দ্বিতীয় অ্যাসাইনমেন্ট
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি (২য় পত্র)
২য় সপ্তাহ
ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সময় পরিক্রমা অনুযায়ী উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত বিবরণসহ একটি পোস্টার পেপার তৈরি করো।
নির্দেশনা :
(ক) মুহম্মদ বিন কাসিমের অভিযানের কারণ বর্ণনা।
(খ) সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য ও ফলাফল বিশ্লেষণ।
(গ) মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযান পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ।
(ঘ) উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি সম্বলিত পোস্টার তৈরিকরণ।
নমুনা সমাধান
ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সময় পরিক্রমা অনুযায়ী উল্লেখযােগ্য ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত বিবরণসহ একটি পােস্টার পেপার তৈরি করা হল :
(ক) মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযানের কারণ :
তৎকালীন ভারতের সিন্ধু ও মুলতানের রাজা ছিলেন দাহির। আরব সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ ইরাক প্রদেশের গভর্ণর ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। সিন্ধু ও মুলতানের সাথে আরব শাসনের সাধারণ সীমান্ত ছিল। নানা কারণে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও রাজা দাহিরের মধ্যে মতপার্থক্য হয়। এ কারণে হাজ্জাজ ভারতের সিন্ধু জয় করার জন্য তার জামাতা ও ভাতুস্পুত্র মুহম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে এক বিজয় অভিযান প্রেরণ করেন।
পরােক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণসমূহ : সিন্ধু বিজয়ের পরােক্ষ কারণসমূহের মধ্যে ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ এবং প্রত্যক্ষ কারণের মধ্যে ছিল জলদস্যুদের দ্বারা আরব বণিকদের জাহাজ লুণ্ঠন।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ : ভারত ধন - ঐশ্বর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। আরবদের সিন্ধু অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ধনরত্ন লাভ করা। রাজা দাহিরের রাজ্য ও আরব সাম্রাজ্যের মধ্যে সীমান্ত অভিন্ন হওয়ায় দুই রাজ্যে মধ্যে প্রায়ই মতানৈক্য ও মতবিরােধ সৃষ্টি হতাে এবং সীমান্ত সংঘর্ষ লেগেই থাকত। হাজ্জাজ ছিলেন কঠোর প্রকৃতির শাসক। আইনের শাসন এড়িয়ে হাজ্জাজের অঞ্চল থেকে অনেক অপরাধী রাজা দাহিরের রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। এ সকল কারণে রাজনৈতিক তিক্ততা উত্তরােত্তর বাড়তে থাকে। এই সময় সিন্ধুতে চলছিল রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা । দাহির ছিলেন অত্যাচারী শাসক। নিম্নশ্রেণির লােকেরা ছিল অত্যাচারিত, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনাে রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। সুতরাং এ সুযােগ কাজে লাগিয়ে হাজ্জাজ সিন্ধু জয় করে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলেন। ভারতে ইসলাম প্রচার করাও হাজ্জাজের একটি উদ্দেশ্য ছিল।
(খ) সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য ও ফলাফল :
রাজনৈতিক কারণ : সুলতান মাহমুদের পিতা সবুক্তগীনের সময় থেকে গজনির সাথে পাঞ্জাবের হিন্দুশাহী বংশের বিরােধ চলছিল। পাঞ্জাবের হিন্দুশাহী রাজ্যের রাজা জয়পাল সবুক্তগীনের শত্রু হওয়ায় সুলতান মাহমুদ জয়পালের সাথে শত্রুতা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। ভারতের অনেক রাজা জয়পালের সাথে মাহমুদ বিরােধী জোটে যােগদান করেন। সুতরাং মাহমুদকে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করতে হয়। আবার ভারতের কোন কোন রাজা মাহমুদের সাথে বন্ধুত্ব সূত্রে আবদ্ধ হয়। এতে তাদের প্রতিবেশী রাজ্যবর্গ তাদের প্রতি বৈরী আচরণ শুরু করেন। মিত্রবর্গের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যও মাহমুদকে ভারতে অভিযান করতে হয়। পরাজিত রাজারা মাহমুদের সাথে সন্ধি করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সুযােগ পেয়ে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করেন বিদ্রোহী রাজাদের সন্ধির শর্ত পালনে বাধ্য করার জন্যও মাহমুদকে অভিযান করতে হয়।
অর্থনৈতিক কারণ : সুলতান মাহমুদ রাজধানী গজনিকে তিলােত্তমা নগরীতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানী-গুণীর পৃষ্ঠপােষক। তার ছিল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী। তিনি দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। এসবের জন্য তার প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন ছিল। তখন ভারতছিল সম্পদশালী দেশ। এখানকার বিভিন্ন রাজ্যের কোষাগার ধনরত্নে পূর্ণ ছিল। ধর্মপ্রাণ বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ অকাতরে মন্দিরগুলােতে দান করতাে। মন্দিরকে নিরাপদ বিবেচনা করে অনেক সময় রাজারাও তাতে ধনরত্ন সংরক্ষণ করতেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সুলতান মাহমুদের নজর ভারতের উপর পড়ে। এজন্য তিনি প্রায় প্রতি বছর ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন এবং ভারত থেকে প্রচুর ধন-রত্ন নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যান। প্রফেসর হাবিব, প্রফেসর নাজিম ও হেইগ প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিকগণ সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কারণকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই বলে মাহমুদকে লুণ্ঠনকারী বা অর্থলােলুপ তস্কর বলা যাবে। কারণ ভারত থেকে সংগৃহীত অর্থ তিনি মানব কল্যাণে ব্যয় করেন। নিজের ভােগ-বিলাসের জন্য তিনি সে অর্থ ব্যবহার করেন নি।
সামরিক উদ্দেশ্য : সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি সামরিক উদ্দেশ্য ছিল। তার রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধু দখল করা অত্যন্ত প্রয়ােজন ছিল। এ সকল অঞ্চল ছিল সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ সমরবিদ হিসেবে তার অশ্বারােহী ও পদাতিক বাহিনী ছিল সুশৃংঙ্খল ও সমরনিপুণ। তিনি বুঝতে পারেন এ সকল অঞ্চল জয় করতে তাকে খুব একটা বাধার সম্মুখীন হতে হবে না সুতরাং তিনি বার বার ভারত আক্রমণ করে তার সামরিক উদ্দেশ্য হাসিল করেছিলেন।
ধর্মীয় উদ্দেশ্য : সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের পশ্চাতে কোন কোন ঐতিহাসিক ধর্মীয় উদ্দেশ্যও কার্যকর ছিল বলে মনে করেন। তাদের মতে তিনি ভারতে ইসলাম প্রচারে অভিলাষী ছিলেন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই মত সমর্থন করেন না। তারা মনে করেন মাহমুদের যুগে শাসকগণ ইসলাম প্রচার করা তেমন কর্তব্য বলে মনে করতেন না। তিনি ভারত অভিযানে এসে কোন বিধর্মীকে বলপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেননি। এছাড়া মাহমুদ হিন্দু মন্দির দখল করেছেন ধর্ম বিদ্বেষের কারণে নয়, বরং অর্থ পাওয়ার আশায়। এ সকল মন্দির ছিল যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত সম্পদে পূর্ণ। সর্বোপরি তার সেনাবাহিনীতে হিন্দু সৈন্যের উপস্থিতি তার ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যকে অনুমােদন করে না।
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের ফলাফল : সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের প্রভাব সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারতে অনুভূত হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই অভিযানের প্রভাব ছিল ব্যাপক। সুলতান মাহমুদ অভিযান করেছেন , জয়লাভ করেছেন এবং ধন-সম্পদ নিয়ে নিজের রাজ্য গজনিতে ফিরে গিয়েছেন। শুধু পাঞ্জাবের কিয়দংশ এবং মুলতান ছাড়া ভারতের কোনাে অঞ্চল তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন নি এবং কোন স্থায়ী সাম্রাজ্যও প্রতিষ্ঠা করেন নি। কয়েকজন রাজা অবশ্য তাকে কর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর সাথে সাথে এই সকল রাজা কর প্রদান বন্ধ করেন। তবে এ কথাও সত্য যে, সুলতান মাহমুদের বিজয় স্থায়ী না হলেও তার বিজয়ই পরবর্তীকালে মুসলমানদের ভারত বিজয়ের পথ সুগম করেছিল। সুলতান মাহমুদের বার বার আক্রমণ উত্তর ভারতের রাজন্যবর্গের সামরিক শক্তি দুর্বল করে দিয়েছিল। সামরিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন বলে পরবর্তী মুসলমান আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভবপর হয় নি। সুলতান মাহমুদের অভিযানের সময় ভারতীয় সামরিক শক্তি ও রণকৌশল মুসলমানদের সামরিক শক্তি ও যে কত দুর্বলতা প্রকটভাবে রণকৌশলের তুলনায় যে কত দুর্বলতা, প্রকটভাবে ধরা পড়ে। মাহমুদ ভারতের সমৃদ্ধ জনপদ, নগর, দুর্গ ও মন্দির আক্রমণ করেন ধন-রত্ন লাভ করার জন্য। এই জন্য এ সকল লক্ষ্যস্থল থেকে তিনি প্রচুর সম্পদ নিজ রাজধানী গজনিতে নিয়ে যান। এর ফলে ভারত অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। অপরদিকে গজনি অর্জন সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের ফলাফল ছিল লক্ষ্যনীয়। তিনি ভারতীয় পন্ডিতদের নিকট ভারতের দর্শন, সমাজ ব্যবস্থা ও কৃষি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন। এর ফল স্বরূপ তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'কিতাব-উল-হিন্দ' প্রণয়ন করেন। গ্রন্থটি ভারত ইতিহাসের অমূল্য উপকরণ। মাহমুদের অভিযানের ফলে ইসলামি সভ্যতা ও ভারতীয় সভ্যতার মধ্যে ভাব বিনিময় ঘটে।
(গ) মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযান পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা :
আফগানিস্তান, কাশ্মীর ও কনৌজ :
মৌর্য বংশের শাসনামল থেকেই আফগানিস্তান ছিল ভারতের একটি অংশ। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এটিকে হিন্দুশাহী রাজ্য বলে অভিহিত করেন। সপ্তম শতাব্দিতে কর্কট রাজবংশীয় দুর্লভ বর্ধনের অধীনে কাশ্মীর ছিল উত্তর ভারতের অপর একটি স্বাধীন রাজ্য। তিনি কনৌজ, কামরূপ,কলিঙ্গ ও গুজরাট জয় করেন বলে জানা যায়। কর্কট বংশের অপর একজন শাসক জয়পীড় গৌড় ও কনৌজের নৃপতিদের পরাজিত করেন। অষ্টম শতাব্দী প্রথম দিকে কনৌজ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপুর্ণ রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হত হত। তিনি গৌড় জয় এর রাজাকে হত্যা করেন এবং কাশ্মীর রাজ ললিতাদিত্যের সহায়তায় তিব্বত অভিযান করেন। তিনি চীনে দুত প্রেরণ করেন। কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য কর্তৃক তিনি পরাজিত ও নিহত হন। যশােবর্মণ, সিন্ধুরাজ দাহিরের সমসাময়িক ছিলেন। অত:পর অষ্টম শতকের প্রথম দিকে কনৌজে গুরজর - প্রতিহার রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
সিন্ধু ও মালব- দিল্লি ও আজমীর :
সপ্তম শতকে সিন্ধু ছিল হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যভূক্ত। পরবর্তীতে 'চাচ' নামক সিন্ধুর জনৈক ব্রাহ্মণ মন্ত্রী সিন্ধুতে স্বাধীন রাজবংশের গােড়াপত্তন করেন। চাচের পুত্র রাজা দাহির কে পরাজিত করে ইমাদউদ্দীন মুহাম্মদ বিন কাশিম ৭১২ সালে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এ রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। প্রতিহার রাজপুতদের দ্বারা শাসিত মালব ছিল উত্তর ভারতের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। উজ্জয়িনী ছিল এ রাজ্যের রাজধানী। দ্বাদশ শতকে মুসলিম অভিযানের প্রাক্কালে দিল্লি ও আজমীরে শক্তিশালী চৌহান বংশীয় রাজপুত্রগণ রাজত্ব করত।
গুজরাট, আসাম ও নেপাল :
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে গুজরাট ছিল গুরজর প্রতীহার বংশের অধীনে। অত:পর তাদের আধিপত্য ক্ষুন্ন করে চালক ও ভাগেলা বংশ পর্যায়ক্রমে শাসন করে। নবম শতাব্দীতে চান্দেলা বংশ বুন্দেলখন্ডে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। শেষ রাজা গন্ড ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদের নিকট পরাজিত হন। ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তসীমায় অবস্থিত একটি রাজ্য হল আসাম। এটি হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়। এ সময় রাজা শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার স্বাধীন নৃপতি। হর্ষবর্ধনের সমস্যময়িক এই শাসকের মৃত্যুর পর বাংলায় মারাত্মক গােলযােগ ও বিশৃংঙ্খলা দেয়। নেপাল সপ্তম শতাব্দিতে অপর একটি স্বাধীন রাজ্য।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি (১ম পত্র)
১ম সপ্তাহ
প্রাক ইসলামি যুগে শহরবাসি ও মরুবাসি যাযাবরদের জীবনে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক,
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রভাবসমূহের তুলনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করো।
নির্দেশনা :
(ক) প্রাক ইসলামি যুগের শহরবাসি ও মরুবাসি আরবদের আর্থ-সামাজিক জীবনযাত্রার
পার্থক্য নিরূপণ।
(খ) প্রাক ইসলামি যুগের রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাখ্যা।
(গ) প্রাক ইসলামি যুগের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিশ্লেষণ।
(ঘ) প্রাক ইসলামি যুগের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডর মূল্যায়ন।
(ঙ) প্রাক ইসলামি যুগের উৎকৃষ্ট গুণাবলি ও দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়ন।
নমুনা সমাধান
(ক) প্রাক ইসলামী যুগে শহরবাসী এবং মরুবাসী আরবদের আর্থসামাজিক জীবনযাত্রা
:
ভূ-প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে আরবের অধিবাসীদের দু'শ্রেণিতে বিভক্ত করা
যায়-শহরের স্থায়ী বাসিন্দা ও মরুবাসী যাযাবর, যারা বেদুইন’ নামে পরিচিত। এ
দুশ্রেণির আচার-ব্যবহার, জীবনযাত্রার প্রণালী, ধ্যান-ধারণা, আশা-আকাঙ্খার
মধ্যে যথেষ্ট প্রভেদ রয়েছে। অনেক মরুবাসী আরব বেদুইন জীবন ত্যাগ করে শহরে
স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। অপরদিকে দারিদ্রের কষাঘাত সহ্য করতে না পেরে
কিছু সংখ্যক স্থায়ী বাসিন্দা বাধ্য হয়ে যাযাবর বৃত্তি গ্রহণ করে।
(ক) শহরবাসী ও আরবের উর্বর তৃণ-অঞ্চলগুলাে স্থায়ীভাবে বসবাসের উপযােগী বলে
অসংখ্য জনপদ গড়ে উঠেছে। কৃষিকার্য, ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রভৃতি ছিল স্থায়ী
বাসিন্দাদের প্রধান জীবিকা। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করার ফলে এরা
ছিল মরুবাসী বেদুইনদের তুলনায় অধিকতর রুচিসম্পন্ন ও মার্জিত।
(খ) মরুবাসী যাযাবর ও আরব অধিবাসীদের অধিকাংশই স্বাধীনচেতা, বেপরােয়া ও
দুর্ধর্ষ মরুবাসী বেদুইন। সমাজের ধরাবাঁধা শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে স্থায়ীভাবে
শহরে বসবাস করার পরিবর্তে বেদুইনগণ জীবনধারণের জন্য মরুভূমির সর্বত্র ঘুরে
বেড়াত। তারা তৃণের সন্ধানে এক পশুচারণ হতে অন্য পশুচারণে গমন করত। তাদের গৃহ
হচ্ছে তাবু, আহার্য উটের মাংস, লুটতরাজ। ও বেদুইনের মধ্যে আক্রমণ ও পাল্টা
আক্রমণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
আর্থসামাজিক উন্নয়নে শহরবাসী এবং মরুবাসীদের মাঝে পার্থক্য -
শহরবাসী | মরুবাসী |
---|---|
১) আরবের তৃণ অঞ্চলগুলাে বসবাসের উপযােগী ছিল বলে অসংখ্য জনবসতি গড়ে উঠেছিল। ২) কৃষিকার্য ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ছিল স্থায়ী। ৩) বহির্বিশ্বের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করার ফলে বেদুইনদের থেকে তারা ছিল অত্যন্ত রুচিসম্পন্ন ও মার্জিত। ৪) একই স্থানে দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে তাদের সমাজে তারা ছিল সচ্ছল। |
১) বেদুইনরা পশুর তৃণের সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করত। ২) তারা ছিলাে স্বাধীনচেতা ও বেপরােয়া। ৩) তাদের প্রধান পেশা ছিলাে লুটতরাজ। ৪) তাদের গৃহ হচ্ছে তাবু, আহার্য উটের মাংসএবং পানীয় উট ও ছাগলের দুগ্ধ। তাদের সমাজে অভাব-অনটন লেগেই থাকতাে। |
(খ) প্রাক আরবের রাজনৈতিক অবস্থা ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের রাজনৈতিক অবস্থা বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এবং হতাশাব্যঞ্জক
ছিল। কোনাে কেন্দ্রীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব না থাকায় আরবে গােত্র প্রাধান্য লাভ করে। তাদের মধ্যে কোনাে ঐক্য
ছিল না। গােত্রসমূহের মধ্যে সব সময় বিরােধ লেগেই থাকত।
গােত্রীয় শাসন : অন্ধকার যুগে আরবের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বিশৃঙ্খলা,
স্থিতিহীন ও নৈরাজ্যের অন্ধকারে ঢাকা। উত্তর আরবে বাইজান্টাইনও দক্ষিণ আরবের পারস্য প্রভাবিত কতিপয় ক্ষুদ্র রাজ্য ব্যতীত
সমগ্র আরব এলাকা স্বাধীন ছিল। সামান্য সংখ্যক শহরবাসী ছাড়া যাযাবর শ্রেণির গােত্রগুলাের মধ্যে গােত্রপতির শাসন
বলবৎ ছিল। গােত্রপতি বা শেখ নির্বাচনে শক্তি, সাহস, আর্থিক স্বচ্ছলতা, অভিজ্ঞতা, বয়ােজ্যষ্ঠতা ও বিচার বুদ্ধি বিবেচনা। শেখের আনুগত্য ও গােত্ৰপ্ৰীতি প্রকট থাকলেও তারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতি সর্বদা সচেতন ছিলেন। ভিন্ন গােত্রের
প্রতি তারা চরম শত্রুভাবাপন্ন ছিল। গােত্রগুলাের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি মােটেই ছিল না। কলহ বিবাদ নিরসনে বৈঠকের
ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। শেখের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক জীবন ধারার ছােয়া থাকলেও শান্তি ও নিরাপত্তার লেশমাত্র ছিল না।
গােত্র-দ্বন্দ : গােত্র কলহের বিষবাষ্পে অন্ধকার যুগে আরব জাতি কলুষিত ছিল।
গােত্রের মানসম্মান রক্ষার্থে তারা রক্তপাত করতেও কুণ্ঠাবােধ করত না। তৃণভূমি, পানির ঝর্ণা এবং গৃহপালিত পশু নিয়ে
সাধারণত রক্তপাতের সূত্রপাত হত। কখনও কখনও তা এমন বিভীষিকার আকার ধারণ করত যে দিনের পর দিন এ যুদ্ধ চলতে থাকত।
আরবিতে একে আরবের দিন বলে অভিহিত করা হত। আরবের মধ্যে খুনের বদলা খুন, অথবা রক্ত বিনিময় প্রথা
চালু ছিল। অন্ধকার যুগের অহেতুক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নজীর আরব ইতিহাসে এক কলঙ্কময়
অধ্যায়। তন্মেধ্যে বুয়াসের যুদ্ধ, ফিজার যুদ্ধ ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে। উট, ঘােড়দৌড়, পবিত্র মাহ, কুৎসা রটনা করে
ইত্যাদি ছিল এ সকল যুদ্ধের মূল। বেদুইনগণ উত্তেজনাপূর্ণ কবিতা পাঠ করে যুহর ময়দানে রক্ত প্রবাহে মেতে উঠত। এ সকল অন্যায় যুদ্ধে জানমালের বিপুল ক্ষতি সাধিত হত। যুদ্ধপ্রিয় গােত্রগুলাের মধ্যে আউস, খাযরা, কুরাইশ,
বানু বকর, বানু তাগলিব, আৰস ও জুবিয়ান ছিল প্রধান।
(গ) প্রাক আরবের ধর্মীয় অবস্থা :
জাহেলিয়া যুগে আরবদের ধর্মীয় অবস্থা অত্যন্ত শােচনীয় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন
ছিল। আরবে তখন অধিকাংশ লােকই ছিল জড়বাদী পৌত্তলিক। তাদের ধর্ম ছিল পৌত্তলিকতা এবং বিশ্বাস ছিল আল্লাহর
পরিবর্তে অদৃশ্য শক্তির কুহেলিকাপূর্ণ ভয়ভীতিতে। তারা বিভিন্ন জড়বস্তুর উপাসনা করত। চন্দ্র, সূর্য, তারকা এমনকি বৃক্ষ,
প্রস্তরখস্ত, কূপ, গুহাকে পবিত্র মনে করে তার পূজা করত। প্রকৃতি পূজা ছাড়াও তারা বিভিন্ন মূর্তির পূজা করত। মূর্তিগুলাের গঠন ও
আকৃতি পূজারীদের ইচ্ছানুযায়ী তৈরি করা হতাে। পৌত্তলিক আরবদের প্রত্যেক শহর বা অঞ্চলের নিজস্ব দেবীর মধ্যে অন্যতম ছিল
আল-লাত, আল-মানাহ এবং আল-উজ্জা। আল-লাত ছিল তায়েফের অধিবাসিদের দেবী, যা চারকোণা এক পাথর। কালাে পাথরের তৈরি
আল-মানাহ ভাগ্যের দেবী। এ দেবীর মন্দির ছিল মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী কুদায়ে স্থান। মদিনার আউস ও
খাজরাজ গােত্রের লােকেরা এ দেবীর জন্য বলি দিত এবং দেবীকে সম্মান করত। নাখলা নামক স্থানে অবস্থিত মক্কাবাসীদের অতি
প্রিয় দেবী আল-উজ্জাকে কুরাইশগণ খুব শ্রদ্ধা করত।
আরবদেশে বিভিন্ন গােত্রের দেবদেবীর পূজার জন্য মন্দির ছিল। এমনকি পবিত্র কাবা
গৃহেও ৩৬০ টি দেবদেবীর মূর্তি ছিল। কাবাঘরে রক্ষিত মূর্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বা দেবতার নাম ছিল হোবল।
এটি মনুষ্যাকৃতির ছিল - এব পাশে ভাগ্য গণনার জন্য শর রাখা হতাে।
(ঘ) প্রাক আরবের সাংস্কৃতিক অবস্থা :
বর্তমান যুগের ন্যায় প্রাক-ইসলামি যুগে আরব বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ও সংস্কৃতি
না থাকলেও আরবরা সাংস্কৃতিক জীবন হতে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল না। তাদের ভাষা এত সমৃদ্ধ ছিল যে, আধুনিক ইউরােপের
উন্নত ভাষাগুলাের সাথে তুলনা করা যায়।
উকাজের সাহিত্য মেলা ও প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল
তাদের বাগ্মিতা। জিহ্বার অফুরন্ত বাচন শক্তির অধিকারী প্রাচীন আরবের কবিরা মক্কার অদূরে উকাজের বাৎসরিক মেলায়
কবিতা পাঠের প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। উকাজের বাৎসরিক সাহিত্য সম্মেলনে পঠিত সাতটি ঝুলন্ত কবিতাকে
সাবা আল মু'আল্লাকাত বলা হয়। হিট্টি উকাজের মেলাকে আরবের Academic francaise
বলে আখ্যায়িত করেন। তখনকার যুগের কবিদের মধ্যে যশস্বী ছিলেন উক্ত সাতটি ঝুলন্ত গীতি
কাব্যের রচয়িতাগণ। সােনালী হরফে লিপিবদ্ধ এ সাতটি কাব্যের রচনা করেন আমর ইবনে কুলসুম, লাবিহ ইবন রাবিয়া, আনতারা ইবন
শাদদাদ, ইমরুল কায়েস, তারাফা ইবনে আবদ, হারিস ইবনে হিলজা ও জুহাইর ইবন আবি সালমা। এদের মধ্যে অসাধারণ
প্রতিভাশালী ছিলেন ইমরুল কায়েস। তিনি প্রাক-ইসলামি যুগের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করেন। ইউরােপীয় সমালােচকগণও
তার উৎকৃষ্ট শব্দ চয়ন, সাবলীল রচনাশৈলী, চমকপ্রদ স্বচ্ছ লহরীতে মুগ্ধ হয়ে তাকে আরবের শেক্সপীয়র বলে আখ্যায়িত করেন।
আরবি ভাষায় এরূপ উন্নতি ও সমৃদ্ধি সাধনে হিট্টি মন্তব্য করেন, ইসলামের জয় অনেকাংশে একটি ভাষার জয়, আরও
সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে একটি ধর্মগ্রন্থের জয়।
কবিতার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চেতনা ও প্রাক-ইসলামি যুগে লিখন প্রণালির তেমন
উন্নতি হয়নি বলে আরবগণ তাদের রচনার বিষয়বস্তুগুলাে মুখস্ত করে রাখত। তাঁদের স্মরণ শক্তি ছিল খুব প্রখর। তারা
মুখে কবিতা পাঠ করে শুনাত। কবিতার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশ পেত। এ জন্যেই লােক-গাঁথা, জনশুতির উপর নির্ভর
করে পরবর্তীকালে আরব জাতির ইতিহাস লিখিত হয়েছে। আরব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আরবি গীতিকাব্য অথবা কাসীদা সমসাময়িক
কালের ইতিহাসে অতুলনীয়। ৫২২ হতে ৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রচনার সাবলীল গতি ও স্বচ্ছ বাক্য বিন্যাসে বৈশিষ্ট্য
থাকলেও এর বিষয়বস্তু রুচিসম্মত ছিল না। যুদ্ধের ঘটনা, বংশ গৌরব, বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, যুদ্ধের বিবরণ, উটের বিস্ময়কর গুণাবলী
ছাড়াও নারী, প্রেম, যৌন সম্পর্কিত বিষয়ের উপর গীতিকাব্য রচনা করা হত। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, “কাব্যপ্রীতিই ছিল
বেদুঈনদের সাংস্কৃতিক সম্পদ।” প্রাক-ইসলামি কাব্য সাহিত্যের প্রথম পর্যায়ে মিলযুক্ত গদ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। কুরআন
শরীফে এ ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কাব্য চর্চার রীতির মধ্যে উষ্ট্র চালকের ধ্বনিময় সঙ্গীত (হুদা) এবং জটিলতার ছন্দ অন্তর্ভূক্ত
ছিল। কিন্তু কাসীদা ছিল একমাত্র উক্তৃষ্ট কাব্যরীতি। বসুস যুদ্ধে তাঘলিব বীর মুহালহিল সর্বপ্রথম দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। জোরালাে
আবেগময় সাবলীল ভাষা ও মৌলিক চিন্তা ধারায় এটি ছিল পুষ্ট।
উকাজের সাহিত্য মেলা ও প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল
তাদের বাগ্মিতা। জিহ্বার অফুরন্ত বাচন শক্তির অধিকারী প্রাচীন আরবের কবিরা মক্কার অদূরে উকাজের বাৎসরিক মেলায়
কবিতা পাঠের প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। উকাজের বাৎসরিক সাহিত্য সম্মেলনে পঠিত সাতটি ঝুলন্ত কবিতাকে
সাবা আল মু'আল্লাকাত বলা হয়। হিন্তি উকাজের মেলাকে আরবের Academic
francaise বলে আখ্যায়িত করেন। তখনকার যুগের কবিদের মধ্যে যশস্বী ছিলেন উক্ত সাতটি ঝুলন্ত গীতি
কাব্যের রচয়িতাগণ। সােনালী হরফে লিপিবদ্ধ এ সাতটি কাব্যের রচনা করেন আমর ইবনে কুলসুম, লাবিহ ইবন রাবিয়া, আনতারা ইবন
শাদদাদ, ইমরুল কায়েস, তারাফা ইবনে আবদ, হারিস ইবনে হিলজা ও জুহাইর ইবন আবি সালমা। এদের মধ্যে অসাধারণ
প্রতিভাশালী ছিলেন ইমরুল কায়েস। তিনি প্রাক-ইসলামি যুগের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করেন। ইউরােপীয় সমালােচকগণও
তার উৎকৃষ্ট শব্দ চয়ন, সাবলীল রচনাশৈলী, চমকপ্রদ স্বচ্ছ লহরীতে মুগ্ধ হয়ে তাকে আরবের শেক্সপীয়র বলে আখ্যায়িত করেন।
আরবি ভাষায় এরূপ উন্নতি ও সমৃদ্ধি সাধনে হিট্টি মন্তব্য করেন, ইসলামের জয় অনেকাংশে একটি ভাষার জয়, আরও
সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে একটি ধর্মগ্রন্থের জয়।
সাহিত্য আসরের আয়ােজন : তৎকালীন আরবে সাহিত্য চর্চায় আরবদের আগ্রহ ছিল
স্বতঃস্ফুর্ত। অনেক সাহিত্যমােদী আরব নিয়মিত সাহিত্য আসরের আয়ােজন করতেন। সাহিত্য আসরের উদ্যোক্তাদের মধ্যে
তাকিব গােত্রের ইবনে সালাময়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। প্রতি সপ্তাহে তিনি একটি সাহিত্য আসরের আয়ােজন
করতেন। আরবদের সাহিত্য প্রীতির কথার উল্লেখ করে ঐতিহাসিক হিট্টি বলেছেন, “পৃথিবীতে সম্ভবত অন্যকোনাে জাতি আরবদের
ন্যায় সাহিত্য চর্চায় এতবেশি স্বতঃস্ফুর্ত
আগ্রহ প্রকাশ করেনি এবং কথিত বা লিখিত শব্দ দ্বারা এত আবেগা হয়নি। এ সমস্ত
সাহিত্য আসরে কবিতা পাঠ, সাহিত্য বিষয়ক আলােচনা ও সমালােচনা অনুষ্ঠিত হত।
কবিতার বিষয়বস্তু : প্রাক-ইসলামি যুগের সাহিত্যিকগণ তাদের গােত্র ও গােত্রীয়
বীরদের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, যুদ্ধের বিবরণ, উটের বিস্ময়কর গুণাবলী, বংশ গৌরব, অতিথি পরায়ণতা, নরনারীদের প্রেম,
নারীর সৌন্দর্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করতেন। তাদের এ সকল কবিতা সুদূর অতীতকালের ইতিহাসের একটি
গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি প্রাক-ইসলামি আরবদের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলােকপাত করে।
(ঙ) প্রাক ইসলামী যুগের উৎকৃষ্ট গুণাবলি :
মরুভূমিতে রাত্রি ভীতিসংকুল ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানবের আনাগােনা’- এ সাধারণ
বিশ্বাস মরুভূমির বিপদ হতে পথিককে রক্ষা করার জন্য আরবদের মধ্যে অতিথিপরায়ণতা বিকশিত করেছিল। মরুভূমি অনুর্বর
ও পর্বতাঞ্চলের আরব সমাজ গােত্রভিত্তিক ছিল। গােত্র-নিরাপত্তা ও বহিরাক্রমণের ভয় তাদেরকে
গােত্রপ্রিয় করে তুলেছিল। এ গােত্রপ্রীতি তাদের মধ্যে জন্মদেয় মনুষ্যত্ব, আত্মসংযম, স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের। শেখের নিকট সকল নাগরিকের
অধিকার সমান। এরূপ পরিস্থিতিতে উন্নততর ধর্মে-কর্মে তাদের শিথিলতা পরিলক্ষিত হওয়াই স্বাভাবিক। আরব
ভূ-খণ্ডের অনুদার পরিবেশ, খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব, নির্দিষ্ট চলাচলের পথ না থাকায় বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে আরব্বাসীরা
সব সময় নিরাপদ থেকেছে। ভৌগােলিক প্রভাবের কারণে শহরবাসী আরব ও মরুবাসী বেদুইনদের মধ্যে
আত্মসচেতনাবােধ ও কাব্যিক চেতনার উম্মেষ ঘটে। আরববাসীরা ছিল কাব্যের প্রতি অধিক মাত্রায় অনুরক্ত। গীতিকাব্য রচনা ও
সাহিত্যচর্চায় আরবদের অপূর্ব সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। আরব কবিগণ ভৌগােলিক পরিবেশে যে কাব্য রচনা করেন তা
সংঘাত, অদম্য সাহসিকতা, বীরত্ব, গােত্রপ্রীতি ও প্রেম সম্পর্কিত।