HSC : বাংলা : ৪র্থ সপ্তাহ
নমুনা সমাধান
সূচনা : বাংলাদেশের জাতীয় কবি ও সর্বমানবিক মুক্তির প্রবক্তা কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘বিদ্রোহী’ । ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এই কবিতাটি রচিত হয়েছিলো। সমূলক হোক আর অমূলক হোক, বিদ্রোহের কোনো স্বীকৃত ব্যাকরণ নেই। বিদ্রোহ স্বতঃস্ফুর্ত ও স্বতোৎসারিত, সর্বগ্রাসী ও সংক্রামক ।
১. বিদ্রোহী কবিতায় কবি নিজেকে যে যে রূপে উপস্থাপন করেছেন :
'বিদ্রোহী' কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহচেতনার প্রকাশ ঘটেছে। ভারতীয় এবং পশ্চিম এশীয় পুরাণ ও ইতিহাসের আধার থেকে শক্তি সঞ্চয় করে নজরুল এখানে প্রবল বিদ্রোহবাণী উচ্চারণ করেছেন। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে, শৃঙ্খলপরা আমিত্বের বিরুদ্ধে । এই কবিতা রচনার জন্য নজরুল 'বিদ্রোহী' কবির আখ্যা পেয়েছেন।
এখানে নজরুল তার বিদ্রোহকে সঙ্গতকারণেই 'আমি 'প্রতীকে ব্যঞ্জনাময় করেছেন এবং নিজেকে অজেয় বলে উপলব্ধি করেছেন। তাইতো ' বিদ্রোহী ' আত্মশক্তিকে উদ্বোধিত করার লক্ষ্যে প্রথমেই কবির সরব।
ঘোষণা : ‘বল বীর বল উন্নত মম শির!'
নজরুল এই কবিতার প্রথম স্তবকেই প্রসঙ্গত উত্থাপন করেছেন মহাবিশ্ব, মহাকাশ, চন্দ্ৰসূর্যগ্রহতারা, ভূলোক দ্যুলোক, খোদার আসন, বিশ্ববিধাত্রী, চির - বিস্ময়, রাজটীকা, রুদ্র ভগবান আর দীপ্ত জয়শ্রীর কথা। বক্তব্যের অনুক্রম অনুযায়ী কবিতাটিকে মোট দশটি স্তবকে ভাগ করা যায় ।
প্রথম স্তবকে ‘আমি’-র শক্তিমত্তার পাশাপাশি রয়েছে বিজয়ের প্রত্যয়, আর এই বিজয়ের জন্যে প্রযোজন আঘাতকারীর। ‘আমি’-র ধ্বংসাত্মক রূপ, যা কবিতাটির ১১ থেকে ২৭ পঙক্তি পর্যন্ত ঘূর্ণিত :
‘আমি ঝঞা, আমি ঘূর্ণি ।
আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূৰ্ণি।'
শক্তির উদ্বোধন ও সংহারচিত্রের পরই হঠাৎ শুরু হলো মিলনের নৃত্যপাগল ছন্দ। ২৮ থেকে ৩৭ পঙক্তি পর্যন্ত আমি এমন এক মুক্ত জীবনান্দ, যে শত্রুর সাথে গলাগলি করে, আবার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে। কিন্তু মিলনের এই আকাক্ষার পর পরবর্তী দুই পঙক্তিতে ' আমি ' আবার মহামারী, ভীতি, শাসন-ত্রাসন ও সংহার রূপকে আবির্ভূত ।
তারপর ৪২ থেকে ৫১ সংখ্যক পঙক্তিতে আবার আছে উদ্দাম ইতিবাচকতা, হোমশিখা, উপাসনা, নিশাবসানের আকাঙ্ক্ষা। আর এই অংশের ৪৯ তম পঙক্তিতেই আছে সেই জাদুকরী সরল স্বীকারোক্তি :
‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি,
আর হাতে রণতূর্য।’
২. কবিতায় যেসব ঐতিহ্য ও পুরাণের ব্যবহার করা হয়েছে:
এই কবিতার ছত্রে ছত্রে পৌরানিক রুপকের ব্যবহার এতোটাই যথার্থ যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। রূপকের প্রয়োগ দেখে যে কেউ আঁচ করতে পারবেন, গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের ওপর কবির কতোটা দখল ছিল । এই কবিতায় যেসব ঐতিহ্য ও পুরাণের ব্যবহার করা হয়েছে তা ধাপে ধাপে নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলো :
ভূলোক মানে পৃথিবী, দ্যুলোক মানে স্বর্গ, আর গোলক মানে বিষ্ণুলোক অথবা স্বর্গে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের বাসস্থান । কৃষ্ণ রাধার বৃন্দাবন এখানেই অবস্থিত। ঋগ্বেদে রুদ্র বজ্রের দেবতা, গ্রীক মিথের ' থর' এর মতো ক্ষেপে গেলে বজ্র ছুড়ে মারেন, ইনি ব্রহ্মার পুত্র । তার ক্রোধে নেমে আসে ধ্বংস আর মহামারী ।
মহাদেব মহাপ্রলয়ের সময় তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন, গজাসুর ও কালাসুরকে বধ করেও তিনি তান্ডব নৃত্য নেচেছিলেন। এই তান্ডব নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে তাকে নটরাজ ডাকা হয়। পৃথু ছিলেন অত্রি বংশের অত্যাচারী রাজা বেন এর পুত্র। রাজা বেন এর মৃত্যুর পর তার ডান বাহু থেকে পৃথুর জন্ম । প্ৰজা কল্যানার্থে পৃথু পৃথিবীকে বশ করেন। তার রাজত্বকে বলা হয় পৃথু।
চেঙ্গিস খান ছিলেন মঙ্গোলিয়ান সম্রাট এবং দুর্ধর্ষ সমরনায়ক । যুবক চেঙ্গিসের স্ত্রীকে অপহরন করে নিয়ে যায় আরেক গোত্র প্রধান। চেঙ্গিস খান তার নিজ গোত্রকে পুনর্গঠিত করে অপহরনকারী গোত্রকে নৃশংস ভাবে পরাস্ত করে স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর অন্যান্য মোঙ্গল গোত্রদের একীভুত করে অর্ধেক বিশ্ব জয় করেন।
ইসলাম ধর্ম মতে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরুর আগে হযরত ইসরাফিল (আ:) নামক ফেরেস্তা শৃঙ্গায় ফু দেবেন।
৩. সমাজের অসাম্যের বিরুদ্ধে কবির বিদ্রোহী সত্তা :
কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিচিত্তে বিদ্রোহী চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ঘুমন্ত দেশ ও জাতিকে মুক্ত করবার জন্য নিজে যেমন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন, তেমনি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়াস পেয়েছেন। কবি জরাজীর্ণ পুরাতন সমাজ ও রীতিনীতি ভেঙ্গে নতুন দেশ ও জাতি গড়তে তাঁর কাব্যে ভাঙনের খেলা খেলেছেন। কবি পরাধীনতার বিরুদ্ধে, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। সমকালীন যুগ, তার রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত, সংশয়, দ্বিধা, অনিশ্চয়তা, অবক্ষয় সুকান্তর কবিসত্তা গড়ে তুলেছে। তাঁর কবিতায় উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও দেখা যায়, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা পদদলিত এদেশ দীর্ঘকাল শাসন, শোষণ, অন্যায়, অবিচার আর বৈষম্যের পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন থেকেছে । সমাজ সচেতন কবি এ সমাজ ও রাষ্ট্রের অবিচার এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কবিতায় কবির এই বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ উচ্চকিত থাকবে যতদিন না তার মূল উৎপাটিত হয়।
৪. বিদ্রোহী কবিতার প্রাসঙ্গিকতা :
বর্তমান সময়ে নানা রকম অসাম্যের ভীড়ে আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করি ' বিদ্রোহী' কবিতার প্রাসঙ্গিকতা ও তার অম্লান তাৎপর্যের কথা। উপনিবেশবাদের অবসান ঘটলেও বিশ্বায়নের শৃঙ্খল আর ধনতন্ত্রের শোষণ বঞ্চনা অত্যাচার নির্যাতনসহ আর্থসামাজিক বৈষম্য সবকিছুই বলবৎ আছে।
অত্যাচারীর থঙ্গ কৃপাণে'র তলে ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল’ এই বাংলার আকাশে - বাতাসে আজও প্রতিনিয়ত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়। অন্যদিকে মানুষের শক্তির প্রতি, তার বীরত্বের প্রতি অনাস্থাও সমানভাবে অটুট। তাই নজরুলের ভাষায়, শান্ত থাকার অবকাশ মিলছে না। চতুষ্পর্শের প্রতিবাদহীন মেরুদণ্ডহীনতার পরিপ্রেক্ষিতে বিপুলভাবে কাম্য হয়ে উঠেছে
‘উন্নত মম শির'-
এর বজ্রদীপ্ত ঘোষণা ।
শোষণ, পীড়ন আর বৈষম্য থেকে মুক্তির সংকল্প নিয়ে মানুষের । অপরিমেয় শক্তির উদ্বোধন ঘটিযে নজরুল কথিত বিদ্রোহের রণে অবতীর্ণ হওয়ার যেন বিকল্প নেই।
বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাঙালির জাতিরাষ্ট্রিক বিজয় দেখেছি, তাদের চোখে স্বদেশে ও স্বকালে নজরুলের 'বিদ্রোহী'র মূর্তিমান প্রতিকৃতির নাম ৭ ই মার্চের ভাষণ দানরত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, যিনি ঊর্ধলোকে তর্জনী উঁচিয়ে সামষ্টিক বাঙালির স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিমানুষের প্রান্তমুক্ত বিদ্রোহী সত্তার বাস্তব অভিব্যক্তিকেই মূর্ত করে তুলেছেন।
ব্যক্তিবাঙালি আর সর্বকালের সর্বপ্রান্তের ব্যক্তিমানুষের শক্তিমত্তার এই জয়গান মূলত প্রাকৃতিক - অপ্রাকৃতিক প্রতিকূলতাজয়ী মানবিক শক্তিরই অনিবার্য স্বীকৃতি। সভ্যতার ইতিবাচক অগ্রগমণের প্রয়োজনে যুগে যুগে এই মূর্ত প্রতীক বার বার ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তিতে আবির্ভূত হতে পারে। বিশ্বব্যাপী 'বিদ্রোহী 'র এই মঙ্গলশক্তির জয় হোক ।
উপসংহার : পরাধীন ভারতবর্ষে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো । ধূমকেতুর মতোই তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন দাসত্বের বিরুদ্ধে, শোষণে - শোষণে জর্জরিত জীর্ণ সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে । তার এই বিদ্রোহ সমাজের সর্বস্তরে ধেয়ে চলেছে। সর্বোপরি কবির বিদ্রোহ চেতনায় প্রবল অহমিকা প্রকাশিত হয়েছে।
আরো দেখুন :
৪র্থ সপ্তাহের নমুনা সমাধান :
Hsc 5th week ar assignment den
ردحذف