"বর্ষার একটি রাত" শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখো।
বর্ষার একটি রাত
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়তেই কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। শুনেছিলাম আষাঢ় মাসে
মেঘ ডাকলে নাকি ক্ষেতের আল পার হওয়ার আগেই বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। বাইরে যাওয়ার
প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মেঘের ঘনঘটা দেখে মন দমে গেল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই লাইন ক’টি-
“নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে ।”
প্রকৃতি যেন এরই অপেক্ষায় ছিল। আকাশের গাল বেয়ে ছুটে বৃষ্টির ধারা। ভাবলাম,
বর্ষণমুখর এই সন্ধ্যেটা ঘরেই কাটুক। আষাঢ় মাস। সারাদিন আকাশ ছিল ঘন মেঘে ঢাকা।
বর্ষার ঝরঝর সারাদিন ঝরছে তোঁ ঝরছেই বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। অবিশ্রান্ত বর্ষণের
এযেন মহোৎসব। বৃষ্টি বিধৌত পথের দুপাশে জমে উঠেছে পানি। আশেপাশের ডোবা-নালাও
পানিতে টইটুম্বুর। সারাদিন ঘরে বসেই কাটল । ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাইরে বের হওয়া
সম্ভব হয়নি। একসময় আঁধার ঘন হয়ে আসল। বুঝতে পারলাম, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
পশ্চিম আকাশের সূর্যাস্তের বর্ণবাহর আজ কারো চোখে পড়ল না। এরপর নেমে এলো রাত।
আজকের রাত অন্যান্য যেকোনো রাত থেকে ভিন্ন। ঘরের ভেতর আঁধারের আল্পনা। জানালা
খুলে দূরে দৃষ্টি দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু চারদিক ঝাপসা। প্রকৃতি যেন স্নিগ্ধ,
শান্ত ও পরিচ্ছন্ন। একদিকে রাতের অন্ধকার, অন্যদিকে বৃষ্টির প্রচণ্ডত—, দুয়ে
মিলে কি চমৎকার এক প্রকৃতি।অন্ধকারে একা বসে আছি। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে
আর। মাঝে মাঝে পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ ভাসছে। দূরে ডাহুকের ডাক মনে ভয়ার্ত
শিহরণ জাগাচ্ছে। ঝিঝি পোকার একটানা ঝি ঝি ডাক এবং ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর মিলে এক
অপূর্ব ঐকতানের সৃষ্টি করছে। অন্য সময় যা বিরক্তিকর মনে হত, এই বর্ষণমুখর রাতে
তাও মনে এক রকম ভাল লাগার রেশ সৃষ্টি করল। বৃষ্টির সময় বই পড়া ভারি মজা, তাই
‘মেঘদূত’ হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। ‘মেঘদূত’ কাব্যের কথায় মনে পড়ল। এমন
বর্ষণমুখর সন্ধ্যাতে নিশ্চয়ই যক্ষ মেঘকে দূত করে পাঠিয়ে রামগিরি পর্বতে একা
নিঃসঙ্গ হয়েছিলেন। মনে পড়ল সেই উড্ডয়িনী, সেই অবন্তী, সেই শ্রাবন্তী, সেই
বিদিশা নগরী; রেবা, শিপ্রা নদী।
বৃষ্টি আরও প্রবলভাবে নেমে এল। রাতের নিবিড় অন্ধকার ছেয়ে ফেলল সমস্ত
বিশ্বচরাচর। বারিধারার অবিশ্রাম ধ্বনিতরঙ্গ মিলে এক অন্য রকম পরিবেশের সৃষ্টি হল।
আমি অবাক হয়ে ভাবতে থাকলাম, সেই বিরাট শিল্পীর কথা, যাঁর এই বিপুল আয়োজন।
বর্ষার রাতে আমার মত নিরস, কাটখোট্টা মানুষের মনেও ভাবনার উদ্রেক করে দিল। আর আমি
ভাবতে থাকলাম, এ জন্যই বর্ষাকে নিয়ে বাঙালি কবিদের এত মাতামাতি, এত হৈ চৈ।