ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য

GI কী?
GI-এর অভিব্যক্তি Geographical Indication; যআর বাংলা অর্থ 'ভৌগলিক নির্দেশক'। GI হলো একটি চিহ্ন বা প্রতীক। যেটা নির্দিষ্ট একটি পণ্যের জন্য ব্যবহার করা হয়,যা কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার (শহর বা দেশ) পণ্যের পরিচিতি বহন করে। এতে পণ্যটি ঐ দেশের বা এলাকার পণ্য হিসেবে খ্যাতি পায়।

বাংলাদেশের GI পণ্য
DPDT এ পর্যন্ত ৯টি বাংলাদেশি পণ্যের GI নিবন্ধন করেছে। ১৭ নভেম্বর ২০১৬ প্রথম GI পণ্য হিসেবে নিবন্ধন সনদ পায় 'জামদানি শাড়ি'। এরপর ২৪ আগস্ট ২০১৭ দ্বিতীয় পণ্য হিসেবে 'বাংলাদেশ ইলিশ' এবং ২৭ জানুয়ারি তৃতীয় পণ্য হিসেবে 'চাঁপাইনবাবাগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম' এ স্বীকৃতি পায়। সাম্প্রতিক সময়ে আরো ছয়টি পণ্যের GI নিবন্ধন চূড়ান্ত করা হয়।

নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় ২৮ পণ্য
GI পণ্য নিবন্ধনের জন্য পেটেন্ট,ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে ৩৭টি পণ্যের আবেদন করা হয়। এর মধ্যে ৯টি নিবন্ধন করা হয়েছে। আরও দুটি পণ্য জার্নাল প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলো হলো--- বাংলাদেশ বাগদা ও রাজশাহীর ফজলি। এই দুটি জার্নাকে প্রকাশ হলে কোনো আপত্তি না এলে পরবর্তী দুই মাস পর GI পণ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। এছাড়া বগুড়ার দই,সিলেটের আগর,জামালপুরের তুলসীমালা ধান,রংপুরের হাঁড়িভাঙা আমসহ আরও ২৬টি পণ্য নিবন্ধনের জন্য প্রক্রিয়াধীন।

নিবন্ধন সংস্থা
মেধাস্বত্ব-বিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা World Intellectual Property Organisation (WIPO) সাধারণত ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের নিবন্ধন দেয়। তবে বাংলাদেশে WIPO'র হয়ে স্থানীয়ভাবে কাজটি করে থাকে শিল্প মন্ত্রাণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (DPDT)। 

নিবন্ধনে বিদ্যমান আইন
বাংলাদেশ ৬ নভেম্বর ২০১৩ ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন করে। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা আইন) ২০১৩ অনুযায়ী,ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা GI পণ্য অর্থ ভৌগোলিক নির্দেশকসম্পন্ন এরূপ কৃষিজাত বা প্রকৃতিজাত অথবা প্রস্তুতকৃত পণ্য, যার দ্বারা উক্ত পণ্য কোনো বিশেষ দেশে বা ভূখন্ডে বা উক্ত দেশ বা ভূখন্ডের কোনো বিশেষ অঞ্চল বা এলাকার জাত বা প্রস্তুতকৃত বোঝায়।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে GI-এর গুরুত্ব
বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় GI পণ্য নিবন্ধন ও সুরক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের নিজস্ব মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্টা লাভের পাশাপাশি শশক্তিশালী ব্র‍্যান্ডের মর্যাদা লাভ করবে। বিপণন কৌশলের নিয়ামক হবে, ভোক্তা সাধারণের অধিকার সুরক্ষা দেবে,গ্রামীণ উন্নয়নের অন্যতম উপাদান হবে,ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সমুন্নত রাখবে। এছাড়া এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে, আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি হবে,রপ্তানি ও বিনিয়োগ বাড়বে এবং নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠবে। ককর্মসংস্থান বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভোক্তা সাধারণ নিবন্ধিত GI পপণ্যগুলো ক্রয়ের ক্ষেত্রে সমজাতীয় অনিবন্ধিত GI পণ্যের চেয়ে ২০-৩০% মূল্য বেশি দিতে সম্মত থাকে

ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য
কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার স্বতন্ত্র পরিচয় ঐতিহ্য বহন করে এমন পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন। সংশ্লিষ্ট দেশের আবেদন,অন্যান্য দেশের অনাপত্তি এবং সংস্থাটির সার্বিক যাচাই বাছাইয়ের ভিত্তিতে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বীকৃতি পাওয়া পাঁচটি পণ্য----

জামদানি
বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পন্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় জামদানি শাড়ি। ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর আসে এই স্বীকৃতি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) পায় জামদানির জিআই স্বত্ব।
বাংলাদেশই যে জামদানির জিআই স্বত্ব পাওয়ার একমাত্র যোগ্য দাবিদার,এর পক্ষে জোরালো যুক্তি-প্রমানসহ নিবন্ধ প্রকাশ করে বাংলাদেশ। প্রাচীন ভারতীয় অঅর্থশাস্ত্রবিদ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, ১৪শতকের  মুসলিম পরিব্রাজক ইবনে বতুতার লেখা কিংবা অন্যান্য গবেষণাপত্রে জামদানির আদি উৎস হিসেবে ঢাকাকেই উল্লেখ করা হয়েছে।

ক্ষীরশাপাতি আম
২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক তালিকাভুক্ত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ অঞ্চলে ক্ষীরাশপাতি নাম হলেও যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলে এটি 'হিমাগার' নামেই অধিক পরিচিত। ১৯৫৫ সালের প্রাচীন লোকগীতি 'আলকাপ' গানে ২০০ জাতের  আমের নামের মধ্যে ক্ষীরশাপাতি একটি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে ২৬ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে ২৫০-এর বেশি জাতের আমের চাষ করা হলেও এর মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই হচ্ছে ক্ষীরশাপাতি। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলেই নয়, বরং আশঁবিহীন আমটি এর অনন্য স্বাদ ও গন্ধের কারণে সারা দেশেরি জনপ্রিয়। কয়েক বছর ধরে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে ক্ষীরশাপাতি আম।

মসলিন কাপড়
কেবল ভূ-ভারত নয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যসহ দুনিয়াজুড়ে একসময় বিপুল সমাদর ছিল মসলিন মিহি কাপড়ের। অত্যন্ত হালকা,সূক্ষ্ণ এবং পরিধেয় হিসেবে খুব আরামদায়ক হওয়ায় অভিজাত নারীদের কাছে এর চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী পণ্য। বর্তমান সরকার বিলুপ্ত এই মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয় আনতে 'বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য : মসলিন সুতা ও কাপড়ের প্রযুক্তি পুনরুদ্বার' শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয়। ছয় বছরের বিরামহীন চেষ্টায় ১৭০ বছর পর  সফলভাবে মসলিন বুনতে সক্ষম হন গবেষকেরা। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশের মসলিন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডকে (বাতাঁবো) দেওয়া হয় এই জিআই স্বত্ব।

ইলিশ মাছ
বাংলাদেশের দ্বিতীয় নিজস্ব পণ্য হিসেবে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই স্বীকৃতি পায় ইলিশ। ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট WIPO জাতীয় মাছ ইলিশকে বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের কথা ঘোষণা করে। ওয়ার্ল্ড ফিশের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। বিগত কয়েক বছরে অন্যান্য দেশে ইলিশের উৎপাদন কমে গেলেও বাংলাদেশে তা উল্লেখ্যযোগ্য হারে বেড়েছে। পাশাপাশি ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের তৈরি মডেলগুলো অন্যান্য দেশও অনুসরন করছে। মূলত মা ও জাটকা ইলিশ ধরা বন্ধ করার মাধ্যমেই ইলিশ উৎপাদনে এ সফলতা পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতে,মিয়ানমার,আটনান্টিক ও ভূমধ্যসাগরীয় কিছু অঞ্চলে অল্প পরিমানে ইলিশ পাওয়া গেলেও স্বাদে ও পুষ্টিতে বাংলাদেশের ইলিশই সেরা।

রাজশাহী সিল্ক
২৬ এপ্রিল বিশ্ব মেধাস্বত্ব দিবস। ২০২১ সালের এই দিবসে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সিল্ক। বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে WIPO এই স্বীকৃতির ঘোষণা দেয়। রেশম বা সিল্কের জন্মভূমি চীন হলেও ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে প্রচুর সিল্কের উৎপাদন হতে থাকে। একসময় রাজশাহী জেলা হয়ে ওঠে রেশম চাষের প্রধানতম ক্ষেত্র। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুজন কর্মকর্তার পাঠানো দুটি প্রতিবেদন প্রথমটি রাজশাহী সিল্কের অনন্য প্রামাণিক দলিল। যার ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান সেরেস্তাদার জেমস গ্রান্ট কর্তৃক ১৭৮৮ সালে সদর দপ্তর ফোর্ট উইলিয়াম কলকাতায় প্রেরণ করা হয়।


বাংলাদেশের GI পণ্য ও আবেদনকারী

জামদানি শাড়ী
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (BSCIC)

বাংলাদেশ ইলিশ
মৎস্য অধিদপ্তর (DoF)

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম 
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI)

ঢাকাই মসলিন
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড (BHB)

রাজশাহী সিল্ক
বাংলাদেশ রেশম সিল্ক উন্নয়ন বোর্ড (BSDB)

বিজয়পুরের সাদা মাটি
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় নেত্রকোনা

দিনাজপুর কাটারীভোগ
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI)

বাংলাদেশ কালিজিরা
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI)

রংপুরের শতরঞ্জি
 

আরো দেখুন:

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post