'দুর্ঘটনা' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।
দুর্ঘটনা
হঠাৎ রিকশার ডান চাকাটি খুলে দৌঁড়াতে লাগল। আমি আর বনি ছিলাম রিকশার যাত্রী। আমি
আর রিকশাচালক বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়লাম। কিছুটা ঘোর কাটতেই আমি বুঝতে পারলাম
প্রকৃত ঘটনা। রিকশাচালক বেশ দ্রুত গতিতে রিকশাটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় পেছন
থেকে একটি গাড়ি এসে ধাক্কা দেয় রিকশাটিকে। সেই ধাক্কাতেই রিকশার চাকাটি খুলে
সামনের দিকে গড়িয়ে যেতে থাকে। পেছনে থাকিয়ে দেখি গাড়িটি আর নেই। অর্থাৎ
রিকশাটিকে ধাক্কা মেরেই গাড়িটি সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতগতিতে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে।
প্রচন্ড রাগ হলো সে গাড়ি চালকের উপর। নূন্যতম সৌজন্য কিংবা দায়বোধ নেই তাই।
হঠাৎ মনে হলো বনি কোথায়? আমি আতঙ্ক আর আশঙ্কায় দৌঁড়ে গেলাম রিকশার কাছে। গিয়ে
দেখি বনি পড়ে আছে রিকশাটির নিচে। আমার ডান পাশে বসে ছিল বনি আর রিকশার ডান
চাকাটি খুলে গেছে। রিকশাটির কাছে যেতেই রিকশা চালককে দেখতে পাই। সে খুব ব্যথা
পায়নি। তবে তারও বেশ লেগেছে। রিকশাটি তুলতে যাবো এমন অবস্থায় সামনে তাকিয়ে
দেখি স্কুলের পোশাক পড়া একটি শিশু রাস্তায় পড়ে আছে। বুঝতে বাকি রইল না
যে, রিকশার চাকাটি সামনের দিকে দ্রুত গিয়ে শিশুটির সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে। আর সেই
কারণে শিশুটি পড়ে গেছে। একটু কাছে যেতেই দেখি শিশুটির মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। এমন
অবস্থায় শিশুটির দিকে তাকাতে সাহস হলো না। ততক্ষণে রিকশাওয়ালা বনিকে উদ্ধার
করেছে। বনিও বেশ আহত। তবে বনিকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে হাঁটতে পারবে। বনিকে
বললাম,বনি দ্রুত এসো। শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বনি রিকশাচালককে কিছু
না বলে দৌঁড়ে এলো আমার কাছে। আমরা দুজনে শিশুটিকে ভর্তি করলাম হাসপাতালে।
কর্তব্যরত ডাক্তার শিশুটিকে দেখে বললেন, আঘাত লেগে ওর বেশ রক্তক্ষরণ
হয়েছে, তাছাড়া মাথায়ও গুরুতর আঘাত লেগেছে। আপনারা সময়মতো না আনলে ওকে বাঁচানো
যেত না। যাই হোক, শিশুটিকে এখুনি রক্ত দিতে হবে। আপনারা B+ রক্তের ব্যবস্থা
করুন। বনি বললো স্যার আমার রক্তের গ্রুপ B+। আপনি আমার রক্ত নিন। আমি বনিকে
বললাম,বনি তুমি এমনিতে আহত,তার ওপরে...। বনি আমাকে বাঁধা দিয়ে বললো, এই মুহূর্তে
শিশুটির জীবন বাঁচানো সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আমি কিছু না বলে গেলাম ওষুধ আনতে।
ওষুধ এনে দেখি বনি ও শিশুটি বেডে শুয়ে আছে। রক্ত ট্রান্সফার শেষ হলে বনি উঠে
দাঁড়ায়। আমি বনিকে বাইরে আনি। ডাক্তার বললেন, ঘন্টাখানেক আগে শিশুটির জ্ঞান
ফিরবে না। আপনারা অপেক্ষা করুন। ঘন্টাখানেক বাইরে ঘুরে আমি ও বনি হাসপাতালের
দিকে রওনা দিলাম। এতক্ষনে আমরা বেশ ক্লান্ত। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি হাসপাতালের
ভেতর। সেই বেডটির দিকে এগিয়ে যেতে দেখি শিশুটিকে কোলে নিয়ে একটি মহিলা আদর
করছে, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন লুঙ্গি পড়া এক ব্যক্তি। লোকটিকে চেনা চেনা মনে হলো।
এগিয়ে যেতেই দেখি লোকটি সে রিকশাওয়ালা। রিকশাওয়ালা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে
শিশুটির দিকে। আমরা বুঝতে পারলাম সে শিশুটি ছিল সেই রিকশাওয়ালার। আমি ও বনি বেশ
বিস্মিত হলাম। আমরা এগিয়ে গিয়ে রিকশাচালককে রিকশার ভাড়া দিতে গেলে রিকশাওয়ালা
আমাদের হাত ধরে কেঁদে ফেললেন।
এই গল্পটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
রিকশাযোগে কলেজের পথে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পিছন দিক থেকে একটি অটোরিকশা সজোরে ধাক্কা
দিল। তৎক্ষণাৎ এক চিৎকারে আশপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল
মিরপুর-আজিমপুর রোডের নিউমার্কেটের সামনে। আশপাশের লোকজন চিৎকার শুনে কালবিলম্ব
না করে সেখানে উপস্থিত হলো। চিৎকারটি ছিল রিকশাচালকের। পরে জানতে পেরেছিলাম তার
নাম জমির মিয়া। অটোরিকশার ধাক্কায় সে রাস্তায় পড়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ একটি বাস
এসে তাকে পিশে দিয়ে গেল । জমির মিয়া ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তার মেয়ের বিয়ের
টাকা জোগার করতে ঢাকায় এসেছিলেন সহায়-সম্বলহীন জমির মিয়ার সে আশা আর পূরণ হলো
কোথায়? তার বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। জমির মিয়া ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র
উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পরিবারের সদস্য সংখ্যা আটজন। তার ছোট বাচ্চাটির বয়স পাঁচ
বছর।
জমির মিয়ার লাশ যখন ত্রিশালে তার নিজ বাড়িতে পৌছায় তখন তাদের বাড়িতে শুরু হয়
শোকের মাতম। তার বৃদ্ধা মা বারবার ছেলের শোকে মূর্ছা যাচ্ছে আর বলছে, 'আমার যাদু
তুই কই গেলি?’ তার স্ত্রীও কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। কখনো জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন।
আবার জ্ঞান ফিরে বলছে, তার ইচ্ছা ছিল মেয়ের বিয়ে দিবে, নতুন ঘর তুলবে,
ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শেখাবে কিন্তু তার সে স্বপ্ন পূরণ হলো না ।
বাবাকে হারিয়ে জমির মিয়ার বড়ো মেয়ে শায়লা আজ বাকরুদ্ধ। ছেলের শোক সংবরণ করতে
না পেরে তার বাবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। পরিবারের একমাত্র ভরসা জমির
মিয়া অকালে মারা যাওয়ায় তারা বেঁচে থাকার সমস্ত স্বাদ আহ্লাদ বুকের ভেতরেই
মাটিচাপা দিয়েছে । প্রকৃতির নিয়মে তার মাও একদিন ছেলের শোক ভুলে গেলেন। তার
মেয়ের বিয়ে হলো, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা চলছে। কিন্তু জমির মিয়ার আর এসব দেখা
হলো না। কারণ তার আগেই এক দুর্ঘটনা জমির মিয়ার জীবন কেড়ে নিল ৷
এই গল্পটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
মাইকের তীব্র শব্দে রাশিদুল কান চেপে ধরে। হঠাৎ যেন মাথাটি বোঁ বোঁ করে ঘুরে ওঠে।
চারপাশে অনেক মানুষ কিন্তু সবাইকে ঝাপসা দেখে সে। মনে হচ্ছে সে যেন ঝিমিয়ে আসছে।
এমন সময় একটি গাড়ি তাকে সজোরে ধাক্কা দিল। যখন চোখ মেলল তখন সে হাসপাতালে। তার
দেহে যে স্যালাইনটি লাগানো ছিল, একজন নার্স এসে সেটি পরীক্ষা করে দ্রুত আবার চলে
গেল। রাশিদুল আবার ঘুমিয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পেল সাদা পোশাক ও চশমা
পরা একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি রাশিদুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—
রাশিদুল সাহেব কী খবর, এখন কেমন বোধ করছেন? রাশিদুল কিছু বলতে পারছে না, সে
ডাক্তারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। একটু পর সেই নার্স দ্রুতবেগে এসে
ধমকের সুরে বলল— 'দিন হাতটা দিন, কই দিচ্ছেন না কেন?’ নার্স ইনজেকশন দিয়ে অদৃশ্য
হয়ে গেল । ডাক্তার সাহেব যাবার আগে বললেন, ঠিক আছে রাশিদুল এখন ঘুমান পরে কথা
হবে । শূন্য ঘরে সাদা বিছানার ওপর কাতরাতে কাতরাতে মনে পড়ে- তার হাতে একটা ফাইল
ছিল। বেশ কিছুদিন হলো তার মাথায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ক্লাসে প্রায়ই মাথাব্যথায়
কাতর হতো। বন্ধুরা কত বলেছে ডাক্তার দেখাতে কিন্তু সে পাত্তাই দেয়নি। জোরে শব্দ
শুনলেই তার এই মাথাব্যথা বাড়তে থাকে। এবার সে ডাক্তার দেখিয়েছে এবং বিভিন্ন
পরীক্ষার ফাইল নিয়ে আজ ডাক্তারের কাছেই যাচ্ছিল। তারপরই তাকে এই দুর্ঘটনার
সম্মুখীন হতে হলো।