‘আশায় বসতি’ শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখো।
আশায় বসতি
বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাজ করে বাবুলের মা। বাবুলকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার আশা
বুকে। হঠাৎ একদিন হনহন করে কোমরে কাপড় গুঁজতে গুঁজতে হেঁটে আসতে দেখা গেল
আকলিমা খাতুনকে। দূর থেকে কে যেন মিহি গলায় ডাক দিল তাকে, 'ও বাবুলের মা, কই
যাও? খাঁড়াও। খাঁড়াও কইলাম। পাশের বাড়ির হোসেনের মাকে দেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও
আকলিমাকে তার হাঁটার গতি কমাতে হলো। আকলিমা উত্তর দেয়, ‘খাঁড়ানের কাম নাই,
বাড়ির থন আইছি, পোলাডারে চারডা খাওয়াইয়া আবার বিবি-সাবের বাড়ি যাইবার
লাগছি। তোমার কী হইছে? ও মনে পড়ছে, তোমার ট্যাহা! দিমুনে, দিমুনে এই
বিষ্যুৎবার দিমুনে। এইবার আর দেরি হইত না।'
কথা কয়টা বলেই আকলিমা আবার হনহন করে হেঁটে চলে যায়। প্রতিদিন ঠিক সকাল ৭টা আর
বিকেলের পর তাকে দেখা যায় ঢাকা উদ্যানের বেড়িবাঁধ ধরে হেঁটে আসতে। এ হেঁটে
চলা যেন নিরন্তর। জীবন যেমন থেমে থাকে না, এ হেঁটে চলারও যেন শেষ নেই। সেই কবে
পদ্মার ভাঙনে সব হারিয়ে ঢাকার এই বস্তিতে এসে উঠেছিল দুই বছরের ছেলে বাবুলকে
নিয়ে। তারপর থেকে এই ছুটে চলা। সারাদিন চার-পাঁচটা বাসায় কাজ করলেও এই
ম্যাডামের বাসায় তাকে দিনে দুই বেলা হাজিরা দিতে হয়। সারা মাসে যা আয় করে তা
দিয়ে ঘর ভাড়া দেওয়ার পর বেশির ভাগটাই চলে যায় বাবুলের পড়াশোনার পেছনে।
স্বামী রিকশা চালিয়ে সারাদিনে যা আয় করে, দিন শেষে নেশা করে সেই টাকা নষ্ট
করে ফেলে। ফলে তার সংসারে অভাব আর অশান্তি লেগেই আছে। কিন্তু আকলিমার স্বামী
সবসময় এমন ছিল না। হাসিখুশি শান্ত স্বভাবের মানুষটা বাপ-দাদার ভিটে হারানোর পর
কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। ঢাকায় এসে একটা রিকশা জোগাড় করতে পারলেও কেমন যেন
হয়ে গেল। এ ঢাকা শহরের বাতাস কেমন জানি আউলা-ঝাউলা। মানুষরে কেমন জানি
বদলাইয়া দেয়... এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আকলিমা সাদা রঙের বিশাল বাড়িটার
সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিনের মতো বাড়ির সব কাজ করতে করতে আকলিমার মনে হয়, এ বাড়ির সব কিছুই
সুন্দর! মানুষগুলো, আসবাবপত্র, এমনকি বাড়ির টাইলস পর্যন্ত ঝকঝক করে। আকলিমা
ভাবতে থাকে, 'যদি আমার বাবুলরে আমি লেখাপড়া শিখাইয়া অনেক বড় ডাক্তার
বানাইবার পারতাম, তাইলে হয়তো ওর বাড়ির টাইলসও এইরাম ঝকমক করত।' কাজ করতে করতে
আনমনা হয়ে যায় আকলিমা। হুঁশ ফেরে বাড়ির দারোয়ানের ডাকে, ‘কেডা জানি বাবুলের
মার লগে দেহ্যা করতে আইছে। মনের মধ্যে কেমন জানি হঠাৎ কু-ডাক ডাকতে থাকে
আকলিমার। দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখে নিচে দাঁড়িয়ে আছে পাশের বাড়ির
আমেনা। কেমন যেন ভয়ংকর, আতঙ্কিত চেহারা। আকলিমা আমেনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে
তাকিয়ে থাকে। কথা বলতে যেন ভুলে গেছে। আমেনা বলে ওঠে, 'বুবু, আমার লগে লও
বাড়িতে যাই।' আকলিমার কোনো সন্দেহ থাকে না। নিশ্চয়ই খারাপ কোনো খবর।
বিবি-সাহেবকে বলে আসার কথাও যেন সে ভুলে যায়। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ
দেখতে পায় এক দল মানুষের ভিড়। বাবুল দৌঁড়ে এসে মাকে আঁকড়ে ধরে বলে, 'মা,
ওরা বাজানরে সাদা কাপড়ে...।' বাবুল কান্নার তোড়ে কথা শেষ করতে পারে না।
আকলিমা যেন দুঃস্বপ্ন দেখছে। সব কেমন জানি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আকলিমা
বাবুলকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে। চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি ঝরতে থাকে তার। কী
সান্তনা দেবে সে তার এই অবোধ শিশুকে। জ্ঞান হারানোর আগে সে আঁকড়ে ধরে তার শেষ
সম্বল বাবুলকে ৷ বাবুলকে যে তার মানুষ করতেই হবে।