১০ম শ্রেণি : বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় : ২য় সপ্তাহ
তোমার পরিবারে বসবাসরত ষাটোর্ধ তোমার দাদা বা নানার কাছে তুমি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারলে যে যুদ্ধ শুরু হলে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে গঠিত মুজিবনগর সরকার যুদ্ধ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলসহ সকলের ভূমিকা মূল্যায়ন করে নির্দেশনা অনুসরণে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন কর।
নমুনা সমাধান
প্রতিবেদনের নাম ও ঠিকানা: (নিজের নাম ও ঠিকানা)
প্রতিবেদনের শিরোনাম : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকার গঠন, রাজনৈতিক ও সামাজিক পেশাজীবীদের ভূমিকা।
প্রতিবেদন তৈরির সময় : সন্ধ্যা ৭টা
তারিখ : ২২/০৬/২০২১
মুজিবনগর সরকার গঠন:
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হলে প্রাথমিকভাবে পূর্ব প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক তৎপরতা ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ সুষ্টুভাবে পরিচালনার জন্য ১০ই এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার। এ সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায়। শপথ অনুষ্টানে বিপুলসংখ্যক দেশি বিদেশি সাংবাদিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। সরকারের প্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তাঁর নাম অনুসারে বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর সরকার নামে। এ সরকার গঠনের মাত্র দুই ঘন্টা পর পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান মুজিবনগরে বোমাবর্ষণ করে এবং মেহেরপুর দখল করে নেয়। তখন মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে স্থানান্তরিত হয়।
মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম
রাষ্ট্রপতি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান
উপ রাষ্ট্রপতি : সৈয়দ নজরুল ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী : তাজউদ্দিন আহমেদ
অঅর্থমন্ত্রী : এম.মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র, ত্রান ও পুনর্বাসন, কৃষি মন্ত্রী : এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান
পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী : খন্দকার মোশতাক আহমদ
প্রধান সেনাপতি : কর্ণেল (অব.) এম.এ.জি ওসমানী
চিফ অস স্টাফ : লে.কর্ণেল (অব.) আব্দুর রব
ডেপুটি চিফ অব স্টাফ : গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে খন্দকার।
মুজিবনগর সরকারের যুদ্ধ পরিচালনা
১৯৭০-১৯৭১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য দ্বারা মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা ছিল এ সরকারের উদ্দেশ্য।
বাঙালু কর্মকর্তাদের নিয়ে সরকার প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করেন। এতে মোট ১২টি মন্ত্রণালয় ছিল। এগুলো হচ্ছে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, অর্থ-শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়, সাধারণ প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বিভাগ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, যুব ও অভ্যর্থনা শিবিরের নিয়ন্ত্রণ বোর্ড ইত্যাদি। মুজিবনগর সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে (কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, স্টকহোক) বাংলাদেশ সরকারের মিশন স্থাপন করে। এসব মিশন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। সরকার বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীকে বিশেষ দূত নিয়োগ দেয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমতসৃষ্টি ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন আদায়ের জন্য কাজ করেন। ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক, বেসামরিক জনগণকে নিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১০ই এপ্রিল সরকার ৪টি সামরিক জোনে বাংলাদেশকে ভাগ করে ৪জন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করে। ১১ই এপ্রিল তা পুনর্গঠিত করে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এ ছাড়া বেশ কিছু সাব-সেক্টর এবং তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠিত হয়। এসব সেক্টরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, সেনাসদস্য, পুলিশ, ইপিআর, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যগণ যোগদান করেন। প্রতিটি সেক্টরেই নিয়মিত সেনা, গেরিলা ও সাধারন যোদ্ধা ছিল। এরা মুক্তিযোদ্ধা না মুক্তিফৌজ নামে পরিচিত ছিল এসব বাহিনীতে দেশের ছাত্র, যুবক, নারী, কৃষক, রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিল। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে শেষে যোদ্ধাগণ দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সামরিক ছাউনি বা আস্তানায় হামলা চালায়। মুক্তিযুদ্ধ সরকারের অধীন বিভিন্ন বাহিনী ছাড়াও বেশ কয়েকটি বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছিল এ সব সংগঠন স্থানীয়ভাবে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। যেমন: টাঙ্গাইল কাদেরিয়া বাহিনীর কথা স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব দেশকে পাকিস্তানিদের দখলযুক্ত করার জন্য রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছেন, অনেকে আহত হয়েছেন, অনেকে দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জণগণ ও পেশাজীবীদের অবদান
সাধারন জনগণের সাহায্য সহযোগিতা ও স্বাধীনতার প্রতি ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষার ফলেই মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক দোষর ব্যতীত সবাই কোন না কোন ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে। শত্রুর অবস্থান ও চলাচলের তথ্য দিয়েছে, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করেছে, সেবা দিয়েছে ও খবরাখবর সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণও অংশগ্রহণ করেন। অনেকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের মধ্যে সাধারণ মানুষের সংখ্যা ছিল অধিক। এদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীন মানচিত্র, লাল সবুজ পতাকা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। ছাব্বিশে মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেন। স্বাধীনবাংলা বেতার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা রণাঙ্গনের নানা ঘটনা ইত্যাদি দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরেন, সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যুগিয়ে বিজয়ের পথ সুগম।
পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অবদানও ছিল গৌরবোজ্জ্বল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মিছিল, মিটিং ও গণসমাবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।
মুক্তিযুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ছাত্রীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশগ্রহন করে। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। তারাই মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করতো, এবং গতিবিধি দেখিয়ে দিত।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা
বাঙালির বীর সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা। তাদের স্মরনে নির্মিত জাতীয় শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ। তাদের স্মরনে রচিত হয়েছে বিভিন্ন অসাধারণ সঙ্গীত। নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন চত্বর, প্রতিষ্টান, ভবন ইত্যাদি। বাঙালির প্রতিবাদী মনোভাব ও মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াকু চেতনার মূর্ত প্রতীক অপরাজেয় বাংলা। ত্রিশ লক্ষ শহীদ জীবন দিয়েছেন বাংলাদেশের পতাকার মর্যাদা রক্ষার জন্য। জাতীয় পতাকা একটি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। জাতীয় পতাকার সম্মানের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্মান-মর্যাদা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এই পতাকার সম্মান রক্ষা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
আরো দেখুন :
২য় সপ্তাহের নমুনা সমাধান :