↬ গৃহ কার্যে বিজ্ঞানের ব্যবহার
↬ গৃহ কার্যে বিজ্ঞান এর ব্যবস্থা
↬ গৃহ জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব
ভূমিকা : বর্তমান সভ্যতা মানুষের বহু শতাব্দীর স্বপ্ন ও সাধনার ক্রম
পরিণাম। মানুষ তার যুগ-যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনার অনবদ্য ফসল দিয়ে গড়ে তুলেছে
সভ্যতার এ বিশাল ইমারত। আপনার প্রাণশক্তি তিল তিল দান করে, বুকের রক্ত বিন্দু
বিন্দু ঢেলে দিয়ে সে রচনা করেছে সভ্যতার এই তিলােত্তমা মূর্তি। সে সভ্যতার
বেদীমূলে দিয়েছে তার বাহুর শক্তি, মস্তিষ্কের বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি এবং
হৃদয়ের ভালােবাসা। বিজ্ঞানও মানুষের অতন্দ্র সাধনার ফসল। কালক্রমে মানুষ
বিজ্ঞানকে তার সভ্যতার বিজয়রথের বাহন করে শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে এসে
উপনীত হয়েছে বর্তমানের পাদপীঠতলে। আজ গৃহকার্যেও বিজ্ঞানের উপস্থিতি ব্যাপক।
নানা প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে নানা কাজে। বলাবাহুল্য, মানব সভ্যতার এই চরম
উন্নতির মূলে রয়েছে বিজ্ঞানের অপরিসীম অবদান।
বিজ্ঞান চেতনার প্রসার : বিখ্যাত বিজ্ঞান গবেষক কলিন রােনান বলেছেন,
“মানুষের মনে বিজ্ঞান চেতনার দীপশিখা প্রথম জ্বলে উঠেছিল আজ থেকে প্রায় দশ
হাজার বছর আগে, মধ্যপ্রাচ্যে।”
সে সময় সভ্য মানুষ শুধু প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনে নয়, নিছক জানার বা বােঝার
আগ্রহেই নানা বিষয় সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান আহরণ করতে শুরু করে। তার আগে
প্রত্নপ্রস্তর যুগের মানুষ শিকার ও গৃহস্থালির প্রয়ােজনে ক্লিস্ট পাথরের টুকরাে
ময়ে বানিয়েছিল তীর, দুরি, হাতুড়ি ইত্যাদি নানা জিনিস। সেই আদিম যুগে
গােষ্ঠীবদ্ধ যাযাবর মানুষের জীবনে যুগান্তর আনল আগুনের আবিষ্কার আর কৃষিকাজ
প্রচলন। সে সময় গড়ে উঠল ছোট ছোট গ্রাম। উচ্চবিত হলাে আদি কৃষিযন্ত্র ‘লাঙল’।
মানুষ ক্ষেতে জলসেচের জন্যে তার বৈজ্ঞানিক বৃত্তিকেও কাজে লাগাতে শিখল। শস্য
সংরক্ষণ, ফসল থেকে আরও নানা প্রয়ােজনীয় সামগ্রী বানাতে শিখল, কুমােরের চাকা
ঘুরিয়ে মানুষ বানাতে শুরু করল নানা ধরনের মাটির পাত্র। সে সময় বয়ন শিল্পেরও
উদ্ভব ঘটে। ভারি জিনিস সহজে তােলার জন্য সে সময় মানুষ কপিকল যন্ত্রের সাহায্য
নিতে শিখেছিল। ক্ৰমে মানুষের বিজ্ঞানচেতনায় আরও অনেক অগ্রগতি এল। প্যাপিরাস
জাতীয় নলখাগড়া থেকে মিসৱের মানুষ প্রথম লেখার উপযােগী কাগজ তৈরি করল। ইরাক
অঞলের মানুষরা প্রথম চাকাযুক্ত গাড়ি বানিয়ে পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যুগান্তর
আনে। কয়েক হাজার বছর আগে চীনের বিজ্ঞানীরা অতি দ্রুত যান্ত্রিক পদ্ধতিতে
যােগ-বিয়ােগ করার উপযােগী গণকযন্ত্র তৈরি করে নেন। সে গণকান্ত একালে ইলেকট্রনিক
ক্যালকুলেটর যন্ত্রের আদিরূপ। বিজ্ঞানী টেসিবিয়স বানিয়েছিলেন জলঘড়ি। জল তােলার
উপযােগী বিশেষ ধরনের পাম্প এবং যন্ত্রচালিত ঘড়ি প্রথম আবিষ্কৃত হয় চীন দেশে।
এসবই ঘটেছিল খ্রিস্টজন্মের আগে। গ্রিসের মানুষ প্রথম পৃথিবী ও মহাকাশের মানচিত্র
বানায়। প্রাণিবিদ্যার ক্ষেত্রে, চিকিৎসাশাস্ত্রে, স্বাপত্যবিদ্যা এবং জ্যামিতির
ক্ষেত্রে গ্রিক বিজ্ঞানীদের দান কম ছিল না। শত সহস্র বছর ধরে মানুষ কাজ করে
চলেছে, জ্ঞানচর্চা দ্বারা সে অর্জন করতে প্রয়াসী হয়েছে প্রবল শক্তি। আজকের
জীবনে বিজ্ঞানের সফল ব্যবহার মানুষের দীর্ঘকালব্যাপী সাধনার গৌরবময় ফল। দৈনন্দিন
জীবনে মানুষ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে পূর্ণাঙ্গরূপে কাজে লাগিয়েছে ইউরােপে
শিল্পবিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর থেকে, উনিশ শতকে। তখন থেকেই গৃহকার্যে শুরু হয়
বিজ্ঞানের ব্যবহার। ক্রমে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার গৃহকার্যে ব্যাপক হয়ে ওঠে।
গৃহকার্যে বিজ্ঞান : আধুনিক জীবন একান্তভাবেই বিজ্ঞাননির্ভর। বিজ্ঞানের
আবিষ্কার ও উদ্ভাবন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের বিবিধ প্রয়ােজন মেটাচ্ছে।
কেবল তাই নয়, বিজ্ঞান মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এনেছে। বিজ্ঞানের ইতিহাস
অন্ধকুসংস্কার ও যুক্তিহীন ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে যুক্তিনিষ্ঠ মানুষের সংগ্রামের
ইতিহাস। বিজ্ঞান শুধু মানুষের দৈনন্দিন জীবনকেই সমৃদ্ধ করে নি, তার চিন্তার
জগতকেও প্রভাবিত করেছে। আজ জীবনের সব ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবিসংবাদিত প্রভুত্ব।
প্রভাতের শয্যাত্যাগ থেকে শুরু করে নিশীথের শয্যাগ্রহণ পর্যন্ত বিজ্ঞান মানুষের
অত্যন্ত অনুগত অনুচর। বিজ্ঞানের যেসব আবিষ্কার ও উদ্ভাবন আজ আমাদের গৃহকার্যে
প্রভাব বিস্তার করে আছে, এখন আমরা সে সম্পর্কে আলোকপাত করব।
স্টোভ : প্রভাতী চা পান থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে গমন ও কর্মক্ষেত্র
থেকে প্রত্যাবর্তন সবই আজ বিজ্ঞাননির্ভর। সকালে চা না হলে আমাদের চলে না। এক সময়
এই চা তৈরি হতাে বিজ্ঞানের দান স্টোভে আগুন জ্বালিয়ে। আধুনিক বিজ্ঞানের বদৌলতে
প্রযুক্তির উন্নতি ঘটলেও গ্রামাঞলে এখনাে স্টোভের ব্যবহার প্রচলিত।
বিদ্যুৎ শক্তি : বিদ্যুৎ শক্তির ব্যাপক প্রচলন ঘটায় আমাদের ঘরে ঘরে
আধুনিককালে তার সাহায্য ছাড়া এক মিনিটও চলে না। বৈদ্যুতিক উনান থেকে শুৱ কৱে
রেডিও, টেলিভিশন, ফ্যান, টেপরেকর্ডার, ফ্রিজ, পানি তােলার মেশিন, ঘর সাফাই মেশিন,
মশলাটা ও নানা খাদ্য গুড়া করার মেশিন, বাসন ও কাপড় ধােয়ার যন্ত্র, শীতাতপ
নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ইত্যাদি সবই চলে বিদ্যুতের সাহায্যে। আর এগুলাে সবই আমাদের
গৃহকায়ে ব্যবহৃত হয়। বৈদ্যুতিক বাতির আলােয় আলােকিত হয় আমাদের ঘর। বর্তমানে
অনেক গ্রামের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলাে জ্বলে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ও ভােল্টা
বিদ্যুতের আবিষ্কার ও উন্নয়ন করে আমাদের গৃহকার্যকে যেমন সহজ করে দিয়েছেন,
তেমনই করে দিয়েছেন আরামদায়ক জীবনের ব্যবস্থা।
রেডিও : সমগ্র দেশে আজ অনুসন্ধান চালালে প্রায় প্রতিটি ঘরেই একটি করে
রেডিও পাওয়া যাবে। নিভৃত পল্লিতে, যেখানে বিদ্যুৎ শক্তি পৌছে নি, সেখানেও
ব্যাটারির সাহায্যে রেভিও চলে। ব্যাটারিও বিজ্ঞানের অবদান। রেডিওর প্রভাতী ঘােষণা
শুনে আমাদের অনেকের ঘুম ভাঙে। রেডিও বা বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে আমরা দেশ ও বিশ্বের
নানা সংবাদ ঘন্টায় ঘন্টায় জানতে পারি এবং শুনতে পারি নানা অনুষ্ঠান। তাই
মার্কনি আবিষ্কৃত বেতার যন্ত্র আমাদের ঘরে ঘরে জীবনের একটি অংশ হয়ে পড়েছে।
টেলিফোন : শহরের ঘরে ঘরে আজ টেলিফোনের ব্যবহার আছে। এর সাহায্যে ঘরে বসে
দূরের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের খোঁজ খবর নেওয়া যায়। ব্যবসায় বাণিজ্যের
তদারকি করা যায়। বর্তমান যানজটের পরিস্থিতিতে এর চেয়ে সহজ যােগাযােগ মাধ্যম আর
নেই। তাই বিজ্ঞানের আবিষ্কার টেলিফোন গৃহকার্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
টেলিভিশন : বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার টেলিভিশন। শহরের প্রায়
প্রতিটি ঘরেই খুঁজলে একটি টেলিভিশনের সন্ধান পাওয়া যাবে। রেডিওতে আমরা যে সংবাদ
শুনতে পাই, টেলিভিশনে সেই সংবাদের সাথে সংবাদ পাঠক ও সংবাদের নানা দৃশ্য দেখতে
পারি। আধুনিক স্যাটেলাইট ব্যবস্থায় টেলিভিশনের মাধ্যমে আমরা ঘরে বসে দেখতে পারি
এশিয়াড, বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশ্বকাপ ক্রিকেট, অলিম্পিক গেমস, রেসলিং ইত্যাদি খেলা।
গ্রামাঞলে যেখানে বিদ্যুৎ পৌছে গেছে সেখানেও টেলিভিশন আছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে
আমাদের গৃহজীবন হয়েছে আনন্দময়। এটি চিত্তবিনােদনের উৎকৃষ্ট মাধ্যম।
ফ্রিজ : বিজ্ঞান আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করে দিয়েছে। গৃহজীবনকে করেছে
আরামপ্রদ। ফ্রিজের বদৌলতে আজ আর আমাদের প্রতিদিন বাজারে যেতে হয় না। একবার
বাজারে গিয়ে কয়েক দিনের বাজার এনে ফ্রিজে রেখে দেওয়া যায়। ফ্রিজ থেকে
প্রয়ােজনমতাে পণ্য সামগ্রী নিয়ে গৃহিণী রান্না করতে পারে। মােটামুটি স্বচ্ছল
পরিবারগুলােতে গৃহকার্যে ফ্রিজের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
বৈদ্যুতিক পাখা : বাংলাদেশ নাতিশীতােষ্ণ দেশ হলেও শীতকাল ছাড়া বাকি সব
ঋতুতেই কম বেশি গরম থাকে। আর এই গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাতাস প্রয়ােজন
হয়। বিজ্ঞানের আবিষ্কার বৈদ্যুতিক পাখা আমাদের বাতাস দেয়। আমাদের জীবনকে আরাম
দেয়। বিজ্ঞানের অবদানের মধ্যে আমাদের গৃহকার্যে নিত্য প্রয়ােজনীয় একটি সামগ্রী
বৈদ্যুতিক পাখা।
সংবাদপত্র : প্রতিদিন সকাল বেলা সংবাদপত্র না হলে আমাদের চলে না। এর
মাধ্যমে আমরা ঘরে বসে প্রতিদিনের বিশ্ব পরিস্থিতি, বাজার দর, খেলার খবর, চাকরির
খবর ইত্যাদি জানতে পারি। সংবাদপত্রের লেখাগুলাে যে কলম দিয়ে লেখা হয়, যে
কম্পিউটার দিয়ে অক্ষরবিন্যাস করা হয় এবং যে মুদ্রণযন্ত্র দিয়ে ছাপা হয়, তাও
বিজ্ঞানের অবদান। যে কাগজে সংবাদপত্র ছাপা হয় তাও বিজ্ঞানেরই আবিষ্কার। সুতরাং
সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমাদের গৃহকর্যে বিজ্ঞানই ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস : আজ শহরের প্রতিটি বাড়িতেই প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত
হচ্ছে। গ্যাস ছাড়া আজ আর শহরের বাড়িতে চুলা জ্বলে না, খাদ্য রান্না হয় না
গ্যাস না হলে তাই আমাদের জীবনের সাথে মিশে গেছে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার। এই
গ্যাসের আবিষ্কার ও গ্যাসকে জ্বালানির উপযােগী করে তােলার সাথে বিজ্ঞান
ওতপ্রােতভাবে জড়িত।
টিচিং কম্পিউটার : বিদেশে নামমাত্র দামে টিচিং কম্পিউটার পাওয়া যায়।
সেসব কম্পিউটারের সাহায্যে ঘরে বসে ছেলেমেয়েরা নিজে নিজেই বিভিন্ন বিষয়ে
লেখাপড়া করতে পারে। এছাড়াও রয়েছে বর্ণ পরিচয় ও এক দুই শেখানাের কম্পিউটার
শিক্ষক। এই কম্পিউটার বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। এছাড়াও বিজ্ঞানের আরও
নানা আবিষ্কার আমাদের গৃহকার্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন- বৈদ্যুতিক বাস্তু, মশলাবাটা
ও খাদ্য গুড়া করার মেশিন, ঘর সাফাই মেশিন, বাসন ও কাপড় ধােয়ার যন্ত্র, শীতাতপ
নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, সেলাই মেশিন, বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি, টাইপ রাইটার মেশিন, টেবিল
ল্যাম্প, ভি.ডি.ও, ক্যালকুলেটর, ইলেকট্রনিক খেলনা ইত্যাদি।
উপসংহার : আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সাথে এক হয়ে গেছে বিজ্ঞান। আজ
বিজ্ঞানকে বাদ দিলে আমাদের বেঁচে থাকা দুরূহ। মানুষ বিজ্ঞানকে ব্যবহার করছে তার
নিত্য কর্মে। দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান মানুষকে শুধু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই দিচ্ছে না,
মনকেও করছে পরিশীলিত। আমাদের গৃহকার্যে ও জীবনে তাই আমরা বিজ্ঞানকে বরণ করেছি,
প্রয়ােজনের অনুরাগে।