'যানজট' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।
যানজট
হাইওয়েতে এসে গাড়িটা আচমকা দাঁড়িয়ে গেল। আরিফ সাহেব দেখলেন তার গাড়ির সামনে
অন্তত কয়েকশ গাড়ি লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের গ্লাসটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন
পেছনেও এমন কয়েকশ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতেই প্রচন্ড গরম, তার উপর ঢাকা শহরে
মাত্রাঅতিরিক্ত তাপমাত্রা। এমন অবস্থায় রাস্তায় গাড়ির ভেতরে এভাবে বসে থাকাটা
শুধু অস্বস্তিকর নয়, প্রচন্ড বিরক্তিকরও। আরিফ সাহেব বারবার ঘড়ির দিকে চোখ বোলাচ্ছেন। অফিসের সময় প্রায় শেষ হয়ে গেল। সময়মতো অফিসে পৌঁছাতে না পারলে বস
রেগে যাবেন। তাছাড়া সকাল সাড়ে নয়টায় তাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে উপস্থিত
থাকতে হবে। এ কারণে অস্বস্তি ক্রমেই বাড়ছিল। আরিফ সাহেব ড্রাইভারকে এসিটা
বাড়িয়ে দিতে বললো। ড্রাইভার বললো, 'স্যার, মনে হয় এক ঘন্টা আগে জ্যাম ছাড়বে
না।' ড্রাইভারের কথাটি শুনতে গিয়ে আরিফ সাহেব শুনতে পেলেন, 'পেপার লন,পেপার।
এই যে প্রথম আলো, কালের কন্ঠ, জনকণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন। পেপার লন, পেপার।
গাড়ির জানালার বাইরে তাকিয়ে আরিফ সাহেব দেখতে পেলেন ১৩-১৪ বছরে একটি ছেলে
হাতে কতগুলো পেপার ভাঁজ করে রেখেছে আর প্রায় প্রতিটি গাড়ির জানালা ধরে গিয়ে
বলছে, 'পেপার লন, পেপার।' কালের কন্ঠ, জনকণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন...। দীর্ঘ
যানজটে আটকে গিয়ে অনেকেই পেপার কিনছেন এবং সময় কাটানোর জন্য পড়ছেন। ছেলেটিকে
দেখে আরিফ সাহেবের মনে পড়ল তার জীবনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ঢাকা শহরে
এভাবেই একদিন পেপার বিক্রি করতেন তিনি। সারাদিন পেপার বিক্রি করে যে টাকা
পেতেন তা দিয়েই তার ও তার মায়ের সংসার চলত। এ রকমই একদিন পেপার বিক্রির সময়
এক ভদ্রলোক মানিব্যাগ বের করে টাকা দিতে গিয়ে হঠাৎ করে পড়ে যায় সে মানিব্যাগ।
আর সে সময় গাড়িটি দ্রুত চলে যায়। এরপর আরিফ সে মানিব্যাগটি কুড়িয়ে নেন। ব্যাগ
খুলে দেখেন কতগুলো পাঁচশ টাকার নোট। সেই সঙ্গে ব্যাগের মালিকের অফিসের কার্ড।
আরিফ সেদিন সারাদিন ঘুরে ঘুরে ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই অফিসে
ঢুকে আরিক মানিব্যাগটির মালিকের কাছে ব্যাগটি পৌঁছে দেয়। ব্যাগটি পেয়ে ভদ্র
লোক খুব বিস্মিত হন এবং খুশিতে আরিফকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এরপর সেই ভদ্রলোকের
কল্যাণেই আরিফ আজ এই প্রতিষ্ঠিত হওয়া। বলা যায় সততার পুরষ্কার। গাড়ির পাশে ছেলেটিকে
দেখে আরিফ সাহেবের আজ সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। আরিফ সাহেব দেখতে পেলেন
সামনের গাড়িগুলো হঠাৎ করেই চলতে শুরু করেছে। ফলে সেই পেপারওয়ালা ছেলেটি আর
বের হওয়ার রাস্তা ঠিক করতে পারছে না। এরই এক পর্যায়ে একটি সি এন জি ছেলেটিকে
ধাক্কা দিয়ে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আরিফ সাহেব অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন।
হঠাৎ করে আবার গাড়ি থেমে গেল। আরিম সাহেব বুঝতে পারলেন আবার জ্যাম। তিনি
দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ছেলেটিকে তার গাড়িতে তুলে আনলেন। ছেলেটি
মুখ, মাথা, নাক, কান অনবরত রক্ত পড়ছে। আরিফ সাহেবের সিট ও পাশের সিট দ্রুত রক্তে
ভিজে গেল। আরিফ সাহেব বুঝতে পারলেন, যে করেই হোক ছেলেটিকে দ্রুত হাসপাতালে
নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তার সামনে বিশাল জ্যাম। গাড়ি দুই তিন ধাপ এগিয়ে আবার
থেমে যায়। আরিফ সাহেব ভাবলেন, ছেলেটিকে কোলে করে দৌঁড়ে যাবেন হাসপাতালে।
কিন্তু ড্রাইভার জানালেন তা সম্ভব নয়। তাতে অন্তত ঘন্টা দুয়েক লাগবে। আরিফ
সাহেব ছেলেটিকে কোলে নিয়ে গাড়ি ছাড়ার অপেক্ষা করছেন। ক্রমেই ছেলেটি নিস্তেজ
হয়ে পড়ছে। প্রায় এক ঘন্টা পর গাড়ি ছাড়ল দ্রুত গতিতে। হাসপাতালে পৌঁছে মাত্র
ডাক্তার জানালেন, ছেলেটি দশ মিনিট আগে মারা গেছে।