আমার একার আলো সে যে অন্ধকার,
যদি না সবারে অংশ দিতে পারি তার।
ভাব - সম্প্রসারণ : আত্মকেন্দ্রিক সুখ-ভােগ, আনন্দ-উল্লাস প্রকৃত সুখ বা আনন্দ নয়। প্রকৃত সুখ হচ্ছে সুখী সমাজ গঠন করে সবার সুখে সুখী হওয়ার মধ্যে। পরিবার, সমাজ, প্রতিবেশ পরিবেশের সাথে অংশীদারিত্ব না থাকলে ব্যক্তিগত কোনাে সাফল্যই প্রকৃত সাফল্য নয়। একটি ফুলে মালা হয় না, একটি গাছে বাগান হয় না, এক বিন্দু ফটিক জলে ঝরনা হয় না, একটি তারার আলােয় আকাশ মনােরম হয়ে সাজে না। কাজেই যত ভালােই হােক, একজনের সাফল্যই প্রকৃত সাফল্য নয়। সবার সাফল্যই প্রকৃত সাফল্য। সবাই পেছনে পড়ে থাকলে দৌড়ে একা হয়ে গেলে সাফল্য ম্লান হয়। তাই নিজের সাফল্য, চিন্তা, চেতনা ও কল্যাণধর্মী মনােভাবের, জ্ঞানের ও শিক্ষার আলাে সবার মধ্যে উৎকীর্ণ করাই প্রকৃত কাজ হওয়া উচিত। আত্মকেন্দ্রিকতা জীবনের জন্য পরিপূর্ণ সফলতা নয়। কারণ একার শক্তি যত বেশিই হােক, সমষ্টির চেয়ে বেশি নয়। কাজেই সমষ্টিকে বাদ দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে খুব বেশি দূর যাওয়া যায় না। শুধু নিজের মধ্যে শিক্ষার আলাে, সত্যের আলাে, ন্যায়ের আলাে জ্বেলে রাখলেই হবে না, তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে সমাজে ন্যায়, সত্য ও সুন্দর প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। সমাজে ন্যায়, সত্য, সুন্দর প্রতিষ্ঠা লাভ মানে, সমস্ত মানুষের চেতনায় তা ছড়িয়ে দেওয়া, যত্ন দিয়ে গড়ে তােলা। সবার প্রাণে যদি আলােক শিখা জ্বলে তাহলে সে আলােয় জগৎ ভরে উঠবে। তখন অন্তরের আলােয় সারা পৃথিবী সুখ-শান্তিতে ভরে উঠবে; পৃথিবী থেকে সমস্ত অকল্যাণ অসুন্দর দূর হবে; মানুষ পরস্পরে আলাের বন্ধনে, প্রেমের বন্ধনে, সুন্দরের বন্ধনে বাঁধা পড়বে। কাজেই আমাদের নিজের মহৎ গুণ, চেষ্টা, কর্ম যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা নিয়ে মিথ্যা অহংকারে মত্ত না হয়ে, আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থমগ্ন না হয়ে সবাইকে তার ভাগ দিতে হবে। সবাইকে নিয়ে সুন্দরের পথে এগিয়ে যেতে হবে। জগতে বহু কল্যাণকামী মনীষী, পণ্ডিত ব্যক্তি এই আদর্শের ভিত্তিতে কাজ করে তাদের জ্ঞানের আলােয়, প্রাণের আলােয় আমাদের আলােকিত করে গেছেন। আমরাও তাদের মতাে নিজেদের সমাজের কল্যাণে আত্মনিয়ােগ করব, সমাজকে গড়ে তুলব। আমাদের জ্ঞানের আলাে ছড়িয়ে যাবে জগতের সমস্ত অন্ধকারকে দূর করার নিমিত্তে।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
মূলভাব : শুধু নিজের জীবনকে আলোকিত করে রাখার ভাবনা স্বার্থপরতার নামান্তর। সবার অংশগ্রহণে আলোকিত জীবন গড়াতেই মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। বিলিয়ে দিলে আলোর পরিমাণ বাড়ে বৈ কমে না।
সম্প্রসারিত ভাব : সামাজিক জীব হিসেবে প্রত্যেক মানুষ নানা সূত্রে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। সকলেরই ব্যক্তিগত জীবন আছে। তবে সম্মিলিত জীবন-ব্যবস্থাই মানুষের ব্যক্তিগত অর্জন কিংবা আনন্দকে সার্থক করে তোলে। সমাজ বিকাশের ধারাক্রমে তাই দশজনের সঙ্গে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করাটাই মানবজাতির স্বাভাবিক ধর্ম বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। আপনাকে নিয়ে নিমগ্ন থাকা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। ফলে সমাজে বাস করে কেউ যদি নিজেকে একক সত্তা ভেবে নিয়ে আপন স্বার্থচিন্তায় মশগুল থাকে তবে তাকে ব্যার্থ মানুষ বলা যায় না। মানুষকে তাই কারো না কারো সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকতে হয়। আর নিজেকে ভাগাভাগি করারএ বৈশিষ্ট্যই মানুষকে প্রাণিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। 'Joy and happiness, when it is shared' – এই ইংরেজি প্রবাদবাক্যটির মতোই আমাদের উচিত জীবনের সকল আনন্দ ভাগাভাগি করে বাড়িয়ে নেওয়া এবং তাকে যথার্থ আনন্দে রূপান্তরিত করা। শুধু নিজের ঘরের অন্ধকার দূর করার সামর্থ্যে, যে মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে, সমাজে সে মানুষের কোনো মূল্য নেই। বরং সকলের ঘরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোকবর্তিকা জ্বালাতে পারলে, সবার ক্ষুদ্র দুঃখগুলো দূর করতে পারলে জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়।
মন্তব্য : একজন ব্যক্তিমানুষ সমাজে একক কোনো সত্তা নয়। সকলের সঙ্গে মিলেই তার জীবন সার্থক হয়, সমৃদ্ধ হয়। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে অন্যের উপকারে লাগলেই তাকে প্রকৃত মানুষ বলা যায়।