দ্বিতীয় অ্যাসাইনমেন্ট
অধ্যায় ০২ ও ০৩
ব্যবসায় উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা এবং আত্মকর্মসংস্থান
৪র্থ সপ্তাহ
ব্যবসায় উদ্যোগ সৃষ্টিতে আত্ম-কর্মসংস্থানের ভূমিকা নিরূপণ।
নমুনা সমাধান
ব্যবসায় উদ্যোগের ধারণা : উদ্যোগ যেকোনো বিষয়ের ব্যাপারে হতে পারে
কিন্তু লাভের আশায় ঝুঁকি নিয়ে অর্থ, শ্রম বিনিয়োগ করা হলো ব্যবসায় উদ্যোগ।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মনে করো তুমি বাঁশ ও বেত দিয়ে সুন্দর সুন্দর জিনিস
তৈরি করতে পারো। এখন নতুন এক ধরনের বেতের চেয়ার দেখে সেটা বানানোর চেষ্টা
করলে। এটা তোমার উদ্যোগ। এখন তুমি যদি অর্থ সংগ্রহ করে বাঁশ ও বেতের সামগ্রী
তৈরি দোকানে স্থাপন করে সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করো তখন এটি হবে ব্যবসায়
উদ্যোগ। ব্যবসায় উদ্যোগ এর প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন কিন্তু অন্যান্য
উদ্যোগের উদ্দেশ্য জনকল্যাণ। একটি ব্যবসায় স্থাপনার ধারণা চিহ্নিতকরণ থেকে
শুরু করে ব্যবসায়টি স্থাপন ও সফলভাবে পরিচালনাই ব্যবসায় উদ্যোগ।বিশদ ভাবে
বলতে গেলে, ব্যবসায় উদ্যোগ বলতে বোঝায় লাভবান হওয়ার আশায় লোকসানের সম্ভাবনা
জেনেও ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য দৃঢ় ভাবে এগিয়ে যাওয়া ও
সফলভাবে ব্যবসায় পরিচালনা করা।
ব্যবসায় উদ্যোগের বৈশিষ্ট্য : যেকোনো উদ্যোগকে ব্যবসায় বলা যায়না তাই
কোন উদ্যোগকে ব্যবসায় উদ্যোগ বিবেচিত করার জন্য নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা
প্রয়োজন:
১) উদ্যোক্তার সকল কার্যাবলী ব্যবসায় উদ্যোগ। যার প্রাথমিক লক্ষণ নিজের জন্য
কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে একজন উদ্যোক্তা
নিজের উপার্জনে ব্যবস্থা করতে পারেন।
২) এটি ব্যবসায় স্থাপনের কর্ম উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা বা পরিকল্পনা। অর্থাৎ নতুন
কিছু সৃষ্টির পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ব্যবসায় উদ্যোগের
গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।ব্যবসায় স্থাপন সংক্রান্ত সকল কর্মকাণ্ডে সফল ভাবে
পরিচালনা করতে ব্যবসায় উদ্যোগ সহায়তা করে।
৩) ব্যবসায় উদ্যোগ এক ধরনের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত যার কারণে ঝুঁকি আছে জেনেও
লাভের আশায় ব্যবসায় পরিচালনা করা হয়। ব্যবসায় উদ্যোগ সঠিকভাবে ঝুঁকি পরিমাপ
করতে এবং পরিমিত ঝুঁকি নিতে সহায়তা করে।
৪) ব্যবসায় উদ্যোগ এর অন্য একটি ফলাফল হল একটি পণ্য বা সেবা।
৫) ব্যবসায় উদ্যোগ এর ফলাফল হল একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এর মানে হলো
ব্যবসায় উদ্যোগ সম্পর্কে ধারণা কোন চিন্তা ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা
করে।
৬) ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে মুনাফার পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে সামাজিক
দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ব্যবসায় উদ্যোগ উদ্যোক্তাদের সমাজের বিভিন্ন
উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করে।
৭) ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে নতুন সম্পদ সৃষ্টি হয় ফলে যেমন মানবসম্পদ
উন্নয়ন হয় তেমনি মূলধন গঠন হয়।
৮) ব্যবসায় উদ্যোগ সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে।ব্যবসায়
উদ্যোগ দেশের আয় বৃদ্ধি ও বেকার সমস্যার সমাধান সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান
রাখতে পারে।
৯) ব্যবসায় সংস্থাপন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সফলভাবে পরিচালনা করতে ব্যবসায়
উদ্যোগ সাহায্য করে।
১০) ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে উদ্যোক্তা নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যদের
জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।
আত্মকর্মসংস্থানের ধারণা : দরিদ্র পরিবারের সন্তান এসএসসি পাস আজহার আলী
২০০০ সালে জাহাজে কাজ শুরু করেন। ছোট চাকরি খাটুনি অনেক কিন্তু বেতন অনেক কম।
সংসার চলছিল না।বাধ্য হয়ে তাকে জাহাজের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে গ্রামে ফিরে আসতে
হয়। ঔষুধ কোম্পানিতে চাকরি নেয়ার অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তবে পরিশ্রমি
আজহার দমে যাননি। বাড়ির আশেপাশে পতিত জমি নিয়ে কিছু একটা করার কথা ভাবতে
থাকেন। উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ শুরু করেন পতিত জমিতে কলা চাষ। সপ্তাহে এখন
তার ক্ষেত্রে ৭ মণ করলা ফলে। করলার আয় দিয়ে আজহারের ছয় সদস্যের পরিবারের ভরণ
পোষণ করছে স্বাচ্ছন্দে। পিরোজপুর ভান্ডারিয়া মাটিভাংগা গ্রামে শিক্ষিত কৃষক
আজহার আলী করলা চাষ করার পাশাপাশি নানা রকম সবজি আবাদ করে বেকারত্ব গুছিয়ে এখন
স্বাবলম্বী দারিদ্র্যকে করেছেন জয়। আজহারের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই এখন
সবজি আবাদ মনোনিবেশ করেছেন। যেকোনো বেকার যুবকের জন্য এটি অনুকরণীয়।
এই যে জনাব আজহার আলী নিজের দক্ষতা ও গুণাবলী তারা নিজেই নিজের কর্মসংস্থান
করেছেন এটাই আত্মকর্মসংস্থান। এখন আমরা বুঝতে পারছি যে নিজস্ব পুঁজি অথবা ঋণ
করা স্বল্প সম্পদ,নিজের বিবেক -বুদ্ধি, বিচার-বিশ্লেষণ ,দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে
আশেপাশের বিভিন্ন উৎস ব্যবহার করে নিজের প্রচেষ্টায় জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থাকে
আত্মকর্মসংস্থান বলে। পৃথিবীতে যতগুলো দেশ আছে তাদের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থান
একটি অতি জনপ্রিয় পেশা।
আত্মকর্মসংস্থান ও ব্যবসায় উদ্যোগের মধ্যে সম্পর্ক সম্পর্ক : আমরা
জানি আত্মকর্মসংস্থান হল নিজস্ব পুঁজি অথবা ঋণ করা স্বল্প সম্পদ, নিজস্ব
চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে
আত্মপ্রচেষ্টায় জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা।জীবিকা অর্জনের বিভিন্ন পেশার মধ্যে
আত্মকর্মসংস্থান একটি জনপ্রিয় পেশা। আমাদের চারপাশে এমন অনেক আত্মকর্মসংস্থান
মূলক কর্মকান্ড দেখা যায়। কলেজ গেটের পাশে যে চানাচুর বা আমড়া বিক্রি করে
সেটি ও তাদের আত্মকর্মসংস্থান। এরকম নানাবিধ জীবিকার উপায় আত্মকর্মসংস্থান
আয়ের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে হাঁস-মুরগী পালন, নার্সারি, ফুলের চাষ,
বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরি, টেইলারিং ইত্যাদি আত্মকর্মসংস্থানের আওতাভুক্ত।
ব্যবসায় উদ্যোগের সাথে আত্ম-কর্মসংস্থানের সম্পর্ক নিবিড়। আত্মকর্মসংস্থানের
ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি নিজের কর্মসংস্থানের চিন্তা করে কাজে হাত দেন।তিনি
সাধারণত প্রচলিত যে কোন কর্মকে জীবিকার উপায় হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।যার মধ্যে
সাধারণত নতুনত্ব বা সৃজনশীলতা থাকে না। নিজের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ ও
মুনাফা অর্জনে আত্মকর্মসংস্থানের প্রধান উদ্দেশ্য।অন্যদিকে একজন উদ্যোক্তা
নিজের কর্মসংস্থান ও আর্থিক স্বচ্ছতার জন্যে কাজ শুরু করলেও তিনি নতুন পণ্য বা
সেবা সামগ্রীর উৎপাদন করে ব্যবসায় শুরু করেন, উক্ত পণ্যের বাজার চাহিদা সৃষ্টি
করেন, আবার বাজারে প্রচলিত দ্রব্য সামগ্রী দিয়ে ব্যবসায় শুরু করলেও অল্পদিনের
মধ্যেই তিনি উদ্যম ,সাহস ও সৃজনশীলতার দিয়ে অনেকের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম
হন। উদ্যোক্তার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো তিনি নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি
অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির স্বপ্ন নিয়ে তার ব্যবসায় শুরু করেন।
একজন আত্মকর্মসংস্থান কারী ব্যক্তি তখনই একজন উদ্যোক্তার পরিণত হবেন যখন তিনি
নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সমাজের আরও কয়েকজনের কর্মসংস্থানের চিন্তা নিয়ে
কাজ শুরু করেন ,ঝুঁকি আছে জেনেও এগিয়ে যান এবং একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।সে
ক্ষেত্রে সকল ব্যবসায় উদ্যোক্তাকে আত্মকর্মসংস্থানকারী বলা গেলেও সকল
আত্মকর্মসংস্থানকারীকে ব্যবসায় উদ্যোক্তা বলা যায় না।
(an entrepreneur is self employed, but someone who is self employed isn't
necessarily an entrepreneur.)
ব্যবসায় উদ্যোগের কার্যাবলি : ব্যবসায় উদ্যোগ সাধারন অর্থনৈতিক
কর্মকাণ্ড থেকে আলাদা।ব্যবসায় উদ্যোগের সাথে নতুনত্ব, সৃজনশীলতা ও
সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি জড়িত।উদ্যোক্তা যা করেন তাই ব্যবসায় উদ্যোগ
কার্যাবলী। ব্যবসায় উদ্যোগ এর কার্যাবলী বহুমুখী। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাকে তিন
ধরনের কাজ পরিচালনা করতে হয়।প্রথমত, ব্যবসায় সম্পর্কিত তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ
করতে হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে বিনিয়োগ
সিদ্ধান্ত, মুনাফা পরিকল্পনা, সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্ত পুনর্মূল্যায়ন করা হয়।
তৃতীয় পর্যায়ে ব্যবসায় উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ সম্পাদন করতে হয়। নিন্মে
ব্যবসায় উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী তুলে ধরা হলো:
১) উদ্যোগ গ্রহণই ব্যবসায় উদ্যোগের প্রধান কাজ। যিনি উদ্যোগ গ্রহণ করবেন তিনি
ঝুঁকি মোকাবেলা করার সাহস নিয়ে ব্যবসায়ে আসেন।তবু তাকে উদ্যোগ গ্রহণের
সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে হয়।
২) ব্যবসায় উদ্যোক্তাকে উৎপাদনের উপকরণ অর্থাৎ ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠনকে
যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে নতুন পণ্য বাস সেবা আবিষ্কার করতে হয় উদ্যোক্তা তার
অভিনীত মূলধনের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য যেসকল পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তা অবশ্যই
দেশের প্রচলিত আইন ও সামাজিক রীতিনীতি দ্বারা সমর্থিত হয়।
৩) ব্যবসায় উদ্যোগ এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তার উৎপাদিত পণ্য দ্রব্য বা
সেবার সামগ্রীর বাজার সৃষ্টি করা। কারণ বাজার সৃষ্টি করতে না পারলে ঝুঁকির
পরিমাণ বেড়ে যায়। ভোক্তার মনোভাব ও চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দ্রব্য সৃষ্টি করতে
পারলে সাফল্যের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়।
৪) উদ্যোক্তা নিজস্ব বা ধার করা প্রাথমিক মূলধন নিয়ে ব্যবসায় শুরু করলেও
ব্যবসায়ের এক পর্যায়ে অধিক মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। তাই মূলধন সংগ্রহ করা এবং
মূলধন সংগ্রহের উৎস ও কৌশল জানা ব্যবসায় উদ্যোগ এর অন্যতম কাজ।
৫) ব্যবসায়িক যোগাযোগের বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে বিভিন্ন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা
,বাজার সম্প্রসারণ, নতুন নতুন উপযোগ সৃষ্টি ব্যবসায় উদ্যোগ এর অন্যতম
কাজ।ব্যবসায়কে যেহেতু সবসময় ঝুঁকি ও প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করতে হয় সেজন্য
উদ্যোক্তাকে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়।
৬) সাথে সাথে পণ্যের মান, পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদানের
ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাকে দৃষ্টি রাখতে হয়।
৭) উদ্যোক্তার অন্যতম কাজ সময়ের দাবীতে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা।
৮) ব্যবসায় উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাবার সম্ভাব্য সকল কারণ ও ঝুঁকি মোকাবেলায় সব
সময় প্রস্তুত থাকা উদ্যোক্তার কার্যাবলীর মধ্যে পড়ে।
৯) সর্বোপরি উদ্যোগের মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থান, আর্থিকস্বচ্ছতা আনয়নের সাথে
সমাজের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ব্যবসায় উদ্যোক্তার অন্যতম কাজ।
দ্বিতীয় অ্যাসাইনমেন্ট
অধ্যায় ০২
ব্যবসায় উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা
২য় সপ্তাহ
অ্যাসাইনমেন্ট : বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যবসায় উদ্যোগের ভূমিকা
নিরূপণ।
নমুনা সমাধান
বাংলাদেশের আর্থ - সামাজিক উন্নয়নে ব্যবসায় উদ্যোগ এর ভূমিকা
নিরূপণ
উদ্যোগ ও ব্যবসায় উদ্যোগ এর ধারণা : সাধারণ অর্থে, যে কোনাে
কর্মপ্রচেষ্টাই উদ্যোগ। কোন সহৃদয় ব্যক্তি এলাকার জনসাধারণের বিশেষ করে
দরিদ্র মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে একটি হাসপাতাল স্থাপন করতে এগিয়ে আসেন।
তিনি ব্যক্তিগত অর্থ ও সম্পদ ব্যয় করে হাসপাতালটি স্থাপন করেন এবং ডাক্তার ও
নার্স নিয়ােগ করেন। এটি তার দৃঢ় মনােবল ও উদ্যোগ গ্রহণের ফসল। এভাবে সকল
প্রকার জনহিতকর কাজ যেমন, স্কুল - কলেজ, হাসপাতাল ও খেলাধূলার ক্লাব
প্রতিষ্ঠা করা উদ্যোগের ফসল। ব্যবসায় স্থাপন বা প্রতিষ্ঠাও কোন একজন ব্যক্তি
বা কয়েকজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। একটি ব্যবসায় স্থাপনের ধারণা
চিহ্নিতকরণ থেকে শুরু করে ব্যবসায়টি স্থাপন ও সফলভাবে পরিচালনাই ব্যবসায়
উদ্যোগ।
বিশদভাবে বলতে গেলে, ব্যবসায় উদ্যোগ বলতে বােঝায় লাভবান হওয়ার আশায়
লােকসানের সম্ভাবনা জেনেও ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়ভাবে
এগিয়ে যাওয়া ও সফলভাবে ব্যবসায় পরিচালনা করা। যিনি ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ
করেন তিনিই ব্যবসায় উদ্যোক্তা। যে ব্যক্তি দৃঢ় মনােবল ও সাহসিকতার সাথে
ফলাফল অনিশ্চিত জেনেও ব্যবসায় স্থাপন করেন ও সফলভাবে ব্যবসায় পরিচালনা করেন
তিনি ব্যবসায় উদ্যোক্তা বা শিল্পোদ্যোক্তা। অন্যদিকে, মুনাফা লাভের
উদ্দেশ্যে একটি ব্যবসায় স্থাপনের ধারণা চিহ্নিতকরণ থেকে শুরু করে ব্যবসায়টি
স্থাপন ও সফলভাবে পরিচালনাই ব্যবসায় উদ্যোগ।
ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশ (Favourable Environment for Developing Business Entrepreneurship) আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখতে তাদের অগ্রগতির
একটি প্রধান কারণ হলাে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও সম্প্রসারণের অনুকূল
পরিবেশ। আমাদের দেশে মেধা, মনন ও দক্ষতার খুব বেশি ঘাটতি নেই। শুধুমাত্র
অনুকূল পরিবেশের অভাবে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসায় উদ্যোগ গড়ে
উঠার জন্য নিম্নোক্ত অনুকূল পরিবেশ থাকা উচিত।
উন্নত অবকাঠামােগত উপাদান : ব্যবসায় পরিচালনার জন্য আনুষঙ্গিক
কিছু সুযােগ সুবিধা, যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও যাতায়াত ব্যবস্থা দরকার
ব্যবসায়ের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এই সকল উপাদান থাকা বাঞ্ছনীয়।
সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা : সরকারি পৃষ্ঠপােষকতার মাধ্যমে দেশের
ব্যবসায় উদ্যোগের আরও সম্প্রসারণ ও সমৃদ্ধি সম্ভব। সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত
যেমন কর মওকুফ, স্বল্প বা বিনা সুদে মূলধন সরবরাহ ইত্যাদি ব্যবসায় উদ্যোগের
অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে।
আর্থ : সামাজিক স্থিতিশীলতা: অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক
স্থিতিশীলতা যেমন ব্যবসায় উদ্যোগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে, তেমনি
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ব্যবসায় উদ্যোগের উপর বিরূপ প্রভাব
ফেলে।
অনুকূল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি : আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি
অনুকূল থাকলে ব্যাবসায় স্থাপন ও পরিচালনা সহজ হয়। অন্যদিকে অস্থিতিশীল
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যবসায় স্থাপন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি
সৃষ্টি করে।
পর্যাপ্ত পুঁজির প্রাপ্যতা : যে কোনাে ব্যবসায় উদ্যোগ সফলভাবে
বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়ােজন পর্যাপ্ত পরিমাণ পুঁজি বা মূলধন। মূলধনের
স্বল্পতার কারণে অধিকাংশ ব্যবসায় স্থাপন ও পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। এজন্য
দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে যাতে করে নতুন উদ্যোক্তারা
পুঁজির যােগান পেতে পারে।
প্রশিক্ষণের সুযােগ : প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক সময় সুযােগ
সত্ত্বেও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যবসায়ের
জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব।
ব্যবসায় উদ্যোগ এর বৈশিষ্ট্য : ব্যবসায় উদ্যোগের ধারণা
বিশ্লেষণ করলে যে সকল বৈশিষ্ট্য ও কার্যাবলি লক্ষ করা যায় তা হলাে :
১। এটি ব্যবসায় স্থাপনের কর্ম উদ্যোগ। ব্যবসায় স্থাপন সংক্রান্ত সকল
কর্মকান্ড সফলভাবে পরিচালনা করতে ব্যবসায় উদ্যোগ সহায়তা করে।
২। ঝুঁকি আছে জেনেও লাভের আশায় ব্যবসায় পরিচালনা। ব্যবসায় উদ্যোগ সঠিকভাবে
ঝুঁকি পরিমাপ করতে এবং পরিমিত ঝুঁকি নিতে সহায়তা করে।
৩। ব্যবসায় উদ্যোগের ফলাফল হলাে একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এর মানে হলাে
ব্যবসায় উদ্যোগ সম্পর্কে ধারণা কোনাে চিন্তা - ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে
সহায়তা করে।
৪। ব্যবসায় উদ্যোগের অন্য একটি ফলাফল হলাে একটি পণ্য বা সেবা।
৫। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটি সফলভাবে পরিচালনা করা।
৬। নিজের জন্য কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি করা। ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে
একজন উদ্যোক্তা নিজের উপার্জনের ব্যবস্থা করতে পারেন।
৭। অন্যদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। ব্যবসায় উদ্যোগ মালিকের
কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি
করেন।
৮। নতুন সম্পদ সৃষ্টি করা। ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে যেমন মানবসম্পদ উন্নয়ন
হয় তেমনি মূলধনও গঠন হয়।
৯। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখা। ব্যবসায় উদ্যোগ দেশের
আয় বৃদ্ধি ও বেকার সমস্যার সমাধানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবদান রাখতে
পারে।
১০। মুনাফার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা গ্রহণ করা। ব্যবসায় উদ্যোগ
উদ্যোক্তাদের সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে
অনুপ্রাণিত করে।
আর্থ : সামাজিক উন্নয়নে ব্যবসায় উদ্যোগের গুরুত্ব (Importance
of Business Entrepreneurship in Socio Economic Development) বাংলাদেশ একটি
উন্নয়শীল দেশ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা -২০১০ অনুযায়ী আমাদের মােট
জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৫০ ভাগ আসে সেবা খাত থেকে, প্রায় ২০ ভাগ আসে কৃষি
খাত থেকে আর বাকি ৩০ ভাগ আসে শিল্প খাত থেকে। যে কোনাে দেশের উন্নয়নে
শিল্পখাত মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে শিল্পখাতসহ সকল
খাতেরই উন্নয়ন সম্ভব। ব্যবসায় উদ্যোগ নিম্নোক্তভাবে আমাদের দেশের আর্থ
সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
সম্পদের সঠিক ব্যবহার : ব্যবসায় উদ্যোগ আমাদের দেশের প্রাকৃতিক
সম্পদ ও মানব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে। তাছাড়া নতুন নতুন শিল্প
স্থাপনের মাধ্যমে বিনিয়ােগ বৃদ্ধি এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা
সম্ভব।
জাতীয় উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি : ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের
জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়। ফলে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত জাতীয় আয় বৃদ্ধির
লক্ষমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়।
নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি : সরকারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের
মাধ্যমেও দেশে শিল্প কারখানা স্থাপন, পরিচালনা ও সম্প্রসারণ হয়ে থাকে। এর
মাধ্যমে নিত্যনতুন কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি হয় যা বেকার সমস্যা দূর করতে
উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখে।
দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি : বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। আমাদের এই
বিশাল জনসংখ্যাই আমাদের সম্পদ হতে পারে। কারণ ব্যবসায় উদ্যোক্তা দেশের অদক্ষ
জনগােষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে নিয়ােজিত করে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করতে
পারে।
পরনির্ভরশীলতা দূরীকরণ : ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা আমাদের
প্রনির্ভরশীলতা অনেকাংশে হ্রাস করতে পারি। ব্যবসায় উদ্যোগের সঠিক ব্যবহারের
মাধ্যমে আমরা একদিন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারব।
প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট
অধ্যায় ০১
ব্যবসায় পরিচিতি
১ম সপ্তাহ
অ্যাসাইনমেন্ট : বাংলাদেশে ব্যবসায় সম্প্রসারণে ব্যবসায় পরিবেশের প্রভাব
বিশ্লেষণ।
নমুনা সমাধান
বাংলাদেশে ব্যবসায় সম্প্রসারণে ব্যবসায় পরিবেশের প্রভাব বিশ্লেষণ
ব্যবসায়ের ধারণা : সাধারণভাবে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে ব্যবসায় বলে। মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে মানুষ যে সব বৈধ
অর্থনৈতিক কার্যাদি সম্পন্ন করে থাকে তাকে ব্যবসায় বলে। পরিবারের সদস্যদের
জন্য খাদ্য উৎপাদন করা হাঁস মুরগী পালন করা সবজি চাষ করাকে ব্যবসায় বলা যায়
না। কিন্তু যখন কোন কৃষক মুনাফার আশায় ধান চাষ করে বা সবজি ফলায় তা ব্যবসায়
বলে গণ্য হবে। তবে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড
ব্যবসায় বলে গণ্য হবে যদি হবে। সেগুলাে দেশের আইনে বৈধ ও সঠিক উপায়ে পরিচালিত
হয়। সুতরাং যে কাজটিকে আমরা ব্যবসায় বলবাে তা চারটি মৌলিক উপাদান আছে। যেমন :
ক. অর্থনৈতিক কাজ,
খ. মুনাফার উদ্দেশ্য,
গ. ঝুঁকি,
ঘ. বৈধতা।
এই ৪ টি উপাদান না থাকলে কোন কাজকে ব্যবসায় বলা যাবে না। ব্যবসায়ের আরও কিছু
বৈশিষ্ট্য আছে যা একে অন্য সব পেশা থেকে আলাদা করেছে। ব্যবসায়ের সাথে জড়িত
পণ্য বা সেবার অবশ্যই আর্থিক মূল্য থাকতে হবে।
ব্যবসায়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এর সাথে ঝুঁকির সম্পর্ক। মূলত মুনাফা অর্জনের
আশাতেই ব্যবসায়ী অর্থ বিনিয়ােগ করে। ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মুনাফা
অর্জনের পাশাপাশি অবশ্যই সেবার মনােভাব থাকতে হবে।
ব্যবসায়ের প্রকারভেদ : বর্তমানে ব্যবসায় শুধু পণ্যদ্রব্যের ক্রয়
বিক্রয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পণ্য-দ্রব্য ও সেবা-কর্ম উৎপাদন, পণ্য-দ্রব্য
বিনিময় ও এর সহায়ক কাজের সমষ্টিকে ব্যবসায় বলে। পণ্য-দ্রব্য বিনিময়
সংক্রাড়সহায়ক কাজে পরিবহন, বিমা, ব্যাংকিং গুদামজাতকরণ ও বিজ্ঞাপন
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক ব্যবসাকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা
হয়েছে। যথা :
ক. শিল্প (Industry)
খ . বাণিজ্য (Commerce)
গ . প্রত্যক্ষ সেবা (Direct Services)
শিল্প (Industry) : শিল্পকে উৎপাদনের বাহন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে
প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, কাঁচামালে রূপদান এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের
মাধ্যমে কাঁচামালকে মানুষের ব্যবহার-উপযােগী পণ্যে পরিণত করা হয় তাকে শিল্প
বলা হয়। শিল্পকে প্রধানত পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
প্রজনন শিল্পে (Genetic) : উৎপাদিত সামগ্রী পুনরায় সৃষ্টি বা উৎপাদনের
কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন নার্সারি, হ্যাচারি ইত্যাদি।
নিষ্কাশন (Extractive) : শিল্পের মাধ্যমে ভূগর্ত, পানি বা বায়ু হতে
প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা হয়। যেমন- খনিজ শিল্প।
নির্মাণ (Construction) : শিল্পের মাধ্যমে রাস্তাঘাট, সেতু ইত্যাদি
নির্মাণ করা হয়।
উৎপাদন (Manufacturing) : শিল্পে শ্রম ও যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে
কাঁচামালকে প্রক্রিয়াজাত করে চূড়ান্ত পণ্যে রূপান্তর করা হয়। যেমন- বস্ত্র
শিল্প।
সেবা (Service) : শিল্প বিভিন্ন প্রকার সেবা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের
জীবনযাত্রা সহজ ও আরামদায়ক করে। যেমন- বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণ,
ব্যাংকিং ও স্বাস্থ্য সেবা ইত্যাদি।
বাণিজ্য (Commerce) : বাণিজ্যকে ব্যবসায়ের পণ্য বা সেবা সামগ্রী
বণ্টনকারী শাখা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ব্যবসায় বা শিল্পে ব্যবহৃত কাচামাল
উৎপাদকের নিকট পৌছানাে কিংবা শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বা সেবা সামগ্রী ভােক্তাদের
নিকট পৌছানাের সকল কার্যাবলিকে বাণিজ্য বলে। পণ্য - দ্রব্য ক্রয় - বিক্রয়
কার্য যথার্থভাবে সমাধানের ক্ষেত্রে অর্থগত, ঝুঁকিগত, স্থানগত, কালগত ও তথ্যগত
বাধা বা সমস্যা দেখা দিতে পারে | এ সকল বাধা দূরীকরণে বাণিজ্যের বিভিন্ন অঙ্গ
যেমন পরিবহন, গুদামজাতকরণ, ব্যাংকিং, বিমা, বিপণন ও বিজ্ঞাপন ইত্যাদির
সহযােগিতার প্রয়ােজন হয়। বাণিজ্যকে আধুনিককালে ব্যবসায় টু ব্যবসায়
(Business to Business) বলেও অভিহিত করা হয়।
নিম্নে বাণিজ্যের বিভিন্ন উপাদানের ভূমিকা ছকে প্রদর্শন করা হলাে:
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বাধা |
বাণিজ্যের উপাদান | ভূমিকা |
---|---|---|
স্বত্বগত | পণ্য বিনিময় | মালিকানাসংক্রান্ত বাধা দূর করে |
স্থানগত | পরিবহন | স্থানগত বাধা দূর করে |
সময়গত | গুদামজাতকরণ | সময়গত বাধা দূর করে |
অর্থগত | ব্যাংকিং | অর্থ সংক্রান্ত বাধা দূর করে |
ঝুঁকিগত | বিমা | ঝুঁকিসংক্রান্ত বাধা দূরে করে |
তথ্যগত | বিজ্ঞাপন | তথ্য ও প্রচার সংক্রান্ত বাধা দূর করে |
প্রত্যক্ষ সেবা (Direct Services) : অর্থ
উপার্জনের উদ্দেশ্যে স্বাধীন পেশায় নিয়ােজিত ডাক্তার, উকিল, প্রকৌশলী প্রভৃতি
পেশাজীবীরা বিভিন্ন রকম সেবাকর্ম অর্থের বিনিময়ে প্রদান করে থাকেন। এ সকল
সেবাকর্ম বা বৃত্তি প্রত্যক্ষ সেবা হিসেবে পরিচিত। যেমন ডাক্তারি ক্লিনিক, আইন
চেম্বার, প্রকৌশলী ফার্ম, অডিট ফার্ম ইত্যাদি। প্রত্যক্ষ সেবা আধুনিক
ব্যবসায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা।
ব্যবসায় পরিবেশের ধারনা : পরিবেশ দ্বারা মানুষের জীবনধারা, আচার-আচরণ,
শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং ব্যবসা প্রভাবিত হয়। পরিবেশ হলাে কোনাে
অঞ্চলের জনগণের জীবনধারা ও অর্থনৈতিক কার্যাবলিকে প্রভাবিত করে এমন সব উপাদানের
সমষ্টি। পারিপার্শ্বিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, নদ-নদী,
পাহাড়, বনভূমি, জাতি, ধর্ম, শিক্ষা ইত্যাদি। যে সব প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক
উপাদান দ্বারা ব্যবসায়িক সংগঠনের গঠন, কার্যাবলি, উন্নতি ও অবনতি প্রত্যক্ষ ও
পরােক্ষভাবে প্রভাবিত হয় সেগুলাের সমষ্টিকে ব্যবসায়িক পরিবেশ বলে। কোনাে
স্থানের ব্যবসায় ব্যবস্থার উন্নতি নির্ভর করে ব্যবসায়িক পরিবেশের উপর।
ব্যবসায় পরিবেশের উপাদান : বহু প্রকারের ব্যবসায়িক পরিবেশ দেখতে
পাওয়া গেলেও ব্যবসায়িক পরিবেশের উপাদানগুলােকে প্রধানত ছয় ভাগে ভাগ করা
যায়।
ক . প্রাকৃতিক পরিবেশ (Natural environment)
খ . অর্থনৈতিক পরিবেশ (Economic environment)
গ . রাজনৈতিক পরিবেশ (Political environment)
ঘ . সামাজিক পরিবেশ (Social environment)
ঙ . আইনগত পরিবেশ (Legal environment)
চ . প্রযুক্তিগত পরিবেশ (Technical environment)
বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ (Business Environment in Bangladesh) :
কৃষিনির্ভর উন্নয়নশীল দেশ অবশ্য দেশের অর্থনীতিতে ব্যবসায় তথা শিল্প ও
বাণিজ্যের অবদান প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। এক কালে এ অঞ্চল ব্যবসায় - বাণিজ্যে
সারাবিশ্বে বিখ্যাত ছিল। ব্যবসায় বাণিজ্যে প্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে বিশেষ করে
মসলিন কাপড়ের জন্য ‘সােনারগাঁও’ এবং সমুদ্র বন্দর ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের
জন্য চট্টগ্রাম, এ লুটো স্থানের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সােনারগাঁও
এবং এর আশেপাশে তৈরি মসলিন রফতানি হতাে ইউরােপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। আমাদের
দেশ চিরকাল বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। এ দেশের বাণিজোর খ্যাতিতে প্রলুব্ধ
হয়ে আরবগণ মরণাতীত কাল পূর্বে থেকে বাণিজ্য সম্পর্ক করেন এবং দলে দলে এদেশে
আগমন করেন। বাণিজ্য বিষয়ে তখন এ অঞ্চলের শ্রীবৃদ্ধি এতদূর হয়েছিল যে, ইতিহাস
বিখ্যাত তাম্রলিপ্ত ও সপ্তগ্রামের সাথে এর ঘাের প্রতিযােগিড়া চলত। এ অঞ্চলের
বাণিজ্য খ্যাতি প্রাচ্যের দেশ ছাড়িয়ে সুদুর ইউরােপ পর্যন্ত পৌছেছিল।
খ্রিস্ট্রীয় ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা। এসে বাণিজ্য করতে আরম্ভ করেন। তারা
সামকে Porto Piqueno বা ক্ষুদ্র বন্দর এবং চট্টগ্রামকে Porto Grando বা বৃহৎ
কদর নামে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য, বাণিজ্য কন্দর হিসেবে পশ্চিম বঙ্গের সপ্তগ্রাম
নামটিও বিখ্যাত ছিল। ভাগীরথী নদী ও সরস্বতী খালের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের সাথে
সপ্তগ্রামের বাণিজ্য চলত। সমুদ্র পথে ব্যবসায়ের জন্যও আমাদের দেশ প্রসিদ্ধ
ছিল। সমুদ্রগামী জাহাজও এ দেশে নির্মিত হতাে। চৈনিক পরিব্রাজক মাছুয়ান লিখেছেন
যে, এ দেশের জাহাজ নির্মাণ প্রণালির শ্রেষ্ঠত্ব হৃদয়ঙ্গম করে মহামান্য রােমের
সম্রাট আলেকজান্দ্রিয়ার ডক কারখানা ও জাহাজ পছন্দ না করে চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ
তৈরি করে নিতেন। চট্টগ্রামের হালিশহর, পতেঙ্গায় দেশীয় শিল্পীর কর্তৃত্বে
অনেকগুলাে জাহাজ নির্মাণ কারখানা ছিল। ঐ সকল কারখানা তখন হাতুড়ির ঠক্ঠক্ শব্দে
সবসময় মুখরিত থাকত। এ দেশের সওদাগরেরা তখন শতাধিক জাহাজের মালিক ছিলেন।
ইতিহাসবিদ ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, ঐ সকল জাহাজ নির্মাণ কারখানা ১৮৭৫
খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নিজেদের প্রভাব অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
বর্তমান প্রতিযােগিতামূলক বিশ্বে ব্যবসায়িক পরিবেশের সকল উপাদান অনুকূল না হলে
ব্যবসায়-বাণিজো উন্নতি লাভ করে টিকে থাকা কঠিন। নিয়ে ব্যবসায়িক পরিবেশের
উপাদানগুলাে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা হলো।
প্রাকৃতিক উপাদান : প্রাকৃর্তিক পরিবেশের অধিকাংশ উপাদানই বাংলাদেশে
ব্যবসায় ব্যাপনের জন্য অনুকূল দেশের প্রায় সকল অংশই ননী বিধৌত। ফলে সহজেই
এখানে কৃষিজাত বিভিন্ন শিল্প ও ভােগ্য পণ্যের কাঁচামাল উৎপাদন করা সম্ভব।
ব্যবসায় বা শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়ােজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যমান। দেশে
বিল্যমান খনিয়া কয়লা, চুনা পাথর, কঠিন শিলা ও খনিজ তৈল শিল্প বিকাশে সহায়ক।
দিন দিন বনভূমির পরিমাণ কমে গেলেও আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ বনজ সম্পদ। অসংখ্য নদী
বিধৌড় ও সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় মৎস্য শিল্প বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশও এখানে
বিদ্যমান।
অর্থনৈষ্ঠিক উপাদান : দেশে বিরাজমান কার্যকর অর্থ ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা,
কৃষি ও শিল্পের অবদান জনগণের সঞ্চয় ও বিনিয়ােগ মানসিকতা শু সরকারের
পৃষ্ঠপােষকা ব্যবসায় পরিবেশের সুদৃঢ় অর্থনৈতিক উপাদান হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উপাদানগুলাের কয়েকটির ভিত্তি বেশ মজবুত হলেও অনেকগুলাের
ভিত্তি তেমন সুদৃঢ় নয়। চাহিদার তুলনায় প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব, গ্রামীণ
জনগণের ব্যাংকিং সেবা ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শহরের তুলনায় কম সুবিধা, প্রশাসনিক
জটিলতা দালাল শ্রেণির লােকদের হয়রানি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ইত্যাদি
প্রতিকূল অবস্থা কাটাভে পারলে বাংলাদেশ ব্যবসায় বিকাশে আরও দ্রুত অগ্রসর হতে
পারবে।
সামাজিক উপাদান : জাতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, ভােক্তাদের মনােভাব, মানব
সম্পদ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রভৃতি ব্যবসায়ের
সামাজিক উপাদানগুলাের বেশিরভাগ বাংলাদেশে ব্যবসায় প্রসারের ক্ষেত্রে অনুকূল। এ
দেশের মানুষ জাতিগত, ঐতিহাগত এবং সাংস্কৃতিকভাবে উদার, পরিশ্রমী এবং সৃজনশীল
অতীতে জাহাজ নির্মাণ করে এবং মসলিন কাপড় উৎপাদন করে এ দেশের মানুষ তাদের
প্রতিভা ও পরিশ্রমের বাক্ষর রেখেছে। সােনারগাঁও এক সময় ব্যবসায়, শিক্ষা -
দীক্ষা, কৃবি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, কারু শিলে ছিল বিশ্বসেরা। বর্তমানেও
জামদানি শাড়ি তৈরি এবং জাহাজ নির্মাণ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম
হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুখ নির্ভরতা থেকে বের করে
আরও দক্ষতা শ্রমনির্ভর করতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিল্প, বাণিজ্য, গবেষণায়
আরও বেশি সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পারবে। সাথে সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল
ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
রাজনৈতিক উপাদান : সুষ্ঠু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং অনুকূল শিল্প ও
বাণিজ্যনীতি, প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশের সাথে সুসম্পর্ক ব্যবসা-বাণিজ্য
প্রসারে সহায়তা করে। অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন,
হরতাল, ধর্মঘট, ব্যবসায়-বান্ধব শিল্প ও বাণিজ্য নীতির অভাব ইত্যাদি প্রতিকূল
রাজনৈতিক উপাদান শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারে বাধা সৃষ্টি করে। দেশি ও বিদেশি
বিনিয়ােগকারীগণও বিনিয়ােগ করতে উৎসাহিত হয় না। বাংলাদেশে ব্যবসায়ের উক্ত
রাজনৈতিক উপাদানের সবগুলাে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বিদ্যমান নেই। শ্রমিক অসন্তোষ,
ধর্মঘট, হরতালসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিহার করার মাধ্যমে বাংলাদেশে
ব্যবসায়ের জন্য রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নত করা যায়।
আইনগত উপাদান : আইনগত পরিবেশের বেশ কিছু উপাদান বাংলাদেশে আধুনিক ও
যুগােপযােগী হলেও অনেকগুলাে বেশ পুরাতন। পরিবেশ সংরক্ষণ ও ভােক্তা আইনের কঠোর
প্রয়ােগ, শিল্প ও বিনিয়ােগ বান্ধব আইন তৈরি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও
চাঁদাবাজি প্রতিরােধে আইনের কঠোর প্রয়ােগের মাধ্যমে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের
উন্নতি নিশ্চিত করা যায়।
প্রযুক্তিগত পরিবেশ : শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নতিতে
দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী, উন্নত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির প্রয়ােজন হয়। সাধারণত
দেখা যায়, যে সকল দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবেশে উন্নত তারা ব্যবসা
বাণিজ্যেও উন্নত। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সহজতর করে। ফলে
উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশের
প্রযুক্তিগত উপাদানগুলাে অনেকক্ষেত্রেই অনুকূল। ব্যবসায়ের সকল শাখায়
প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।