ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ‘বৈসাবি’ উৎসব পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা কর।
'বৈসাবি' পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পাহাড়িদের নতুন বছরকে বরণ করে
নেওয়ার উৎসব। টিপরারা (ত্রিপুরা) পালন করে ‘বৈসুব’ মারমারা পালন করে 'সাংগ্রাই'
আর চাকমারা পালন করে 'বিজু'- এই তিনটি উৎসবকে একত্রে বলে বৈসাবি। বৈসাবি'র প্রথম
দিন দুই ভাতিজি আমাকে প্রথমে নিয়ে গেল চাকমা পাড়ায়। পুরো পাড়াটি যেন পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন এবং ফুল দিয়ে সাজগোজের মহড়া দিচ্ছিল। চাকমা কিশোর-কিশোরীরা পাহাড়ি
বন থেকে ফুল সংগ্রহ করে ঘর সাজিয়ে তোলায় ব্যস্ত। চাকমাদের মতো মারমা ও টিপরারাও
উৎসবের প্রথম দিন ফুল দিয়ে ঘর সাজায়, গৃহিণীরা ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে। পুরনো
দিনের সমস্ত ক্লান্তি দুঃখ-বেদনা ঝেড়ে ফেলার জন্য তারা যেন বাড়ির সবকিছু
ধুয়েমুছে পবিত্র করে তোলে। দ্বিতীয় দিন খুব ভোরে ভাতিজির আমাকে ঘুম জড়ানো চোখে
চাকমা পাড়ায় টেনে নিয়ে চলল। সেখানে দেখি, পাহাড়ি ঝরনায় স্নান করে শরীরকে
পবিত্র করে নেওয়ার জন্য বয়স্করা ছেলেমেয়েদের উৎসাহ যোগাচ্ছেন। স্নান সেরে
প্রতিটি বাড়িতে কাচকলা, পেঁপে, পটল, আলু, বেগুন, কচি কাঁঠাল ইত্যাদিসহ কমপক্ষে
পাঁচ প্রকার সবজি ‘পাচন’ রান্না করা হয়েছে। আগত অতিথিদের পাচন পরিবেশন করে
আপ্যায়িত করা হচ্ছে। আমরাও ফৌজিয়ার এক বান্ধবীর বাড়িতে পাচন খেতে বসে গেলাম।
স্বাদ অমৃত! প্রচলিত ধারণা, কমপক্ষে ৫ ঘরের পাচন খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
বাড়ে। বৈসাবি'র দ্বিতীয় দিন মারমা তরুণ-তরুণীরা মধ্যকার পানি বর্ষণ অনুষ্ঠানের
বৈচিত্র সৌন্দর্য ও রোমান্স এখন মিডিয়ার বদৌলতে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও
বিনোদনের অন্যতম বিষয়। বৈসাবি'র তৃতীয় দিন বাঙালির পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ।
নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে আমরা বৈশাখী মেলায় গেলাম। পাহাড়ি লোকেরাও বৈশাখী
মেলায় শামিল হল। রাতে চাকমা, মারমা, টিপলাম সবার বাড়িতেই সামাজিক ও ধর্মীয়
নানা আচার ও উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে নতুন বছরকে শুভ কামনায় বরণ করে নেওয়া হয়।
চাকমারা বৌদ্ধভিক্ষুদের ডেকে মঙ্গলসূত্র শোনার অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। মারমারা
মন্দির বা কিয়াংয়ে নানা মোমবাতি জ্বালিয়ে নতুন বছরের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনার
অনুষ্ঠান করে। আর সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী টিপরারা করেছিল দেওয়ালী দিপাবলী উৎসব।
একে অপরকে রং মাখিয়ে নতুন বছরকে তারা রঙিন করে তুলেছিল। ‘বৈসাবি’ উৎসবে রয়েছে
সামাজিক বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্র্যময়তা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর
‘বৈসাবি’ উৎসবের তিন দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠান আমার দুই ভাতিজির সঙ্গে আমাকেও
প্রচুর আনন্দ দান করেছে।