ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বের হটনিউজ করোনাভাইরাস। ২০২০ সালের শুরু থেকে চলছে তার দাপট। কেউ তাই ২০২০ সালকে বলেছেন বিষসাল, কেউবা প্রহর গুনেছেন কবে শেষ হবে এই অভিশপ্ত সময়। তবে এই ২০২০ সাল থেকে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে নানান নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছে আমাদের, তার মধ্যে অন্যতম হল- ‘লকডাউন’।
লকডাউন কি : এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ‘পথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা’র বিশেষ কর্মসূচির কারণে যে শ্লোগান আমাদের কানে বাজে তা হল “Safe Drive, save Life”. এর সঙ্গে এই বছরের নবতম সংযোজন হল- “Stay home stay safe”. আর একেই কার্যকরী করতে বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে লকডাউন। ‘লকডাউন’ ইংরেজি শব্দ, যার বাংলা করলে হয় বন্ধাবস্থা। লকডাউন সাধারণত জনস্বার্থে গৃহীত প্রশাসনিক ব্যবস্থা যার দ্বারা সমস্ত রকম পরিষেবা যেমন যান চলাচল, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র সমস্ত বন্ধ থাকবে। এই লকডাউন সাধারণত দুই প্রকারের হয়-
- প্রতিরোধমূলক লকডাউন – এটি একটি প্রাকৃতিক কর্ম পরিকল্পনা যা জনগণ, সংগঠন এবং সিস্টেমের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য গ্রহণ করা হয়।
- জরুরিকালীন লকডাউন – মানুষের জীবনে কোনো বিশেষ সংকটময় পরিস্থিতিতে যখন কোনো আঘাতের আশঙ্কা থাকে তখন জরুরি লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
লকডাউনের ইতিহাস : কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে জনগণের স্বার্থে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় লকডাউনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে আমেরিকায় তিনদিনব্যপি লকডাউন সূচিত হয়েছিল। এরপর কানাডায় ২০০৩ সালে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রয়োগের হুমকির কারণে দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লকডাউন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রায় একই ঘটনার কারণে ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ শে জানুয়ারী ২০০৮ সালে ছয় ঘন্টার জন্যে লকডাউনের আদেশ জারি করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে প্যারিস হামলার কারণে সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ রুখতে বেশ কয়েক দিনের জন্য শহরটিকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। আর আমাদের ভারতবর্ষের জম্মু-কাশ্মীরে জঙ্গি হামলা এড়াতে বছরের নানা সময় কখনো কিছুদিন কখনো বা কিছুক্ষণ ব্যাপি লকডাউন চলে আসতেছে। কিন্তু এই লকডাউনের ইতিহাসে দীর্ঘকালীন এবং বিশ্বব্যাপী লকডাউন জারি করা হয়েছে এই ২০২০ সালে করোনা মহামারী সংক্রমণ রুখতে। ২০২০ সালের এপ্রিলের প্রথমদিকে বিশ্বের প্রায় ৩.৯ বিলিয়ন মানুষকে লকডাউনের আওতায় রাখা হয়েছিল যা বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। আর এপ্রিলের শেষে দিকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ লকডাউনের আওতায় ছিল যার মধ্যে ৯০ শতাংশই ইউরোপের দেশগুলিতে। আর ভারতের প্রায় ১.৩ বিলিয়ন মানুষই পড়েছেন এই লকডাউনের আওতায়।
তবে, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে যে মহামারী হয়েছিল সেসময়ও বেশ কয়েকমাস ধরে লকডাউন চলেছিল বলে জানা যায়।
দীর্ঘকালীন লকডাউনের কারণ : বর্তমান বিশ্বের ত্রাস করোনাভাইরাস, যার অতিসংক্রমণের ফলে মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই বৈশ্বিক মহামারীর সৃষ্টি হয়েছে। করোনাভাইরাসের এই প্রজাতি কোভিড–১৯ যার বাহক মানুষ, মানুষের দ্বারা সংক্রমিত হয়ে ভাইরাসটি নাক মুখের মধ্যে দিয়ে অপর মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ফুসফুসকে আক্রমণ করে, যার ফলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আর এই করোনা ভাইরাসের কারণে মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে চিন, আমেরিকা, ইটালি, রাশিয়া, ভারত সহ ১৮০ টির ও বেশি দেশ আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা ৫ লক্ষ ছাড়িয়েছে এবং বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেননি। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO-র নির্দেশনামা অনুযায়ী সোশ্যাল ডিসট্যান্স অর্থাৎ মানুষের থেকে মানুষের দূরত্ব বজায় রাখাই একমাত্র করোনা সংক্রমণ রুখতে পারে, আর বর্তমানে জনবহুল পৃথিবীতে মানুষের থেকে মানুষের দূরত্ব বজায় রাখার একমাত্র উপায় হল মানুষকে বাড়িতে রাখা, আর তার জেরেই বিভিন্ন দেশগুলিতে নানা সময় জুড়ে চলেছে দীর্ঘকালীন লকডাউন। অর্থাৎ প্রতিষেধকবিহীন এই মারণ ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে নিজেকে বাঁচাতে লকডাউন মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।
লকডাউনের প্রভাব : যেহেতু সংকটময় পরিস্থিতিতে জনগণের স্বার্থে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রতিঘাত বিপজ্জনক অবস্থা এড়াতে লকডাউন জারি করা হয় ফলে তার সুপ্রভাবই পড়ে জনগণের ওপর। বিশেষ পরিস্থিতিতে নানান প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা, গ্যাস লিক, সন্ত্রাসমূলক হুমকি এড়াতে হাসপাতাল স্কুল কলেজ মন্দির ইত্যাদি জনবহুল ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক জরুরিকালীন লকডাউনের আদেশ জারি করা হয় এবং এর কারণে নানা বিপদ আতঙ্ক এবং হতাহত এড়ানো গেছে কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে বিশ্বব্যাপী যে দীর্ঘকালীন লকডাউনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তার প্রভাব যেমন সুদূর প্রসারী তেমনি ভালো মন্দ উভয়ই আছে।
কুপ্রভাব : এই দীর্ঘকালীন লকডাউনের কারণে মানুষ গৃহবন্দি। কেবলমাত্র জরুরিকালীন স্বাস্থ্য পরিসেবা চালু রাখতে হাসপাতাল, ওষুধের দোকান এবং খাদ্য সামগ্রীর জন্য মুদির দোকান ও সবজির বাজার নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে খোলা ছিল। অন্যান্য সমস্ত পরিসেবা বন্ধ থাকার কারণে একটা বড় সড় অর্থনৈতিক ধাক্কার মুখোমুখি হয়েছে বিশ্ব। বিভিন্ন দেশের দিনমজুর, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ রোজগার হারিয়ে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এমনকি যান চলাচল বন্ধ থাকার কারণে অসুস্থ রোগী সময়মত চিকিৎসার চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। লকডাউনের বিভিন্ন বার্ষিক পরীক্ষা অসমাপ্ত থেকে গেছে যার কারণে সমস্ত ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যতও নানা প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হয়েছে। কাজ হারিয়ে নানা মানুষ সামনের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আত্নহননের পথ বেছে নিচ্ছে। মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় রাখার ভাবনায় সিনেমাহল, শপিং মল থেকে স্কুল কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে এবং আদৌ খুলতে পারবে কি না কিংবা খুললেও তা কীভাবে সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। আমাদের দেশে লকডাউন চালু হয়েছে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করার ফলে বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া মানুষজন নানা দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। লকডাউন চলাকালীন বিশেষভাবে তাদের ফিরিয়ে আনতে গিয়ে সংক্রমণের হার বেড়ে গেছে। এই অবস্থার পুর্ববর্তী লকডাউন কর্মসূচী গ্রহণটাই একটা প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে।
সুপ্রভাব : এই সুদীর্ঘসময় জুড়ে লকডাউন গৃহবন্দীত্ব সকল মানুষের জীবনযাত্রাতেই বড় ধরণের প্রভাব ফেলেছে, অর্থনীতির পারদ নেমেছে। কিন্তু এর পাশাপাশি অন্য সব কিছুর মতো এই লকডাউনের ভালো দিকও আছে। আর তার প্রভাব পড়েছে মনুষ্যতর জগতে প্রকৃতি ও প্রাণিদের মধ্যে। মানুষের করালগ্রাস থেকে কিছুদিন মুক্তি পেয়ে পশুপাখিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। তাদের অবাধ বিচরণের ছবি চোখে পড়েছে। এর পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের পরিমানও অনেক কমেছে, গরমের মাত্রা কমেছে। এমনকি ওজোন স্তরের গহব্বর বেশি পূর্ণ হয়েছে। প্রকৃতি ধূসর থেকে সবুজ হয়েছে অনেকটাই।
লকডাউন - নানা মতামত : বেশিরভাগই মানুষই এই দীর্ঘকালীন লকডাউনের নির্দেশে সিস্টেমের ভুলকে অথবা পরিকল্পনার অভাবকে দায়ি করেছেন। যেহেতু দেশের বাইরে থেকে আসা মানুষদের মধ্যে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল তাই তাদের আসা যাওয়ায় বিধি নিষেধ আরোপ করাটাই বেশি জরুরি ছিল।দেশের মধ্যবর্তী মানুষদের বিশেষ কয়েকদিনের কর্মসূচীতে ঘরে ফিরিয়ে সকলের গৃহবন্দিত্ব শুরু করাটাই ভালো হত বলে মনে করেছেন সাধারণ মানুষের একাংশ। এর সঙ্গে স্কুল কলেজের বিশেষত মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের বাকি থাকা পরিক্ষাও সম্পূর্ণ করা যেতে পারত বলে মনে করেছেন শিক্ষক, শিক্ষিকা ও অভিভাবকমহল। তাদের মতে, পরিকল্পনার অভাবেই লকডাউন অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে দীর্ঘকালব্যাপী করতে হচ্ছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে সরকার বা প্রশাসন কেউই এই মহামারীকালীন বিপর্যয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না, ফলে অজানা বিপদ এড়াতে পরিকল্পনা গ্রহণে কর্মপটুতার অভাব দেখা দেবেই। কিন্তু পরিকল্পনার অভাবের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব দেখা গেছে। দূরত্ববিধি লঙ্গন, জামায়াত, মাস্ক ব্যবহার না করার মতো নানা অসচেতনতাই লকডাউন চলাকালীন করোনার অত্যাধিক সংক্রমণের অন্যতম একটা কারণ।
উপসংহার : বর্তমান করোনা সংক্রমণের প্রবণতা অনুযায়ী জায়গাগুলিকে রেড, অরেঞ্জ ইত্যাদি জোন হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন কঠোর থেকে শিথিল করা হচ্ছে। বিভিন্ন পরিসেবা ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু, বার্ড ফ্লুর মতো কোভিড–১৯ ও আমাদের এখন নিত্য পথ চলার সঙ্গী। তাই নিজের জন্য নিজেকে সচেতন হতেই হবে। যতটা সম্ভব আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে, সময় লাগবে, কিছু পরিবর্তন আসবে এবং তা সঙ্গে নিয়ে ফিরেও আসবে আগের অবস্থা। তখন লকডাউন ডায়েরির পাতায় কিংবা স্মৃতির গহরে ভালো মন্দ মুহূর্ত মেশা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে কেবল।