‘খোলাবাড়িয়ার সম্মুখযুদ্ধ' শিরোনামে একটি খুদে গল্প রচনা করো :
খোলাবাড়িয়ার সম্মুখযুদ্ধ
খোলাবাড়িয়া গ্রামে উপযুক্ত পশ্চাদৃভূমি এবং নদী থাকায় গ্রামটিকে নিরাপদ আশ্রয়
ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা নভেম্বরের ৪ তারিখেই এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং নিজেদের
সহযোগিতার জন্য গ্রামের অনেককেই গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন। গেরিলা কমান্ডার
চিত্তরঞ্জন রায়ের নেতৃত্বে আব্দুস সাত্তার, আফাজ উদ্দিন, আবুল হোসেন, আব্দুস
সামাদ দেওয়ান, দিলীপ কুমার সরকার, বেরাসত আলী, আজমল হোসেন প্রমুখ গেরিলা
যোদ্ধারা এই প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতেন। কাউসার আলীসহ গ্রামের অন্যরা
চিত্তরঞ্জন রায়ের এসব সহযোদ্ধাদের কাছে যুদ্ধের কলাকৌশল শিখে নিয়ে যুদ্ধের
জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। খোলাবাড়িয়া গ্রামের সর্বসাধারণের সহযোগিতা নিয়ে
নভেম্বর মাসেই মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোদ্ধারা 'ভি', 'ইউ' ও 'এল্' আকৃতির ৯টি
বাংকারে খুঁড়ে যুদ্ধের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাংকারে তৈরির পর
গ্রামের কাউকে এলাকার বাইরে যেতে দেননি মুক্তিযোদ্ধারা, অর্ধবৃত্তাকারে যাতে
ব্যাপক প্রস্তুতির কথা ফাঁস না হয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা যখন ৩০টি
নৌকাযোগে বেলা ১০টার দিকে খোলাবাড়িয়ার অভিমুখে এগোতে থাকে তখন নিজেদের অস্ত্রের
আয়ত্তের মধ্যে আসার আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা কোনো টু-শব্দটি করেননি।
মুক্তিযোদ্ধারা তখন বাঙ্কারের মধ্যে অবস্থান নিয়ে শত্রুসেনাদের গতিবিধি ও দূরত্ব
পর্যবেক্ষণ করছিলেন। একটা সময় পাকবাহিনী ফায়ার ওপেন করতে করতে মুক্তিযোদ্ধাদের
বাংকারের খুব কাছে এসে দুই ইঞ্চি মর্টার ও এলএমজি ব্যবহার এবং শেল নিক্ষেপ করে।
কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই বাংকারে সম্মুখের পানিতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে
মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারেন যে, অপারেশনে আগত পাকবাহিনীর সদস্যরা খুব বেশি
পারদর্শী নয়। শত্রুসৈন্য নিজেদের রেঞ্জের মধ্যে আসার পরও যখন মুক্তিযোদ্ধা
কমান্ডার কর্তৃক ফায়ার ওপেনের নির্দেশ এলো না, বাংকারে পজিশনরত আব্দুর রাজ্জাক
শত্রুসেনাদের অবস্থান জানার জন্য মাথা তোলা মাত্রই পাকসেনারা তাকে গুলি করে।
কিছুক্ষণ পর আব্দুর রাজ্জাক মারা গেলে গেরিলা কমান্ডার চিত্তরঞ্জন রায়ের
চূড়ান্ত নির্দেশে এলএমজি দিয়ে ফায়ার ওপেন করা হয়। ততক্ষণে পাকিস্তানিরা
মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ারিং রেঞ্জের আওতায় চলে এসেছে।
এভাবে গ্রামের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় প্রায়
৩ ঘণ্টা বিরামহীন গোলাগুলির পর পাকিস্তানিরা নৌকা নিয়ে পিছু হটতে থাকে।
শত্রুপক্ষের ৩০টি নৌকার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ১৮টিই ফুটো হয়ে যায়, এর
মধ্যে ৪টি নৌকা একেবারেই ডুবে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বৃষ্টির মতো গুলিতে
পাকবাহিনী নৌকা নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ফলে খোলাবাড়িয়ার সম্মুখ
যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধে আব্দুর
রাজ্জাকের দুঃখজনক মৃত্যু ছাড়া আর কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। উপরন্তু পরাজিত
পাকবাহিনীর অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ তাদের নৌকা থেকে উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনীর
গেরিলাযোদ্ধারা যা পরবর্তীতে নাটোরের নলডাঙার অপারেশনে ব্যবহার করা হয়েছিল।