'অর্জন' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।
অর্জন
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা...” গানটি শুনে বিনম্র শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে গেল সুমনার মন। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে ধীরে ধীরে গিয়ে বসল স্মৃতিসৌধের পাশে বড় গাছটির গোড়ায়। ভাবতে লাগল সেই মহান বীর যোদ্ধাদের কথা। যাঁদের জন্য সুমনা এবং বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে, চলতে পারছে, চাকরি পাচ্ছে, ব্যবসায় করছে। সম্মানের সঙ্গে বেঁচে আছে। এ রকম মানসিক অবস্থা সুমনার প্রায় হয়। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত বিশেষ দিনগুলোতে, যেমন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস প্রভৃতি দিনগুলোতে। সুমন ভাবতে থাকে এ দেশ ও দেশের মানুষের জন্য অজস্র বীর মুক্তিযোদ্ধার রয়েছে অপরিসীম আত্মত্যাগ। সেই ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই জ্ঞান সুমনা যেমন পেয়েছে বই পড়ে তেমনি পেয়েছি পরিবার থেকে। এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে তার পরিবার সরাসরি জড়িত। ঘটনাটি সুমনা শুনেছে তার বাবার কাছে থেকে। এসব দিবসে সুমনার বাবাও বেশ আপ্লুত হয়ে যান। সুমনার বাবা শুনেছে যে, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের ৩ তারিখ। সুমনাদের বাড়িতে সেদিন অনেক মানুষ। পাকিস্তানি মিলিটারির ভয়ে শহর থেকে এসেছে সুমনার দুই চাচা, চাচি, চাচাত ভাই বোনেরা। আরও এসেছে সুমনার মামা ও সন্তানসম্ভবা মামি। বাড়িতে ছিলেন সুমনার দাদা, দাদি। সুমনার বাবা রফিক সাহেব তখন খুব ছোট। সেই দিন রাতে সুমনার দাদা, দুই চাচা, মামা খেতে বসেছেন। সুমনার দাদি সবাইকে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন। এমন সময় সেই বাড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারিরা হানা দেয়। মিলিটারির সঙ্গে আসে এলাকার কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার। তারা বাড়ির সদর দরজায় খুব জোরে আঘাত করতে থাকে। সুমনার দাদা সবাইকে শান্ত থাকতে বললেন। সুমনার বাবা ভয়ে বাড়ির পাশে একটি গাছের উপর উঠে বসেন। সেখান থেকে দেখেন, মিলিটারিরা দরজা ভেঙ্গে বাড়িতে প্রবেশ করে। তারপর সেই রাজাকার বলে যে, সুমনার বড় চাচা সাহেদ মুক্তিযোদ্ধা। এরপর মিলিটারিরা সুমনার দাদা, দুই চাচা, মামাকে সারি করে দাঁড় করায়। তারপর সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। মামি এগিয়ে গেলে সেই রাজাকার মামির পেটে লাথি মারে। মামি সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় মাটিতে। তারপর একজন মিলিটারি গুলি করে হত্যা করে তার মামিকে। সুমনার বৃদ্ধ দাদিকেও তারা রেহাই দেয়নি। সেই রাতে শুধু বেঁচে ছিল সুমনার বাবা। পুরো পরিবারটিকে সেদিন ধ্বংস করে দিয়ে মিলিটারিরা যায় পাশের বাড়িতে। একই তান্ডবলীলা চালায় সেখানেও। একে একে গোটা গ্রামই তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। সুমনা আজ জানে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিলিটারিরা ও তাদের দোসর এদেশের রাজাকাররা গোটা দেশেই এমন ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি করেছিল। দীর্ঘ নয় মাস ধরে তারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। অবশেষে পরাজিত হয় সেই দানবশক্তি পাকিস্তানি মিলিটারি। আর আমরা অর্জন করি আমাদের মহান স্বাধীনতা। এই কারণে বিশেষ করে বিজয় দিবস এলেই সুমনার মনে হয় এই রাতের কথা। তার দাদা দাদির কথা, চাচা চাচি, মামা মামি, চাচাত ভাই বোনদের হারানোর কথা। এদেশের বিজয়ের জন্য সুমনার মতো অনেককেই হারাতে হয়েছে আপনজনদের। তাঁদের কথা মনে করেই শ্রদ্ধায়, আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে সুমনা।