‘একজন সর্বংসহা মা' শিরোনামে একটি খুদে গল্প রচনা করো।
একজন সর্বংসহা মা
কথায় আছে— 'অভাব যখন দুয়ারে এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।
কিন্তু উল্লিখিত প্রবাদ শুধু নারী-পুরুষের অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রেম ও পরিণতির
ক্ষেত্রেই হয়তো সত্য, অনন্য ভালোবাসার ক্ষেত্রে উক্ত প্রবাদ ক্রিয়াশীল নয়।
দুপুত্র আর স্বামী নিয়ে জরিনা বেগমের ছোট্ট সংসার। বড় ছেলে গফুর উচ্চ মাধ্যমিক
পড়ছে নাটোরের সিরাজদ্দৌলা সরকারি কলেজে। আর ছোট ছেলে সালাম গ্রামেরই হাইস্কুলে
অষ্টম শ্রেণিতে। স্বামীর বেকারত্ব ও কুঁড়েমির কারণে দুসন্তানের লেখাপড়া ও
সংসারের বিপুল বোঝা প্রায় এক কাঁধেই বহন করতে হয় জরিনা বেগমকে। বড় ছেলেকে
হোস্টেলে রেখে লেখাপড়া করাতে প্রতি মাসে নির্ধারিত দেড় হাজার টাকা দিতে জরিনা
বেগমকে কী পরিশ্রমটাই না করতে হয়! হাঁস-গুরু-ছাগল পালনের পাশাপাশি নিজের
বাড়িতেই জায়গা করে ছোট্ট একটা পোল্ট্রি খামার করেছেন তিনি। প্রতিমাসে দুশর মতো
ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা কিনে নিরলস সেবাযত্নের পর মাসশেষে সেসব ওজন অনুপাতে
বিক্রি করে কিছু টাকা আয় হয় তাঁর। আর দুটি গাইগরুর দুধ ‘মাস-কাবরা' দিয়ে আসে
আরও কিছু টাকা। এছাড়া হাঁসের ডিম, গোবরের ঘুঁটি ও ব্রয়লারের বর্জ্য বিক্রি বাবদ
কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটে জরিনা বেগমের। এভাবে সবকিছু মিলিয়ে কোনো মতে বড় ছেলের
হোস্টেল খরচার জোগান হয়। আর ছোট ছেলেটি গ্রামের প্রাইমারির বাচ্চাদের টিউশনি
করিয়ে চালিয়ে নেয় তার খরচা। এছাড়া ক্লাস ফাইভে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাওয়ায়
প্রতিমাসে বৃত্তির কিছু টাকা দিয়ে সে নিজেও প্রাইভেট পড়তে পারে। তাই তো ছোট
ছেলের পড়াশোনার খরচ নিয়ে আপাতত নিশ্চিন্ত জরিনা বেগম। কিন্তু বড় ছেলে আর
সংসারের বিপুল বোঝা বহনে তিনি ন্যুব্জ। ছোট ছেলের পাশাপাশি জরিনা বেগম নিজের নাইন
পাসের যোগ্যতা দিয়ে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারেন।
প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় জরিনা বেগম ঘরের বারান্দায় কয়েক জন শিশুকে পড়ান। জরিনা
বেগম তাদের পরম যত্নের সাথে অক্ষর দেখান,নামতা শেখান, কবিতা মুখস্থ করান। মাত্র
৫০ টাকা মাসিক বেতন হওয়ায় গ্রামের অনেক ছেলেমেয়েই জরিনা বেগমের বারান্দার
স্কুলে পড়তে আসে। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরও এভাবে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে
রাত ১০-১১টা পর্যন্ত চলতে থাকে জরিনা বেগমের নৈশশিক্ষা দান। সকল পরিশ্রম জরিনা
বেগম অকপটে স্বীকার করে নেন শুধু দুছেলের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। রত্মগর্ভা মা
হিসেবে এই তো জরিনা বেগমের সর্বোচ্চ সফলতা।
অর্থাৎ সীমাহীন অভাব-অনটনের মধ্যেও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও দুর্দমনীয় ইচ্ছা শক্তি
থাকলে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব। উল্লিখিত গল্পের জরিনা বেগম তার
প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এ রকম আরও শত শত জরিনা বেগম তাদের
স্বপ্নপূরণের জন্যে নীরবে-নিভৃতে আত্মত্যাগ ও শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। জরিনা বেগমের
মতো সেসব সর্বংসহা মা-কে জানাই প্ৰণতি ৷