বিরুক্তির প্রয়োগ
(ক) বিশেষ্য শব্দযুগলের বিশেষণরূপে ব্যবহার
১. আধিক্য বোঝাতে : রাশি রাশি ধন, ধামা ধামা ধান।
২. সামান্য বোঝাতে : আমি আজ জ্বর জ্বর বোধ করছি।
৩. পরস্পরতা বা ধারাবাহিকতা বোঝাতে : তুমি দিন দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছো। তুমি বাড়ি বাড়ি হেঁটে চাঁদা তুলেছ।
৪. ক্রিয়া বিশেষণ : ধীরে ধীরে যায়, ফিরে ফিরে চায়।
৫. অনুরুপ কিছু বোঝাতে : তার সঙ্গী সাথী কেউ নাই।
৬. আগ্রহ বোঝাতে : ও দাদা দাদা বলে কাঁদছে।
(খ) বিশেষণ শব্দযুগলের বিশেষণ রূপে ব্যবহার
১. আধিক্য বোঝাতে : ভালো ভালো আম নিয়ে এলো। ছোট ছোট ডাল কেটে ফেল।
২. তীব্রতা বা সঠিকতা বোঝাতে : গরম গরম জিলপি, নরম নরম হাত।
৩. সামান্যতা বোঝাতে : উড়ু উড়ু ভাব; কালো কালো চেহারা।
(গ) সর্বনাম শব্দ
(যে যে, কে কে, কি কি ইত্যাদি)। যেমন—
১. বহুবচন বা আধিক্য বোঝাতে : কে কে এলো? কেউ কেউ বলে।
(ঘ) ক্রিয়াবাচক শব্দ
১. বিশেষণ রূপে — এদিকে রোগীর তো যায় যায় অবস্থা। তোমার নেই নেই ভাব গেল না।
২. স্বল্পকাল স্থায়ী বোঝাতে — দেখতে দেখতে আকাশ কালো হয়ে গেল।
৩. ক্রিয়া বিশেষণ — দেখে দেখে যেও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনলে কীভাবে?
৪. পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে — ডেকে ডেকে হয়রান হয়েছি।
(ঙ) অব্যয়ের দ্বিরুক্তি
১. ভাবের গভীরতা বোঝাতে — তার দুঃখ দেখে সবাই হায় হায় করতে লাগল। ছি ছি, তুমি কী করেছ?
২. পৌনপুনিকতা বেঝাতে — বার বার সে কামান গর্জে উঠল।
৩. অনুভূতি বা ভাব বোঝাতে — ভয়ে গা ছম ছম করছে। ফোঁড়াটা টন টন করছে।
৪. বিশেষণ বোঝাতে — পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটি।
৫. ধ্বনিব্যঞ্জনা — ঝির ঝির করে বাতাস বইছে। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর।
যুগ্মরীতিতে দ্বিরুক্ত শব্দের গঠন
একই শব্দ ঈষৎ পরিবর্তন করে দ্বিরুক্ত শব্দ গঠনের রীতিকে বলে যুগ্মরীতিতে দ্বিরুক্ত। যুগ্মরীতিতে দ্বিরুক্ত শব্দ গঠনের কয়েকটি রীতি আছে। যেমন—
১. শব্দের আদি স্বরের পরিবর্তন করে — চুপচাপ, মিটমাট, জারাজুরি।
২. শব্দের অন্ত্যস্বরের পরিবর্তন করে — মারামারি, হাতাহাতি, সরাসরি, জেদাজেদি।
৩. দ্বিতীয়বার ব্যবহারের সময় ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবর্তন — ছটফট, নিশপিশ, ভাতটাত।
৪. সমার্থক বা একার্থক সহচর শব্দ যোগে — চালচলন, রীতিনীতি, বনজঙ্গল, ভয়ডর।
৫. ভিন্নার্থক শব্দ যোগে — ডালভাত, তালাচাবি, পথঘাট, অলিগলি।
৬. বিপরীতার্থক শব্দ যোগে — ছোট—বড়, আসা—যাওয়া, জন্ম—মৃত্যু, আদান—প্রদান।
পদাত্মক দ্বিরুক্তি
বিভক্তিযুক্ত পদের দুইবার ব্যবহারকে পদের পদাত্মক দ্বিরুক্তি বলে। এগুলো ২ রকমে গঠিত হয়। যেমন—
১. একই পদের অবিকৃত অবস্থায় দুইবার আসে। যথা— ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। হাটে হাটে বিকিয়ে তের ভরা আপণ।
২. যুগ্মরীতিতে গঠিত দ্বিরুক্ত পদের ব্যবহার। যথা— হাতে নাতে, আকাশে বাতাশে, কাপড় চোপড়, দলে বলে ইত্যাদি।
বিশিষ্টার্থক বাগধারায় দ্বিরুক্ত শব্দের প্রয়োগ
(১) ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখো। (সতর্কতা)
(২) ফুলগুলো তুই আনরে বাছা বাছা। (ভাবের প্রগাঢ়তা)
(৩) থেকে থেকে শিশুটি কাঁদছে। (কালের বিস্তার)
(৪) লোকটা হাড়ে হাড়ে শয়তান। (আধিক্য)
(৫) খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে, পরশে মুখে মুখে, নীরবে চোখে চোখে।
ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি
কোনো কিছুর স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতিবিশিষ্ট শব্দের রূপকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে। এ জাতীয় ধ্বন্যাত্মক শব্দের দুইবার প্রয়োগের নাম ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি দ্বারা বহুত্ব, আধিক্য ইত্যাদি বোঝায়। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি কয়েক প্রকারে গঠিত হয়। যেমন—
১. মানুষের ধ্বনির অনুকার — ভেউ ভেউ (মানুষের উচ্চস্বরে কান্নার ধ্বনি)। এরূপঃ ট্যা ট্যা৷ হি হি ইত্যাদি।
২. জীবজন্তুর ধ্বনির অনুকার — ঘেউ ঘেউ (কুকুরের ধ্বনি)। এরূপঃ মিউ মিউ (বিড়াল), কুহু কুহু (কোকিল), কা কা (কাক) ইত্যাদি।
৩. বস্তুর ধ্বনির অনুকার — ঘচাঘচ (ধান কাটার শব্দ), মড়মড় (গাছ ভেঙে পড়ার শব্দে), ঝমঝম (বৃষ্টি পড়ার শব্দ) ইত্যাদি।
৪. অনুভূতিজাত কাল্পনিক ধ্বনির অনুকার — ঝিকিমিকি (ঔজ্জ্বল্য), ঠা ঠা (রোদের তীব্রতা), কুট কুট (শরীরে কামড় লাগার শব্দ) ইত্যাদি। এরূপ আরোঃ মিন মহন, পিট পিট, ঝি ঝি ইত্যাদি।
ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি গঠন
১. একই (ধ্বন্যাত্মক) শব্দের অবিকৃত প্রয়োগ : ধক ধক, ঝন ঝন, পট পট।
২. প্রথম শব্দটির শেষে আ যোগ কর : গপাগপ, টপাটপ, পটাপট।
৩. দ্বিতীয় শব্দটির শেষে ই যোগ করে : ধরাধরি, ঝমঝমি, ঝনঝনি।
৪. যুগ্মরীতিতে গঠিত ধ্বন্যাত্মক শব্দ : কিচির মিচির (পাখি বা বানরের শব্দ), টাপুর টুপুর (বৃষ্টি পতনের শব্দ), হাপুস হুপুস (গোগ্রাসে কিছু খাওয়ার শব্দ)।
৫. আনি প্রত্যয় যোগে বিশেষ্য দ্বিরুক্ত গঠিত : পাখিটার ছটফটানি দেখলে কষ্ট হয়। তোমার বকবকানি আর ভালো লাগে না।
বিভিন্ন পদরূপে ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্ত শব্দের ব্যবহার
১. বিশেষ্য : বৃষ্টির ঝমঝমানি আমাদের অস্থির করে তোলে।
২. বিশেষণ : নামিল নভে বাদল ছলছল বেদনায়।
৩. ক্রিয়া : কলকলিয়ে উঠল সেথায় নারীর প্রতিবাদ।
৪. ক্রিয়া বিশেষণ : চিকচিক করে বালি, কোথা নাহি কাদা।