ভূমিকা : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে হাজার বছরের ঐতিহ্য বিদ্যমান। এর প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ। সে চর্যাপদ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা। তার মধ্যে স্বদেশপ্রীতিমূলক কবিতার সংখ্যা একেবারে কম নয়।
প্রাচীন কাব্যে স্বদেশপ্রেম : বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ বা চর্যাগীতিকা। প্রায় হাজার বছর আগে বৌদ্ধ সহজিয়া সিকাড়াকাল যে সময়ে চর্যাপদগুলাে রচনা করেন, তখন ঘদেশের ধারণা বর্তমানকালের মতাে এতােটা সক্রিয় ছিল না। তাই আজকের দিনের মতাে দেশতির উজ্জ্বল প্রকাশও তখনকার কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে নি। তবে দেশের কথা, প্রকৃতির কথা যে তারা মনে করেছেন সে রকম কিছু খন্ডচিত্র যাপনে পাওয়া যায়। যেমন -
উঁচা উঁচা পাবত তাহি বসই সবরী বালী।
মােরঙ্গী পীচ্ছ পরহিন সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।
মধ্যযুগীয় কাব্যে স্বদেশপ্রেম : প্রাচীন যুগের পদকর্তাদের মতাে মধ্যযুগের কবিদের কাছেও স্বদেশের ধারণা আধুনিককালের কবিদের মত স্বচ্ছতা কখনাে নিসর্গের মধ্যে ব্যস্ত, আবার কখনো প্রকৃতিকে ভালােবেসে তার ভেতর দিয়ে ভালােবেসেছেন। স্বদেশকে, কখনাে বা মাতৃভাষাকে ভালােবাসার মধ্য দিয়ে স্বদেশপ্রীতির কথা তুলে ধরেছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে মধ্যযুগের অন্যতম কবি আবদুল হাকিমের কবিতা থেকে তুলে ধরা যায়—
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মন ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।
আবদুল হাকিম ছাড়াও মধ্যযুগের অনেক কবির কবিতায় সরাসরি না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে স্বদেশপ্রেম স্থান লাভ করেছে। মধ্যযুগের সর্বশেষ বড় কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র তার ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে বাংলাদেশের বর্ণনা ও গুণগান করেছেন। তার আগে আলাওল এবং পরে রামনিধি গুপ্তের কবিতায়ও স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। মধ্যযুগের শেষ ও আধুনিক যুগের প্রথম অর্থাৎ যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত জন্মভূমিকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর ‘স্বদেশ প্রীতি’ ও ‘জন্মভূমি’ কবিতায়ই সর্বপ্রথম স্বদেশপ্রেম অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে ওঠে। স্বদেশপ্রীতি 'কবিতায় কবি লিখেছেন-
জান না কিন্নর তুমি জননী জন্মভূমি
যে তােমার হৃদয়ে রেখেছে।
থাকিয়া মায়ের কোলে সন্তানের জননী ভােলে
কে কোথায় এমন দেখেছে?
আধুনিক কবিতায় স্বদেশপ্রীতি : আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য স্বদেশপ্রেম। প্রকৃতপক্ষে স্বদেশের বিমূর্ত ধারণাটি আধুনিক কবি সাহিত্যিকদের হাতেই সবচেয়ে বেশি মূর্ত এবং স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। জন্মভূমি এবং স্বদেশের নানা বিষয় নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। তার মধ্যে বঙ্গভূমির প্রতি, ভারতভূমি, বঙ্গভাষা, ঢাকা নগরী, কপােতাক্ষ নদ প্রভৃতি কবিতায় স্বদেশের প্রতি কবির ভালােবাসা প্রকাশ পেয়েছে। বিদেশে অবস্থানকালে ‘কপােতাক্ষ নদ’ কবিতায় কবি লিখেছেন -
বহুদেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে।
দেশপ্রেম : রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি বিখ্যাত কবিতা। পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর কবিতায় সবচেয়ে জোরালাে বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। স্বাধীনতার সুখ স্বর্গসুখের মতাে; এ সুখ অর্জনে কবির চিত্তে যেন ব্যাকুলতার ঝড় বয়ে যায়। এ ঝড় তাঁর দেশপ্রেমের ঝড়। কবির ভাষায়-
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙখল বল কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায়?
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেশপ্রেম নিখাদ, নির্মল এবং নিবিড়। দেশের জন্য জীবন দেওয়াকে তিনি গৌরবের বলে মনে করেন। কৃষ্ণচন্দ মজুমদারের ‘প্রবাসীর জন্মভূমি দর্শন’, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মীর মশাররফ হােসেনের জন্মস্থান’, গােবিন্দচন্দ্র দাসের ‘জন্মভূমি’, কায়কোবাদের ‘বাংলা আমার’, ‘বঙ্গভাষায় কাব্যকুঞ্জ’, ‘বঙ্গভূমি’, রবীন্দ্রনাথের ‘সােনার বাংলা’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আমার জন্মভূমি’, যতীন্দ্রমােহন বাগচীর ‘জন্মভূমি’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাংলাদেশ মম’, ‘বাংলা মায়ের রূপ’, ‘স্বদেশ আমার’, জীবনানন্দ দাশের ‘বাংলার পারে’, ‘বাংলার মুখ’, অমিয় চক্রবর্তীর ‘বাংলাদেশ’ প্রভৃতি কবিতায় স্বদেশপ্রেম অত্যন্ত উজ্জ্বল। বাংলা আমার কবিতায় কায়কোবাদ লিখেছেন-
বাংলা আমার, আমি বাংলার
বাংলা আমার। জন্মভূমি
গঙ্গা ও যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা,
বহিছে যাহার চরণ চুমি!
স্বদেশের প্রতি ভালােবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে আরও অনেক কবি কাব্য রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হােসেন, আশরাফ সিদ্দিকী, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, জাহানারা আরজু, মােহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দীন, মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মুজাহিদী, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, জাহিদুল হক, শাহাদাত বুলবুল, কাজী রােজী, লিলি হক উল্লেখযােগ্য।
উপসংহার : বাংলা সাহিত্যের কাব্য শাখাটি স্বদেশপ্রেমের কবিতায় সমৃদ্ধ। যুগে যুগে যত কবি জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদের অনেকেই লিখেছেন স্বদেশকে নিয়ে। অনাগতকালেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।