'নিশুর নোটবুক' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।
নিশুর নোটবুক
ছোটবেলায় প্রতিদিন নতুন নতুন ইংরেজি, বাংলা শব্দ শেখা সুমনার পড়ার রুটিনের বাইরে একটি আবশ্যকীয়করণ কাজ ছিল। সেই সাথে অনেক ভালো ভালো বাক্য, নীতিকথা, কবিতার লাইন মুখস্ত করা ছিল তার প্রিয় শখ। যেমন- Honesty is the best policy; Virtue is its own reward; Read while you read, play while you play; সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই; মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য; সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে; জ্ঞানই শক্তি; চরিত্রই সম্পদ; একতাই বল ইত্যাদি । স্কুলে শিক্ষকতা করতে এসে তার ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও সে নির্দেশ দিয়েছিল- তোমরা প্রত্যেকেই নোটবুক নিয়ে আসবে, আমি বোর্ডে যেসব শব্দ লিখে দিব সেসব শব্দ মুখস্ত করে ফেলবে। ছাত্র-ছাত্রীরাও তার কথা মতো আলাদা নোটবুক নিয়ে এলো, নতুন নতুন শব্দে তাদের নোটবুক ভরে তুলতে লাগল। প্রতি ক্লাসের মতো আজও সুমনা ব্ল্যাকবোর্ডে নতুন নতুন শব্দ লিখছে, ছাত্র-ছাত্রীরা সেগুলো নোটবুকে তুলে নিচ্ছে। সুমনা হঠাৎ ক্লাসের পিছনে তাকিয়ে দেখলেন একটি মেয়ে লিখছে না, পেছনের বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে। 'নিশু...' -সুমনা ম্যাডামের উচ্চ কন্ঠে সবাই চমকে উঠল।সবাই ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল 'নিশু' দাঁড়িয়ে কাঁপছে। কান্না আর ভয়মিশ্রিত ক্ষীণকন্ঠে নিশু বলল-
- আমার নোট বুকটি হারিয়ে ফেলেছি।
- হারিয়ে ফেলেছ? কোথায়?
- রাস্তায়, আসার সময় পড়ে গিয়েছে।
- কেন? পড়ে যায় কেন? রাস্তায় কী নৃত্য করতে করতে চলো? নোটবুকটা যত্নে রাখতে পারলে না, রাস্তাকে দান করে এলে? চমৎকার! এখন ক্লাসে বসে বসে....
লজ্জায়, কষ্টে মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল নিশু। সুমনা ম্যাডামের কথার শ্লেষ শুধু নিশুর নয়, ক্লাসের অন্যদের কানেও প্রচন্ড নির্মম লাগলো। তারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল কেউ কোন কথা বলতে সাহস পেল না। সহপাঠীদের একজন নিশুকে এক তা কাগজ দিতে চেয়েও সুমনা ম্যাডামের ভয়ে লুকিয়ে রাখল। ম্যাডাম ঘড়ি দেখল। তারপর বেত আর ডাস্টার হাতে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। ছুটির ঘন্টা বাজল। কিন্তু প্রতিদিনের মতো কেউ তাড়াহুড়ো করল না। ছুটির আনন্দ ভুলে নিঃশব্দে তারা বেরিয়ে গেল। হেডমিসট্রেজ তার কক্ষের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল- স্কুলের সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল অষ্টম শ্রেনির ছাত্র-ছাত্রীরা কেমন ক্লান্ত, বিষণ্ণ বদনে, দৃঢ়পদে স্কুল ত্যাগ করছে। বহু পরিশ্রম করে, পড়াশুনা করে পরীক্ষায় ফেল করার মতো কষ্টের চাপ তাদের চোখে-মুখে। চেয়ারে গিয়ে বসলেন। পানি খেলেন। অষ্টম শ্রেণির লাস্ট ক্লাস কার? কলিং বেল বাজিয়ে একজন আয়াকে বললেন- দেখ তো টিচার্স রুমে কেউ আছে কি না? আয়া এসে বলল- না ম্যাডাম কেউ নেই। হেডমিসট্রেজ আরিফা নিশাত চশমাটা খুলে মুছে আবার পড়লেন। তারপর ধীর পথে ক্লাস এইটের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজার বাইরে থেকে কোনাকোনিভাবে তাকালে ঐ ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ড দেখা যায়। তিনি দেখলেন ব্ল্যাকবোর্ড ব্যবহার করে আর মোছা হয় নি।
দেখেই বুঝতে পারলেন লেখা গুলো কার? তিনি লিখাগুলো পড়লেন.... Diamond-হীরা, Pearl-মুক্তা, Ruby-চুনি, Emerald-পান্না, Gold-সোনা।
তারপর ক্লাসরুমে ঢুকলেন। ভিতরে ভালোভাবে তাকাতেই তাঁর চোখ স্থির হয়ে এলো পিছনের সারির একটি বেঞ্চের ওপর। তিনি দেখলেন একজন ছাত্রী তখনও বসে আছে। তিনি নিঃশব্দে তার কাছে গেলেন। মেয়েটি হাই বেঞ্চের উপর কপাল ঠেকিয়ে দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে নিথর বসে আছে। তিনি বুঝতে পারলেন, বোর্ডের ঐ শব্দগুলোর কোনটি দিয়ে ডাকলে তার নিঁদ ভাঙবে।