'আলতাবানু' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।
আলতাবানু
"কোনো এক বীরাঙ্গনার কথা" স্মরণিকায় প্রকাশিত লেখাটি চোখে পড়ে আলতাবানুর। লেখকরা তাদের অনুভূতি দিয়ে, সসহানুভূতি দিয়ে কত যত্নে একটা লেখা উপহার দেন। কিন্তু তারা কি পারেন একজন ধর্ষিতা নারীর মর্মজ্বালা, ঘৃণা, বন্ধনহীন জীবনের যন্ত্রণা, পরিবার ও সমাজে তার অবস্থানের অবস্থানকে সম্পূর্ণ তুলে ধরতে, কিংবা একজন সন্তানহারা মায়ের কষ্ট? যে মায়ের বুকের ওম থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে তার চোখের সামনে আছড়ে মেরে ফেলা হয়েছে। পারার কথা নয়। তবুও লেখাটায় চোখ রাখে আলতাবানু, পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে সে। ষোলো বছরের অনিন্দ্য সুন্দরী আলতাবানু অলংকারে সজ্জিত হয়ে আরিফ চৌধুরীর পুত্রবধূ হয়ে ঘরে এসেছিল। প্রতিবেশীরা নতুন বউ দেখতে এসে তার রূপ গুনের প্রশংসা করেছিল। সবার মুখে সে শুনেছিল, চৌধুরী বাড়িতে সূর্য উঠেছে। দুধে আলতা গায়ের রং দেখে মুগ্ধ হয়েছিল আরিফ চৌধুরীর ছেলে আলম চৌধুরী। চাঁদের হাট বসেছিল চৌধুরী পরিবারে। দু'বছর হতে না হতে চৌধুরী পরিবারে নতুন অতিথি আসার বার্তায় সবার বুক ভরে উঠল আনন্দে। সময় খুব কাছাকাছি। তখনই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। আলতার দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিল। এই খবর খানসেনাদের কাছে পৌঁছে দিল তাদের গ্রামের রুস্তম রাজাকার। হানাদার বাহিনী তাদের গ্রামসহ আশেপাশের কয়েক গ্রামের ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চহ্ন করে দিল। আলতাবানুর বাবা, মা, আত্মীয়স্বজন সবাইকে ধরে এনে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সব শুনে চৌধুরী সাহেব ভাবী বংশধরকে রক্ষা করার জন্য বউমাকে নিয়ে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিলেন। সেখানে সে ভাবী বংশধরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কূটকৌশলের আশ্রয় নিলেন। ঘরে উর্দু সাহিত্যের বইপত্র, দোয়া, দরুদ ও কোরান শরিফের বিভিন্ন আয়াত, বিভিন্ন দোয়া মাসালা দিয়ে সামনের ঘর গুলো সাজিয়ে তুললেন। শান্তি কমিটির লোকদের সাথেও আলাপ আলোচনা করতে লাগলেন। এর মধ্যে তার নাতির জন্ম হলো। তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন আমার লাউফুল দাদুভাই। তখনই কোলে নিতে চাইলেন, কিন্তু দাই মা দিলেন না। নাতিকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে একুশ দিন কেটে গেল। পরিকল্পনা ছিল চল্লিশ দিন কেটে গেলে সাধ্যমতো আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে নাতিসহ বউমাকে আঁতুড়ঘর থেকে তুলে নিবেন নতুন ঘরে। কিন্তু তা আর হলো না, সেদিন সারারাত নাতির কান্নার আওয়াজে ঘুমাতে পারলেন না আরিফ চৌধুরী। ফজরের আযান দিল। জায়নামাজ বিছিয়ে সুন্নত আদায় শেষ করেছেন, সেই অবস্থায় পেছন থেকে একটি গুলি এসে লাগল তার মাথায়। গুলির শব্দ আঁতুড়ঘর থেকে জানালা দিয়ে বারান্দায় উঁকি দিল আলতাবানু। এর মধ্যেই মিলিটারিরা ঘরে ঢুকে পড়ল। সে শুনল- ‘ইয়ে তো বেহেস্তাকা হুর মালুম হোতা, বহুত সুরৎ...’ বুকের মানিককে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করার আগেই আলতাবানুর মুখে কাপড় গুঁজে দিল সেই রুস্তম রাজাকার।