‘ঝরাপাতার গান’ বিষয়ে একটি খুদে গল্প রচনা করো :
ঝরাপাতার গান
শীত প্রায় শুরু হয়ে গেছে। সকালে সূর্য একটু দেরি করে উঠেছে। আবার সন্ধে হবার
আগেই ঘাসের ডগায় জমে যাচ্ছে কুয়াশার বিন্দু। আর রাতে প্রায় ঘরের কাছেই শোনা
যাচ্ছে শেয়াল মামার হুক্কা হুয়া ডাক। এসব কিছু পরিষ্কার বলে দিচ্ছে শীত আসতে আর
বেশি দেরি নেই। আগে এসব কিছু দেখবার মতো সময়ই ছিল না আমার। কখন বর্ষা এলো আর কখন
বসন্ত গেল মাঝে শীত এসেছিল কি না। তবে এখন এসব কিছুই আমার সম্বল। এখন প্রতিটি
মুহূর্তের হিসাব আমার কাছে থাকে। কারণ আমার যে সময় অনেক।এক সময় কি ছিল না আমার!
বাড়ি, গাড়ি, স্ত্রী, সন্তান, সম্মান সবই ছিল। আমি ছুটছিলাম বাতাসের আগে আর সবাই
আমার পিছে। আর আজ, এখন, এই মুহূর্তে আমি একা। আমার স্ত্রী মারা গেছেন বছর কয়েক
হলো। সন্তানরা সবাই দেশের বাইরে— যে যার কাজে ব্যস্ত। এখন আমার সঙ্গী এই ইজি
চেয়ার। আর বন্ধু জানালার ঠিক ওপাশের জলপাই গাছটা। আমার দিন শুরু হয় সঙ্গীর পিঠে
বসে, বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে। তবে আজকাল নিজেকে আরও বেশি একা মনে হয়। আমার তো
অনেক টাকাপয়সা। এদেশের অনেকেই আমাকে এক নামে চেনে। তবু আমার এমন লাগে কেন? মনে
হয় প্রতিদিনের সূর্য আমার কাছে এক একটা মহাকাল নিয়ে আসে। আর সেই মহাকালের সারথি
হয়ে শুধু আমি একা বেঁচে আছি। আমি যার কাছে যেতে চাইছি, সেই মৃত্যু আমার থেকে
অনেক অনেক দূরে। হ্যা, সময় আমার কানে এসে বলে যাচ্ছে, আর বেঁচে থেকে কী করবি।
চলে আয় আমার কাছে। সত্যিই তো তাই, এই একাকিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা একটা অভিশাপ নয়
কি? জলপাই গাছটার সবুজ পাতাগুলো দিনে দিনে শীতের আমেজে কেমন যেন লাল হয়ে যাচ্ছে।
হয়ত একদিন শুকিয়ে গাছ থেকে ঝরে পড়বে। এমনটাই তো হবার কথা, শুকনো পাতা তো আর
গাছের সৌন্দর্য বাড়াতে পারে না। আর তাই গাছও তাকে আঁকড়ে ধরে থাকার প্রয়োজন মনে
করে না। নতুন কুঁড়িকে স্থান দিতে হবে যে। নিজেকে আজ শুকনো পাতার প্রতিচ্ছবি মনে
হচ্ছে। পৃথিবীতে হয়ত আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। যেমনটি ফুরিয়ে যায় গাছের পাতার।
নব কিশলয় একসময় গাছের সৌন্দর্য বাড়িয়ে গাছকে সুশোভিত করে। গাছের ফলকে
নিরাপত্তা দেয়। ছায়া দেয় পথিককে। আমিও আমার জীবন দিয়ে স্বজনকে, সমাজকে
দিয়েছি অনেক। এখন দেবার কিছুই নেই। এখন শুধু শুকনো পাতার মতো পাতা কুড়ানির
অপেক্ষায়—কখন ছাই হবে ঝরাপাতা।