দ্বিতীয় অ্যাসাইনমেন্ট
উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন (২য় পত্র)
৩য় সপ্তাহ
বিপণনের ধারণা, ক্রমবিকাশ ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ
(ক) বিপণনের ধারণা (Concept of Marketing):
মানুষ জন্মগ্রহণ করার পর থেকে আমৃত্যু বিভিন্ন পণ্য ব্যবহার করে। মানুষ বিভিন্ন
প্রয়োজনে তার চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরণের পণ্য বা সেবা ক্রয়
ও ভোগ করে থাকে। ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবার ক্রয় করে, বাসস্থানের জন্য ঘর-বাড়ি
ক্রয় করে আবার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে। পণ্য বা সেবা ভোগ করার
জন্য মানুষ নির্দিষ্ট বাজার থেকে যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজন অনুসারে ক্রয় ও ভোগ
করে। লক্ষ্য করা যায় যে, পণ্য বা সেবার ধারণার সৃষ্টি থেকে শুরু করে, ক্রেতাদের
মাঝে তা পরিচিতিকরণ, ক্রয়ে উৎসাহ প্রদান, পণ্য বণ্টন, মূল্য নির্ধারণ, ক্রয়
সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা প্রদান এবং বিক্রয়োত্তর সেবাসহ বিভিন্ন কাজের সাথে
বিপণন বা বাজারজাতকরণ জড়িত।
ল্যাটিন শব্দ Marcatus থেকে ইংরেজী Market শব্দের উৎপত্তি। এই Market শব্দ থেকে
পরবর্তীতে Marketing শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো বিপণন বা
বাজারজাতকরণ। অনেক সময়ই বিপণন বা মার্কেটিং দিয়ে শুধুমাত্র ক্রয়-বিক্রয় বা
প্রচারণাকার্যকে বুঝানো হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ক্রয়-বিক্রয় বা প্রচারণা হচ্ছে
বিপণনের অনেক কাজের অংশবিশেষ। বিপণন একটি পরিবর্তনশীল ও জটিল বিষয়। বর্তমান
সময়ে বিপণন বলতে সন্তোষজনকভাবে ক্রেতা বা ভোক্তার প্রয়োজনসমূহ পূরণকে বোঝায়।
বিপণনের মূল উদ্দেশ্য হলো ক্রেতা ভ্যালু বা সুবিধা সরবরাহের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে
নতুন ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা এবং সন্তুষ্টি বিধানের মাধ্যমে বর্তমান ক্রেতাকে ধরে
রাখা ও সন্তুষ্ট ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা।
বিপণনে উৎপাদক, ক্রেতা ও ভোক্তা সুপ্রচলিত কিছু শব্দ৷ পণ্যদ্রব্য উৎপাদনের সাথে
জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষঠান/ কোম্পানিকে উৎপাদক (Producer) বলে। যে ব্যক্তি বা
কোম্পানি পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে তাকে ক্রেতা বা (Customer ) বলে। নিজে ভোগ করার
জন্য কোন ব্যক্তি বা কোম্পানি যদি পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে তাকে ভোক্তা বা
(Consumer) বলে। কোন পণ্য ক্রয় ও ব্যবহারের ফলে যে সকল সুবিধা পাওয়া যায় ও
পণ্য ক্রয় ও ব্যবহার করার জন্য যে সকল ব্যয় বহন করা হয়, তার পার্থক্যকে ক্রেতা
ভ্যালু' (Customer value) বলে। পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে পণ্য ক্রেতা বা ভোক্তার
নিকট পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত বিপণন বিভিন্ন ধরণের কাজের সাথে জড়িত থাকে।
বিপণনের কাজকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়; যথা- পণ্য উৎপাদনের পূর্বে, পণ্য
উৎপাদনের পরে, এবং পণ্য বিক্রয় করার পরবর্তীতে। পণ্য উৎপাদনের পূর্বে বিপণনের
কাজগুলো হচ্ছে বাজার জরিপ, চাহিদা নির্ধারণ, অর্থ- সংস্থান, প্রতিযোগিদের চিহ্নিত
করা ইত্যাদি। উৎপাদনের পরে বিপণনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মান নির্ধারণ
বিভক্তিকরণ, মোড়কীকরণ, মূল্য নির্ধারণ, পরিবহণ, গুদামজাতকরণ, বণ্টন, ঝুঁকিগ্রহণ,
পণ্য প্রসার ইত্যাদি। সর্বশেষে পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়া অথবা পণ্য ভোক্তার
কাছে বিক্রয় করা হলেই বিপণনের কার্যক্রম শেষ হয় না। ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর পরও
বাজারজাতকরনের কিছু কাজ থাকে। যেমন- বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান, ভোক্তা বা ক্রেতার
সন্তুষ্টি পরিমাপ, সন্তুষ্টি বজায় রাখা এবং বৃদ্ধি করা, মার্কেটিং এর নানাবিধ
কার্যক্রম মূল্যায়ণ করা।
(খ)
বিপণনের ক্রমবিকাশ (Evolution of Marketing) : মানব সভ্যতা ও
ব্যবসায়িক পরিবেশের বিবর্তনের সাথে সাথে বিপণন ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ ঘটেছে।
বর্তমান সময়ে সকল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বিপণনের ব্যবহার দেখা যায়। বিপণনের
ক্রমবিকাশ এ পর্যায়ে আলোচনা করা হলো:
১. আত্মনির্ভরশীলতার যুগ (Era of self-Sufficiency) : মানবসভ্যতার
প্রথমদিকে মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিস নিজেই উৎপাদন করত ও মিলিতভাবে ভোগ করত।
নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পর উদ্বৃত্ত পণ্য সংরক্ষণ করার ধারণা ছিল না। এ কারণে
পণ্য বিনিময়ের কোন প্রয়োজনীয়তা ছিল না। তাই বিপণনের ধারণাও বিদ্যমান ছিল না।
এই সময়কে প্রাচীন সভ্যতার যুগও বলা হয়।
২. বিনিময় যুগ (Era of Exchange) : সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের
চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে। প্রাচীন আত্মনির্ভরশীলতার যুগের এক পর্যায়ে মানুষ লক্ষ
করে যে, মানুষ নিজের প্রয়োজন মেটানোর পরও উৎপাদিত পণ্য উদ্বৃত্ত থেকে যায়।
আবার, একজন মানুষ তার প্রয়োজনীয় সকল পণ্য একা উৎপাদন করতে পারে না এবং সব ধরণের
পণ্য উৎপাদনে মানুষের পারদর্শীতাও নেই। এই পরিস্থিতিতে মানুষ যে ধরনের পণ্য
উৎপাদনে পারদর্শী সেই পণ্য উৎপাদন করতে থাকে এবং উদ্বৃত্ত পণ্য একে অপরের সাথে
বিনিময় করা শুরু করে। বিনিময় প্রথার (Barter System) এই সময়কে বিনিময় যুগ বলা
হয়। এই সময়ে পণ্য বিনিময় করার জন্য ব্যবসায়ী শ্রেণির উদ্ভব হয় যারা
নির্দিষ্ট স্থানে পণ্য আদান-প্রদান করত। ক্রমান্বয়ে বাজার, ব্যবসায়িক কার্যক্রম
ও বিপণনের ধারণা প্রবর্তিত হয়।
৩. উৎপাদন যুগ (Era of Production) : উৎপাদন যুগের শুরু হিসেব ধরা হয়
১৮৭০ সাল থেকে যার ব্যাপ্তী ১৯৩০ সাল পর্যন্ত। পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে লাভবান
হবার ধারণা আসার পর উৎপাদনকারী অধিক উৎপাদনে। উৎসাহিত হয়। এই সময়ে উৎপাদনের উপর
অধিক গুরুত্ব থাকার জন্য এই যুগকেউৎপাদন যুগ বলে। এই সময়ে উৎপাদনকারী অধিক পণ্য
উৎপাদন করার জন্য পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করার নিমিত্তে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি
আবিষ্কার করা শুরু করে এবং শ্রমিক নিয়োগ করতে থাকে।
৪. বিক্রয় যুগ (Era of Sales) : ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত সময়কালকে
বিক্রয় যুগ হিসেবে ধরা হয়। উৎপাদকের সংখ্যা ও উৎপাদনের দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ার
সাথে সাথে উৎপাদনের। পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে ভোক্তারা
বিভিন্ন পণ্য থেকে পচ্ছন্দমতো পণ্য ক্রয়ের সুযোগ পায়। উৎপাদনকারী উৎপাদিত
পণ্যের বিক্রয় নিশ্চিত ও বৃদ্ধি করার জন্য বিক্রয়ের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে
থাকে। এই সময়ে উৎপাদনকারী বিক্রয় কৌশল হিসেবে বিজ্ঞাপন, ব্যক্তিক বিক্রয়,
বিক্রয় প্রসার ইত্যাদি কৌশল প্রয়োগ করে। বিক্রয় ও বিক্রয় কৌশলের প্রাধান্য
থাকার জন্য এই সময়কে বিক্রয় যুগ বলা হয়।
৫. আধুনিক বিপণন যুগ (Era of Modern Marketing) : আধুনিক বিপণন যুগের শুরু
১৯৫০ সাল থেকে যা এখনও চলমান। এই যুগে ভোক্তার প্রয়োজন, অভাব ও চাহিদার বিষয়ে
অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ার কারণে ভোক্তার সন্তুষ্টির
প্রতি খেয়াল রেখে পণ্য ও সেবা উৎপাদন ও বিপণন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা
হয়। এই সময়েই ভোক্তাকেন্দ্রিক বিপণন কার্যক্রম শুরু হয়।
৬. সামাজিক বিপণন যুগ (Era of Social Marketing) : ১৯৭২সালের পরে সামাজিক
বিপণন ধারণার উদ্ভব হয়। এই যুগে ভোক্তার সন্তুষ্টির সাথে সাথে সমাজের প্রতি
দায়বদ্ধতার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। সামাজিক বিপণন যুগে সমাজ, পরিবেশ ও মানুষের
কল্যাণের বিষয় বিবেচনায় রেখে ব্যবসায়ীরা প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন ও ভোক্তার
সন্তুষ্টি অর্জনে মনোনিবেশ করে। সমাজের জন্য কল্যাণকর ও পরিবেশ বান্ধব পণ্য ও
সেবা উৎপাদন ও সরবরাহ করতে দেখা যায় এই সময়ে।
৭. সম্পর্কভিত্তিক বিপণন যুগ (Era of Relationship Marketing) :
সম্পর্কভিত্তিক বিপণন যুগ শুরু হয় ১৯৯০ সালে। বর্তমান যুগে ব্যবসায়ীরা ক্রেতা,
ভোক্তা, সরবরাহকারী, উৎপাদনকারীসহ অন্যান্য সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের
সাথে দীর্ঘমেয়াদী সুসম্পর্ক তৈরি ও সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম
গ্রহণ করে থাকে। ভ্যালুভিত্তিক সুসম্পর্ক তৈরি ও সম্পর্ক রক্ষা করার উপর গুরুত্ব
দেওয়ার জন্য এই যুগকে সম্পর্কভিত্তিক বিপণন যুগ বলা হয়। ব্যবসায়ীরা এখন নতুন
বা সম্ভাব্য ক্রেতা তৈরির চেয়ে বর্তমান ক্রেতার সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখার উপর
বেশি গুরুত্বারোপ করছে।
বিপণনের ক্রমবিকাশ |
উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে বলা যায় যে, সময়ের সাথে সাথে বিপণনের কার্যক্রমের
ধারার পরিবর্তন এসেছে। লক্ষ্য করা যায় যে, কোন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা,
ব্যবসায়িক পরিবেশ ইত্যাদির উপর সে দেশের বিপণন কার্যক্রম নির্ভর করে। উন্নত
দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বিপণনের কার্যক্রম ততটা গতিশীল নয়। এর কারণ
বাংলাদেশে এখনও সকলক্ষেত্রে বিভিন্ন বিপণন মতবাদের কার্যক্রম পুরোদমে পরিচালনা
করা সম্ভব হয়নি।
বিষয় | বাজার | বিপণন |
---|---|---|
সজ্ঞা | বাজার হলো কোনো পণ্যের বর্তমান ও সম্ভাব্য ক্রেতার সমষ্টি | প্রতিষ্ঠানের লক্ষ অর্জনের জন্য পণ্য বা সেবা সৃষ্টি ও বিনিময়ের মাধ্যমে ক্রেতা ও ভোক্তার সন্তুষ্টি অর্জন করাকে বিপণন বলা হয়। |
উদ্দেশ্য | ক্রেতা ও ভোক্তার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা। | ক্রেতা ও ভোক্তাদের চাহিদা পূরণ করে সন্তুষ্টি অর্জন করা। |
কাজ | পণ্য, সেবা ও ধারপাত্র শুধুমাত্র মালিকানা হস্তান্তরের কাজ বাজারে সম্পাদিত হয়। | বিপণনের পণ্য-সেবা ও সৃষ্টি ও বিনিময়ের সকল কাজ সম্পাদিত হয়। |
গুরুত্ব | বিক্রেতার প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। | ক্রেতা ও ভোক্তার প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। |
উপযোগ | পণ্যের স্বত্ত্বগত উপযোগ সৃষ্টি হয়। | পণ্যের সময়গত, স্থানগত, স্বত্ত্বগত উপযোগ সৃষ্টি হয়। |
সংশ্লিষ্ট পক্ষ | ক্রেতা ও বিক্রেতা দুটি পক্ষ থাকে। | ক্রেতা, বিক্রেতা ছাড়াও সরবরাহকারী মধ্যস্থ ব্যবসায়ী উৎপাদন প্রতিযৌগিসহ বিভিন্ন পক্ষ থাকে। |
সম্পর্ক | মাধ্যমে পণ্য ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক থাকে। | বিপণনে পণ্য ও সেবা বিনিময়ের সাথে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলির মধ্যে সম্পর্ক থাকে। |
পরিকল্পনা | স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে। | দীর্ঘমেয়াদি পারিকল্পনা থাকে। |
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাজারে পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় করে মালিকানা হস্তান্তর নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে কাজ পরিচালিত হয়। অন্যদিকে বিপণনের মাধ্যমে পণ্য বা সেবার সৃষ্টি থেকে শুরু করে তা বিনিময় পর্যন্ত সকল কার্যাবলী ব্যাপক পরিসরে সম্পাদন করা হয়।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি | ইসলাম শিক্ষা | পদার্থবিজ্ঞান | ইতিহাস | ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা | জীববিজ্ঞান | উচ্চতর গণিত | সমাজবিজ্ঞান | ভূগোল | ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বিমা | উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন | রসায়ন | অর্থনীতি | পৌরনীতি ও সুশাসন | যুক্তিবিদ্যা | হিসাব বিজ্ঞান
প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট
উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন (১ম পত্র)
২য় সপ্তাহ
নির্দেশনা :
- উৎপাদনের ধারণা ব্যাখ্যা করতে হবে।
- উৎপাদনের গুরুত্ব ও এর আওতা ব্যাখ্যা করতে হবে।
- উৎপাদনশীলতা এবং এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে হবে।
নমুনা সমাধান
উৎপাদনের ধারণা (Concept of Production) : সাধারণ অর্থে উৎপাদন
বলতে কোন কিছু সৃষ্টি করাকে বুঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে উৎপাদন বলতে শুধু সৃষ্টি
করাকে বুঝায় না। অর্থনীতিতে উৎপাদন বলতে কোন নির্দিষ্ট সময়ে কোন দ্রব্যের
আকার ও আকৃতির পরিবর্তন করে দ্রব্যের উপযােগ সৃষ্টি করাকে উৎপাদন বলে।
প্রকৃতপক্ষে মানুষ কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। মানুষের আশে পাশে যা কিছু
রয়েছে সবই প্রকৃতির দান। মানুষ কেবল মাত্র প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদের রূপগত,
গুণগত, পরিমাণগত ও অবস্থানগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন উপযােগ সৃষ্টি করতে পারে
বা ভবিষ্যতের জন্য মজুদ রেখে অতিরিক্ত উপযােগ সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে কোন
দ্রব্যের আকার ও আকৃতি পরিবর্তন করাকে অর্থনীতিতে উৎপাদন বলে। যেমন- বন থেকে
কাঠ সংগ্রহ করে আসবাবপত্র প্রস্তুত করে মানুষ কোন নতুন দ্রব্য বা পদার্থ সৃষ্টি
করতে পারে না। শুধুমাত্র কাঠের আকার ও আকৃতি পরিবর্তন করে আসবাবপত্র তৈরি করে
উপযােগ সৃষ্টি করা হয়েছে মাত্র। অর্থাৎ আসবাবপত্র তৈরীর মাধ্যমেই কাঠের উপযােগ
সৃষ্টি করা হলাে। সুতরাং অর্থনীতিতে উৎপাদন বলতে কোন দ্রব্য সৃষ্টি করাকে
বুঝায় না; বরং দ্রব্যের আকার ও আকৃতি পরিবর্তন করে অধিক উপযােগ সৃষ্টি করাকে
বুঝায়। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ উৎপাদনের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন।
যেমন :
অধ্যাপক মার্শালের মতে,
“এ বস্তু জগতে মানুষ প্রকৃতি প্রদত্ত বন্ধুকে অধিকতর উপযােগী করে তােলার
উদ্দেশ্যে এরূপ পূর্নর্বিন্যাস করে যাতে তাকে অধিকতর কার্যোপযোগী করা
যায়।”
অধ্যাপক ডানিয়েল বি. সুইটস এর মতে,
“উৎপাদন হলাে এমন একটি পদ্ধতি যা দ্বারা মানুষ প্রকৃতি প্রদত্ত বন্ধুকে
ভােগের উপযােগী করে তুলতে পারে।”
সুতরাং সংক্ষেপে বলা যায়, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতি প্রদত্ত
সম্পদের সাথে নিজের শ্রম ও মূলধন নিয়োগ করে অধিকতর উপযােগ সৃষ্টি করে তাকে
উৎপাদন বলে।
উৎপাদনের গুরুত্ব (Importance of Production) : অর্থনীতির একটি অন্যতম
গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে উৎপাদন। বর্তমান সময়ে উৎপাদনকে বাদ দিয়ে এই সমাজ -
সভ্যতা ও এর উন্নয়ন চিন্তাই করা যায় না। প্রকৃতি প্রদত্ত সব উপকরণ মানুষ
সরাসরি ব্যবহার বা ভােগ করতে পারে না। তাই দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহার উপযােগী করে
তােলার জন্য উৎপাদনের মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করতে হয়। মানুষের দৈনন্দিন
অভাব, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক উন্নয়নে উৎপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে
উৎপাদনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-
১. চাহিদা পূরণ (Fulfillment of Demand) : মানুষের চাহিদার শেষ নেই।
একটি চাহিদা পূরণ হলে অন্য চাহিদা দেখা দেয়। এছাড়া সময়ের সাথে সাথে নতুন
নতুন চাহিদার উদ্ভব হয়। বিভিন্ন ধরণের পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মানুষের
বৈচিত্র্যময় চাহিদা পূরণ করা হয়।
২. লক্ষ্য অর্জন (Achieving Goal) : ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য
হচ্ছে মুনাফা অর্জন করা। উৎপাদন যত বাড়বে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা তত বাড়বে।
এজন্য প্রতিষ্ঠান বিক্রয় বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সবসময় তৎপর
থাকে।
৩. উপযােগ সৃষ্টি (Creating Utilities) : উৎপাদনের মাধ্যমে বিভিন্ন
ধরনের উপযোগ সৃষ্টি হয়। যেমন- রূপগত, স্থানগত, সময়গত প্রভৃতি। এছাড়াও উৎপাদন
পণ্যের নতুন উপযােগ সৃষ্টি করে।
৪. প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার (Proper Utilization of Resources ) :
প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে হলে উৎপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদন
ব্যতীত প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার সম্ভব নয়। উৎপাদনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক
সম্পদ মানব কল্যাণে ব্যবহার করা যায়।
৫. কর্মসংস্থান সৃষ্টি (Creating Employment) : উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি
পেলে, কর্মসংস্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অতএব কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন
বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে কর্মসংস্থান জড়িত।
৬. মানব কল্যাণ (Human Welfare) : মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের পাশাপাশি
নতুন নতুন পণ্য ব্যবহার বা ভােগের প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবজাতির কল্যাণে
বিভিন্ন ধরণের দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন হয়ে থাকে আর এইসব দ্রব্যসামগ্রী
ব্যবহারকারীর সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে উৎপাদন
কারখানায় উৎপাদন কাজে প্রচুর কর্মীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ
সাধিত হচ্ছে।
৭. অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic Development) : যে কোনাে দেশের
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দ্রব্য সামগ্রী ও সেবার উৎপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অতএব দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদন ব্যতীত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
৮. রপ্তানি বৃদ্ধি (Increasing Export) : কৃষি, শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে
উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে রপ্তানি বাড়বে। উৎপাদন বাড়লে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে
উদ্বৃত্ত পণ্য রপ্তানির সুযােগ সৃষ্টি হয়। আর এই রপ্তানি অর্থনীতির চাকাকে
চাঙ্গা করে তোলে।
৯. ভােক্তার সন্তুষ্টি (Consumer Satisfaction) : আধুনিক ব্যবসায়ে টিকে
থাকার বড় হাতিয়ার হচ্ছে ভােক্তাদের সন্তুষ্ট করা। কম খরচে ভাল মানের পণ্য
উৎপাদন করা সম্ভব হলে, ভােক্তাদের সন্ত্রষ্ট করা সহজ হয়। এছাড়া ভােক্তাদের
চাহিদা অনুযায়ী সময়মত ত্রুটিমুক্ত পণ্য উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের
সন্তুষ্ট করতে পারে।
১০. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন (Achieving Foreign Exchange) : উৎপাদন বৃদ্ধি
করে পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। অভ্যন্তরীণ
চাহিদা পূরণের পর উদ্বৃত্ত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা
অর্জন করা হয়।
পরিশেষে বলা যায়, উৎপাদনের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদকে সঠিকভাবে
ব্যবহার করতে হলে উৎপাদনের বিকল্প নেই। আর উৎপাদনের মাধ্যমেই প্রাকৃতিক সম্পদকে
সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়।
উৎপাদনের আওতা (Scope of Production) : উৎপাদনের আওতা অত্যন্ত ব্যাপক।
প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ থেকে শুরু করে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সকল অর্থনৈতিক
কার্যক্রম উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। নিম্নে উৎপাদনের আওতা আলোচনা করা হলাে-
১. উপযােগ সৃষ্টি (Creating Utility) : উপযােগ সৃষ্টি উৎপাদনের
আওতাভূক্ত, কারণ উৎপাদনের মাধ্যমে পণ্যের আকার - আকৃতি, রূপ প্রভৃতি পরিবর্তন
করে নতুন উপযােগ সৃষ্টি করা হয়।
২. রূপান্তর প্রক্রিয়া (Transformation Process) : উৎপাদনের অন্যতম
বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মাধ্যমে প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদে রূপান্তর করা হয়। যেমন-
পাট থেকে বস্তা ও কার্পেট তৈরি করা হয়।
৩. পণ্য ডিজাইন (Product Design) : পণ্য ডিজাইন করার সময় ক্রেতাদের
চাহিদা, প্রযুক্তিগত সামর্থ্য, উৎপাদন ব্যয় প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে ডিজাইন
করতে হয়।
৪. বিন্যাস (Lay-out) : কোনাে কারখানার যন্ত্রপাতি, স্থান, আবহাওয়া,
পরিবেশ ইত্যাদি নির্বাচন করা হলো উৎপাদনের আওতাধীন। কোন যন্ত্রের পর কোন
যন্ত্রের অবস্থান হবে, যে স্থানে রাখলে সহজে উৎপাদন কাজ করা যাবে এবং কারখানার
অভ্যন্তরে চলাচল নিরাপদ হবে ইত্যাদি বিষয়ের দিকে খেয়াল রেখে যন্ত্রপাতির সঠিক
অবস্থান নির্ণয়কে যন্ত্রপাতি বিন্যাস বলে।
৫. উপকরণ সংগ্রহ (Collection of Materials) : উৎপাদনের আরেকটি আওতাভূক্ত
বিষয় হচ্ছে উৎপাদনের সাথে সম্পর্কযুক্ত উপকরনসমূহ সংগ্রহ করা। কি পরিমাণ উপকরণ
কিভাবে ব্যবহার হবে ইত্যাদি কার্যক্রম উৎপাদন শুরুর পূর্বেই স্থির করতে হয়।
উৎপাদনের উপকরণগুলাে হলাে ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন।
৬. পদ্ধতি বিশ্লেষন (System Analysis) : উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সহজ ও সরল
পদ্ধতি অবলম্বন করলে দক্ষতার সাথে বেশি পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব
হয়।
৭. সিডিউলিং (Scheduling) : উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি কাজ সিডিউল
অনুযায়ী সম্পাদন করতে হয় অর্থাৎ প্রতিটি কাজ কখন শুরু হবে এবং শেষ হবে তার
নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করতে হয়। কাঁচামাল কখন, কোন প্রক্রিয়ায় প্রবেশ
করবে, প্রক্রিয়ার সময় কতক্ষণ হবে এবং সকল প্রক্রিয়া কখন শেষ হবে তা সিডিউলিং
এর মাধ্যমে স্থির করা হয়।
৮. উৎপাদন পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রন (Production Plan and Control) : পণ্য
ও সেবা সামগ্রী উৎপাদনের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, মান নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ
এবং ব্যয় নিয়ন্ত্ৰণ উৎপাদনের আওতাভুক্ত।
৯. কারখানার পরিবেশ (Factory Environment) : কারখানার পরিবেশ
উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে। এজন্য কারখানার নিরাপত্তা, পরিষ্কার পরিছন্নতা,
আলাে বাতাস, তাপমাত্রা ইত্যাদি অনুকুলে আছে কিনা তা লেখতে হয়।
১০. গবেষণা ও উন্নয়ন (Research and Development) : নতুন নতুন পণ্য
আবিষ্কারের জন্য গবেষণা প্রয়ােজন। এছাড়া পুরাতন পণ্যের উন্নয়নেও গবেষণার
বিকল্প নেই। তাই বলা যায় যে, গবেষণা ও উন্নয়ন উৎপাদনের আওতাভূক্ত।
১১. মজুদ নিয়ন্ত্রণ (Inventory Contorl) : উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল
প্রয়ােজন। আর সুষ্ঠুভাবে উৎপাদন কার্য পরিচালনার জন্য পণ্যের মজুদ নিয়ন্ত্রণ
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সঠিকভাবে পণ্য মজুদ না রাখলে প্রতিষ্ঠানের খরচ
বাড়বে ও উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।
১২. উৎপাদন ক্ষমতা (Production Capacity) : শ্রম, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল
ব্যবস্থাপনা এমন হতে হবে যেন সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা কাজে লাগানাে যায়। এতে
ব্যয় হ্রাস পায় ও উৎপাদন কাজে দক্ষতা আসে। তাই উৎপাদন ক্ষমতা কাজে লাগানাের
জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ উৎপাদনের আওতাভূক্ত।
১৩. প্রশিক্ষণ (Training) : উৎপাদন কার্যক্রমের সাথে যারা জড়িত যেমন-
শ্রমিক তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। এটিও উৎপাদনের আওতাভুক্ত।
উৎপাদনশীলতার ধারণা (Concept of Productivity) : উৎপাদনশীলতা হচ্ছে
সম্পদের ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা উৎপাদনের পরিমাণ। অর্থাৎ কতটুকু ইনপুট বা
কাঁচামাল ব্যবহার করে কি পরিমাণ আউটপুট বা পণ্য উৎপাদন করা যায় তার অনুপাত
হচ্ছে উৎপাদনশীলতা। অন্যভাবে উৎপাদনশীলতা বলতে উৎপাদনের দক্ষতাকে বােঝায়।
সমপরিমাণ উপকরণ ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে বা কম পরিমাণ উপকরণ
ব্যবহার করে সমপৱিমান উৎপাদন করতে পারলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। উৎপাদনশীলতাকে
নিম্নোক্ত সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় -
উৎপাদনশীলতা = উৎপাদিত পণ্য (আউটপুট) ÷ উৎপাদনে ব্যবহৃত উপাদান
(ইনপুট)
এ প্রসঙ্গে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন লেখক সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা নিম্নে তুলে ধরা হলাে
অর্থনীতিবিদ Samuelson বলেন,
"Productivity is a term referring to the ratio of output to inputs."
অর্থাৎ উৎপাদনশীলতা হচ্ছে একটি শব্দ যা ইনপুটের প্রেক্ষিতে আউটপুটের
অনুপাত বুঝায়।
International Labour organisation (ILO) এর মতে,
"In the broadest concept, productivity may be taken to constitute the
radio of available goods and services to the potential resources of the
group, community or the country."
অর্থাৎ ব্যাপক অর্থে, কোনো দল, সমাজ বা দেশে প্রাপ্ত দ্রব্য এবং সেবার সাথে
কার্যকর সম্পদের অনুপাত হল উৎপাদনশীলতা।
উপরোক্ত সংজ্ঞার আলোকে উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে বলা যায় যে -
১. উৎপাদনশীলতা হলো উপাদান ও উপকরণ এর অনুপাত।
২. উপকরণ এর তুলনায় উপাদানের পরিমাণ বৃদ্ধির হার।
৩. শ্রমের দক্ষতা মূল্যায়ণ এবং
৪. একটি মুনাফা বৃদ্ধি করে।
সুতরাং পরিশেষে বলা যায় যে, নির্দিষ্ট পরিমান সম্পদ ব্যয় করে বা কাজে লাগিয়ে
যে পরিমাণ ফলাফল অর্জিত হয় তার অনুপাতই হলো উৎপাদনশীলতা।