↬ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের কবিতা
↬ বাংলাদেশের কাব্য সাহিত্য
↬ আধুনিক বাংলা কবিতা
Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings.
-Wordsworth
ভূমিকা : বাংলাদেশ কবিতার দেশ। এদেশের কবিতার ইতিহাস হাজার বছরের ঐতিহ্য
সমৃদ্ধ। ইতিহাসকে আবার তিন ভাবে ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও
আধুনিক যুগ। প্রাচীন যুগের বাংলা কবিতার একমাত্র নির্ভরযােগ্য নিদর্শন চর্যাপদ।
নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার করেছেন স্বর্গীয়
মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। এরপর মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিতা, মঙ্গলকাব্য,
জীবনী কাব্য, রােমান্টিক প্রণয় কাব্য, মর্সিয়া সাহিত্য, কবিগান, বাউল গান
ইত্যাদি অতিক্রম করে শুরু হয়েছে আধুনিক যুগ। মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের মধ্যে সন্ধি
সৃষ্টি করেছেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম সার্থক আধুনিক
কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধুনিক বাংলা কবিতাকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে প্রতিষ্ঠিত
করেন।
কবিতার সংজ্ঞা : কবির বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ই কবিতার জন্মভূমি। কারও কারও মতে,
যিনি জগতের একখানি যথাযথ স্বাভাবিক চিত্রপট এঁকে দিতে পারেন, তিনিই যথার্থ কবি।
শ্রীশচন্দ্র দাশ তাঁর সাহিত্য ‘সন্দর্শন’ গ্রন্থের কবিতা অংশে বলেছেন,
“অপরিহার্য শব্দের অবশ্যম্ভাবী বাণী বিন্যাসকে কবিতা বলে।... অপরিহার্য শব্দ
যথা বিন্যস্ত হলেই তাদের মধ্যে চিত্রগুণ ও প্রবাহের সৃষ্টি হয় এবং শব্দসমূহ
তখন রসাত্মক বাক্যে সমর্পিত হয়ে অবশ্যম্ভাবী ছন্দোময় রূপলাভ করে।”
সুতরাং দেখা যায়, মানবমনের ভাবনা কল্পনা যখন অনুভূতিরঞ্জিত যথাবিহিত শব্দ
সন্ডারে বাস্তব সুষমামণ্ডিত চিত্রাঙ্ক ও ছন্দোময় রূপলাভ করে, তখনই তার নাম
কবিতা। কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Coleridge বলেন,
"Best words in the best order."
Wordsworth-এর মতে,
“Poetry is the spontaneous overflow of powerful feeling."
সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রে বলা হয়েছে
“শব্দার্থেী সহিতাে কাব্যং।"
বাংলা কবিতায় আধুনিকতা : সাহিত্যের আধুনিকতা সম্বন্ধে একটি ধারণা আছে,
সেটি বৃত্তাকার। অর্থাৎ অনেকের মতে, যা নতুন তাই আধুনিক। যখনই সাহিত্য ক্ষেত্রে
কোনাে নব্যসূত্রের আবির্ভাব ঘটে, কিংবা নদীর মতাে সাহিত্য যখন কোনাে নতুন বাঁক
নেয়, তখনই আধুনিকতার আবির্ভাব ঘটে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন,
“আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।” এ আধুনিকতা দেশ বা ইতিহাসে আবদ্ধ
নয়, তা পৃথিবীর নানা দেশের সাহিত্যে নানা সময়ে নিজেকে প্রকাশ করে। কিন্তু
আধুনিক বাংলা কবিতার আলােচনায় যে আধুনিকতার কথা বলা হয়, তা পুনরাবর্তনধর্মী
আধুনিকতা নয়। তা নেহাৎ একটি নির্দিষ্ট সাহিত্যের, একটি নির্দিষ্ট সময়ের বিশেষ
কতকগুলাে লক্ষণের সমষ্টি। এই আধুনিকতার সার্থকতম সংজ্ঞাটি নির্মাণ করেছিলেন
পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট সাহিত্য সমালােচক আবু সয়ীদ আইয়ুব-
“কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধপরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত,
অন্তত মুক্তিপ্রয়াসী কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি।”
পরবর্তী গবেষকদের গবেষণায় আধুনিক বাংলা কবিতার প্রেরণা ও প্রকরণের বহুবিধ লক্ষণ
নির্ণীত হয়েছে। স্থানভিত্তিক দিক থেকে তা নগরকেন্দ্রিক এবং শিল্পবিপ্লবপ্রসূত
যান্ত্রিক সভ্যতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, অথচ সে সঙ্গে প্রাদেশিক লােকায়ত বা
ঐতিহ্যগত চেতনার উর্ধ্বে ওঠে বাঙালি আধুনিক কবি আন্তর্জাতিক বিষয় ও ঘটনার সঙ্গে
শুধু যে নিজেকে যুক্ত করেন তাই নয়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানা বিষয়কেও নিজেদের
কবিতার অনুষঙ্গে গ্রহণ করেন। এই যন্ত্রসভ্যতাক্লিষ্ট নাগরিকতার প্রভাবেই আধুনিক
বাঙালি কবির কবিতায় ক্লান্তি ও নৈরাশ্যের সুর বেজে ওঠে।
ভাষাভঙ্গি ও কাব্য প্রকরণে আধুনিক কবিরা দুঃসাহসী প্রেরণা নিয়ে এলেন। তাঁদের
কবিতা চলিত বাগরীতির আরও কাছাকাছি এসে পৌছল, প্রথাগত কাব্যপ্রকরণ ত্যাগ করে তারা
নতুন উপমরূপক, চিত্রকল্প ইত্যাদি গ্রহণ করলেন। ঐতিহাসিকভাবে আলােচনা করলে দেখা
যায়, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকেই যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মােহিতলাল মজুমদার, কাজী
নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের হাতে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রারম্ভিক পর্যায়টি
আরম্ভ হয়েছিল।
যতীন্দ্রনাথ রাবীন্দ্রিক আনন্দের প্রতিবাদে দুঃখের সর্বব্যাপিত্ব প্রতিষ্ঠা করেন,
মােহিতলালের বলিষ্ঠ জীবনবাদ কেবল দেহের সীমানাকে গ্রহণ করেছিল, আর নজরুল বিদ্রোহ
ও বেদনার ধ্বজা উড়িয়ে নিজের রক্তলেখায় অত্যাচারী ও শােষকের ‘সর্বনাশ’ দেখতে
চেয়ে ছিলেন। তাদেরই সূত্র ধরে ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘কল্লোল’ এবং ঢাকায় ‘প্রগতি'
পত্রিকাকে কেন্দ্র করে প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, মনীশ ঘটক ও
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের নেতৃত্বে আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে।
বাইরে থেকে এই গােষ্ঠীকে সমৃদ্ধ করেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু
দে, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ কবি।
বাংলাদেশের কবিতা : বাংলাদেশের কাব্যশাখাটি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা
লাভের পূর্ব থেকেই সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছিল এবং তা সমৃদ্ধি লাভ করে ৪৭-এর পর।
বর্তমানে সাহিত্যের এই শাখাটি সর্বাধিক সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কাব্যের
আধিপত্য বরাবরই ছিল। এখানকার কাব্যে কবিপ্রাণের সহজ ও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য
প্রতিফলিত হয়েছে। কাব্যে অন্তরঙ্গ মনের এই পরিচয় ভাবের ক্ষেত্রে যে সমৃদ্ধি
আনয়ন করেছে তাতে এখানকার কাব্যধারার স্বাতন্ত্র্য ও পরিপুষ্টি লক্ষণীয়ভাবে
প্রকাশমান।
আধুনিক কবিতায় লালিত যে ঐতিহ্য পাশ্চাত্য সাহিত্যে বিরাজমান, বাংলাদেশের কবিরা
তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। ফলে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়েই এখানকার কবিতা
অগ্রসর হয়েছিল। বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যে দুটি ধারা বর্তমান। প্রথমদিকে ধারা
দুটি এগিয়েছে প্রতিযােগিতামূলকভাবে। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে মুসলমান
কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যে দুটি ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্য ছিল তা অনুসৃত হয়েছে
এখানে। একটি ধারায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছে, অন্যটি গতানুগতিক কাব্যধারার
অনুসারী। বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যে যাঁরা উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন তাদের
অনেকেই দেশবিভাগের পূর্বে কাব্য সাধনায় আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। এ পর্যায়ে যে কজন
কবি বাংলা কাব্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধি দান করেছেন তাদের মধ্যে গােলাম মােস্তফার নাম
অগ্রগণ্য।
কবি গােলাম মােস্তফা একদিকে যেমন ইসলামের বিষয়বস্তু অবলম্বনে কবিতা লিখে খ্যাতি
অর্জন করেছেন, অন্যদিকে তেমনি বিশুদ্ধ প্রেমকে উপজীব্য। করেছেন কবিতায়। এই প্রেম
কখনাে মানবিক, কখনাে ঐশ্বরিক। মুসলমানদের জাগরণের জন্যেও তিনি অনেক কবিতা রচনা
করেছেন। ‘রক্তরাগ’, ‘খােশরােজ’, ‘হাস্নাহেনা’, ‘কাব্যকাহিনী’, ‘সাহারা', ‘বনি
আদম’, ‘কাব্যে কোরআন ও বুলবুলিস্তান’ তাঁর উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ। শাহাদাৎ
হােসেন রবীন্দ্রকাব্যের অনুসারী কবি। স্বপ্নের কল্পনাজগতে তিনি সৌন্দর্যের
অনুসন্ধান করেছেন। ‘মৃদঙ্গ’, ‘কল্পলেখা’, ‘চিত্রপট’, ‘রূপচ্ছন্দা’ প্রভৃতি তার
কাব্যগ্রন্থ।
জসীমউদ্দীন একজন শক্তিশালী কবি। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের খাটি কবি। গতানুগতিক
কাব্যধারায় তিনি নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করে ‘পল্লীকবি’ নামে খ্যাতিলাভ করেছেন।
বাংলাদেশের পল্লিজীবনের নৈসর্গিক চিত্র স্বাভাবিক মাধুর্যে ফুটে উঠেছে তাঁর
কাব্যে। বাংলার পল্লিসঙ্গীতের সুরে রচিত গানগুলাে এদেশের মানুষের মনকে মাতিয়ে
তুলেছিল। জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, সােজন বাদিয়ার ঘাট', ‘বালুচর',
'ধানখেত’, ‘রাখালী’, ‘হাসু’, ‘মাটির কান্না’, ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’, ‘এক পয়সার
বাঁশি’ প্রভৃতি কাব্য বিশেষ সমাদৃত ও জনপ্রিয় হয়েছে। এ কাব্যগুলােতে তিনি
অসাধারণ দরদ এবং সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশের পল্লিগ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা
জীবন্ত করে তুলেছেন।
বেনজীর আহমদ নাম করেছেন ‘বন্দীর বাঁশী’ ও ‘বৈশাখী’ নামক দুটি কাব্যগ্রন্থ লিখে।
প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাবশিষ্য। কবি
মহিউদ্দীনের বেলায়ও একই কথা আসে। ‘পথের গান’, ‘জন্মধারণ’, ‘স্বপ্নের সংঘাত’,
‘যুদ্ধ বিপ্লব’, ‘দিগন্তের পথে একা’, ‘এলাে বিপ্লব’ প্রভৃতি মহিউদ্দীনের
উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ। কাজী কাদের নেওয়াজ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল কবি।
মরাল’, ‘নীল কুমুদি', ‘উতলা সন্ধ্যা’ তাঁর বিখ্যাত কাব্য। বন্দেআলী মিয়া নাম
করেছেন শিশুতােষ কবিতা রচনা করে। তাঁর কবিতায় গ্রামবাংলার বাস্তবচিত্র জীবন্ত
হয়ে উঠেছে। ‘ময়নামতীর চর’, ‘পদ্মানদীর চর’, ‘অনুরাগ', ‘দক্ষিণ দিগন্ত’ তাঁর
উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ।
সুফিয়া কামাল মহিলা কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তবে বাংলাদেশের সামগ্রিক
কাব্য সাহিত্যে তার একটা বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। সাঝের ‘মায়া’, 'মায়া কাজল’, ‘মন
ও জীবন’, ‘উদাত্ত পৃথিবী’, ‘প্রশান্তি ও প্রার্থনা', ‘দিওয়ানা’ প্রভৃতি
কাব্যগ্রন্থ রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
গভীর বেদনাবােধ তাঁর কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আবদুল কাদির এ সময়ের আরও একজন
শক্তিশালী ছান্দসিক কবি। ‘দিলরুবা’ ও ‘উত্তর বসন্ত’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। আ,
ন, ম, বজলুর রশীদ কবি হিসেবে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলাের
মধ্যে ‘মরুসূর্য', ‘পাশ্ববীণা’, ‘শীতে বসন্তে’, ‘এক ঝাঁক পাখি’, ‘মৌসুমী মন’,
‘রক্তকমল’ উল্লেখযােগ্য। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা সুনাম কুড়িয়েছেন ‘পশারিণী’,
‘মন ও মৃত্তিকা’ ও ‘অরণ্যের সুর’ কাব্যগ্রন্থ লিখে।
ফররুখ আহমদ ইসলামি ভাবধারা ও ঐতিহ্য সচেতন কবি। দেশবিভাগের আগেই তিনি খ্যাতি
অর্জন করেছেন ১৯৪৪ সালে তাঁর বিখ্যাত ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের
মাধ্যমে। এটি তার শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। সমকালীন আদর্শবাদের পরিচয় এ কাব্যে
বিধৃত। কাব্যের বিষয়বস্তু নির্বাচনে কবি মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি গুরুত্ব প্রদান
করেছেন। ভাষা ব্যবহার ও শব্দ চয়নে তিনি ইসলামি আদর্শের অনুসারী।
ইসলামি উপকথার উপাদান সংগ্রহ করে তিনি তাঁর কাব্যকে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করেছেন।
ফররুখ আহমদের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘সিরাজাম মুনীরা’, ‘হাতেম তায়ী’,
‘নৌফেল ও হাতেম’, ‘মুহর্তের কবিতা’, ‘পাখির বাসা’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। সূফী
মােতাহার হােসেন সনেট লিখে কতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। ‘সনেট সংগ্রহ’, ‘সনেট সয়ন’,
‘সনেটমালা’, ‘সনেট শতক’ তাঁর উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ। বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে
তিনিই সবচেয়ে বেশি সনেট রচনা করেছেন।
তালিম হােসেন ইসলামি চেতনার কবি। তার কাব্যগ্রন্থের নাম ‘দিশারী’ ও ‘শাহীন'। এর
মধ্যে তাঁর প্রকাশিত ও অগ্রন্থিত কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘কবিতা সমগ্র’।
সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদচারণা করলেও কবি হিসেবেই তাঁর
খ্যাতি সমধিক। ‘প্রসন্ন প্রহর’, ‘বৈরী বৃষ্টিতে’, ‘তিমিরান্তিক’, ‘কবিতা : ১৩৭২'
প্রভৃতি তাঁর কাব্যগ্রন্থ।
আহসান হাবীব শক্তিশালী আধুনিক কবি। বিভিন্ন জাতের কবিতা লিখে তিনি বাংলাদেশের
কাব্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর কবিতায় স্নিগ্ধতা এবং অলস
মধ্যাহ্নের বিশ্রামের আনন্দ আছে। ‘রাত্রিশেষ’, ‘ছায়া হরিণ, ‘সারা দুপুর’, ‘আশায়
বসতি’, ‘মেঘ বলে চৈত্রে যাবাে’, দুই হাতে দুই আদিম পাথর’, ‘প্রেমের কবিতা’,
‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’ তাঁর উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ। আবুল হােসেন এসময়ের আরও
একজন শক্তিশালী কবি। ‘নববসন্ত’, ‘স্বগত সংলাপ’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ।
হাবীবুর রহমান ‘সুনাম কুড়িয়েছেন উপাত্ত’ নামে একটি কাব্য রচনা করে। সৈয়দ আলী
আহসান সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখলেও কবি হিসেবে তিনি স্বতন্ত্র মর্যাদার
দাবিদার। অতি আধুনিক কবিতার বিচিত্র বৈশিষ্ট্য তিনি বাংলা কাব্যে রূপায়িত
করেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম ‘অনেক আকাশ’, ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’, ‘সহসা
সচকিত’, ‘উচ্চারণ’, ‘আমার প্রতিদিনের শব্দ’, কাব্য সংগ্রহ ইত্যাদি। এসময়ের
অন্যান্য কবিদের মধ্যে আছেন ইমাউল হক, সানাউল হক, আতাউর রহমান, আবদুর রশীদ
ওয়াসেকপুরী, আবদুল গণি হাজারী, আবদুর রশীদ খান, আশরাফ সিদ্দিকী, মযহারুল ইসলাম,
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আহমদ রফিক প্রমুখ।
শামসুর রাহমান অত্যন্ত শক্তিশালী কবি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিদের মধ্যে তিনি
বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। অতি আধুনিক কাব্যধারার বৈশিষ্ট্য তাঁর রচনায়
সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ‘রৌদ্র করােটিতে’, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, ‘নিরালােকে
দিব্যরথ’, ‘নিজ বাসভূমে’, বন্দী শিবির থেকে ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘দুঃসময়ের
মুখােমুখী’, ‘এক ধরনের অহংকার’, ‘আদিগন্ত নগ্নপদধ্বনি’, ‘আমি অনাহারী’, ‘প্রতিদিন
ঘরহীন ঘরে’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, ‘শূন্যতায় তুমি শােকসভা’, ‘ইচ্ছে হয়
একটু দাড়াই’, ‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’, ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’, ‘এক ফোটা
কেমন অনল’, ‘ধূলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ’ প্রভৃতি শামসুর রাহমানের উল্লেখযােগ্য
কাব্যগ্রন্থ। এসময়ের অন্যান্য উল্লেখযােগ্য কবিদের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদ,
হাসান হাফিজুর রহমান, জাহানারা আরজু, আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ, কায়সুল হক ও সাইয়িদ
আতীকুল্লাহ নাম উল্লেখযােগ্য।
আল মাহমুদ অত্যন্ত শক্তিশালী আধুনিক কবি। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ এবং ঐতিহ্য
চেতনা তাঁর কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কবিতার ভাষায় তিনি লােকজ শব্দকে তুলে
এনেছেন খুবই যত্নের সাথে। সাম্প্রতিককালের বাংলা কবিতায় তাঁকে গুরুত্বের সাথে
বিচার করা হয়। ‘লােক লােকান্তর কালের কলস’, ‘সােনালী কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা
দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘বখতিয়ারের ঘােড়া’, ‘আরব্যরজনীর
রাজহাস’, ‘প্রহরান্তের পাশফেরা’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘আমি,
দূরগামী’, ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’, ‘দ্বিতীয় ভাঙন’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযােগ্য
কাব্যগ্রন্থ।
বাংলাদেশের কবিতা থেমে নেই। চলছে তার যাত্রা। এই যাত্রাকে অব্যাহত রেখেছেন আরও
অনেক কবি। তাঁদের মধ্যে মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মােহাম্মদ মাহফুজউল্লা, ফজল
শাহাবুদ্দীন, ওমর আলী, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ,
মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নূরুল হুদা, ইমরান নূর, মােফাজ্জল করিম, সাযযাদ কাদির,
হাবীবুল্লাহ সিরাজী, হাসান হাফিজ, নাসির আহমেদ, লিলি হক, হালিমা আজাদ প্রমুখ।
উপসংহার : বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কাব্যশাখাটিই বেশি
সমৃদ্ধ। আঙ্গিকের প্রয়ােগে আর শব্দের ব্যবহারে অভিনবত্ব দেখিয়ে বাংলাদেশের
কবিরা আমাদের কাব্যসাহিত্যকে গতিশীলতা দান করেছেন। প্রবীণদের পাশাপাশি অনেক নবীন
কবির আগমনে বাংলা কবিতায় নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে।