“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
-কাজী নজরুল ইসলাম
বিশ্বের মােট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। পুরুষের পাশাপাশি নারী কল্যাণকর অনেক কাজ করলেও ইতিহাসে তার প্রমাণ খুব কমই দেখা যায়। তবে বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে নারী সমাজের প্রভূত উন্নতি ও অগ্রগতি চোখে পড়ার মতাে। তারপরেও কিছু সমস্যা থেকেই যায়। বিশ্বে এখনও এমন বহু নারী আছে, যারা ধরেই নেয় তাদের জন্ম হয়েছে পরের সেবা করার জন্য। নারী কন্যা-জায়া-জননীরূপে সৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকেই পুরুষের সেবা করছে। নারীকে বার বার বঞ্চিত করেছে সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি পরিবার। একবিংশ শতকে এসেও দেখা যায় নারীর পরাধীনতা। নারী স্বাধীনতার জোয়ার উঠলেও তা কেবলমাত্র কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।
বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলাের সাথে তাল মিলিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও নারীবাদী সংস্থা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন দলিল প্রকাশ করেছে। ইউরােপ-আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মতাে দেশও নারীর অধিকার বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় নারী অগ্রগতির জন্য প্রশংসিতও হয়েছে তারা। মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে, কিছু পশ্চাৎপদ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের হুমকিতে কোনাে দেশের সরকারই নারীর অগ্রযাত্রায় সহায়তার পথ থেকে সরে আসতে পারে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই দাবি উঠেছে নারীকে কোনাে ধর্মীয় পরিচয়ে নয়; বরং একজন মানুষ ও নাগরিক হিসাবে সমান সুযােগ, অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের। সে পথ ধরেই পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও নারীতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা উঠে এসেছে খাতা-কলমে তাে বটেই, মানুষের চেতনাতেও।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে জাতিসংঘ সর্বাত্মকভাবে কাজ করছে। নারীর মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টিকে জাতিসংঘ ৭০-এর দশক থেকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্ব নারীর ক্ষমতায়নে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের প্রভাবশালীদের তালিকাতেও নারীদের অবস্থান দেখা যাচ্ছে। ডাক্তার, প্রকৌশলী, পাইলট থেকে শুরু করে প্রায় সবক্ষেত্রেই নারী তার সাফল্যের প্রমাণ রাখছে।
উন্নত দেশগুলাে যেমন নারীর শ্রমকে স্বীকৃতি প্রদান করছে তেমনি ধর্মীয় ও সামাজিক অজ্ঞতার মাঝে যেসব রাষ্ট্র আবদ্ধ তারা আবার নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে। মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক রাষ্ট্রেই নারীর শ্রমকে অবহেলার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। নারীকে সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি পরিবারেও কোনাে মতপ্রদানের স্বাধীনতা দেওয়া হয় না। ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব উইমেন বা এনওডাব্লিউ জানিয়েছে বিশ্বের তিনজন নারীর প্রতি একজন এখনও নির্যাতন, শ্লীলতাহানি এবং বঞনার শিকার হয়ে থাকে। আর বিশ্বের কোনাে কোনাে দেশে এই সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশেরও বেশি।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের চিত্র বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতাে এক নয় ভিন্ন এ জন্য যে এ দেশের সংস্কৃতি ভিন্ন। বাংলাদেশের নারী পরিবারের ও প্রতিদিনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও নতুন কোনাে চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। এই কথাটি প্রমাণ করে বাংলাদেশে পারিবারিক জীবনে নারীর ক্ষমতায়ন আক্ষরিক অর্থে হয়নি। তেমনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরােধীদলীয় নেত্রী নারী হওয়া সত্ত্বেও এদেশে নারী অধিকার সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকেও তাদের পদগুলাে ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত। পুরুষের পাশাপাশি আমাদের নারী নেত্রীরাও সংসদে জাতীয় সমস্যা সমাধানে নিজেদের নিয়ােজিত রেখেছেন।
বাংলাদেশে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারী সমাজের অবকাঠামােগত কোনাে উন্নয়ন চোখে পড়ার মতাে নয়। শিক্ষার হার বাড়লেও এখানে আমাদের সমাজে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যৌতুক প্রথার মতাে ভয়াবহ সমস্যা এখনাে আমাদের সমাজে বিদ্যমান। যৌতুকের জন্যে এখনাে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হচ্ছে, এর ফলে কখনাে কখনাে মৃত্যুবরণ করছে অনেক গৃহবধূ। তবে এতাে কিছুর পরও নারীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে তখন তার সাথে পাল্লা দিয়ে নারী সমাজও তাদের অবদানের স্বাক্ষর রাখছে। তাই দেখা যায় একবিংশ শতকে এসে নারীরা আজ মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছেন, জয় করছেন হিমালয় পর্বত। বিজ্ঞান-সাহিত্য-রাজনীতি সবখানে পুরুষের পাশাপাশি নারীর পদচারণা বিশ্বকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশা পূরণই হােক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।