নৌকাডুবির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করো।
মানুষ কত বিষয়ে তো অভিজ্ঞতা লাভ করে। তার কোনোটা হাসি-আনন্দের, কোনোটা ব্যথার,
কোনোটা ভয়ের। আমার এই অভিজ্ঞতাটাই বড়ই কষ্টের এবং ভয়ের। তখন আমি বেশ ছোট। মামা
বাড়ি যেতে বেশ খানিকটা, প্রায় তিন ঘন্টার পথ আমাদের নৌকায় করে যেতে হয়। অন্য
কোন উপায়ে যাতায়াত করা যেত না। উপরের গোল ছাউনি দেয়া মাঝারি আকারের নৌকা। একজন
কী দুজন মাত্র মাঝে থাকতো। নৌকার ভিতর ঘুমিয়ে বা শুয়ে বসে থাকা যেত। আমার কাছে
নৌকা ভ্রমনের এই সময় টুকুছিল দারুণ ভাললাগার এবং লোভনীয়।আষাঢ়ের মাঝামাঝি
সময়ের কথা। মামাবাড়ি যাচ্ছি অনেকদিন পর মা'র সঙ্গে। ছোটমামা আমাদের নিতে
এসেছেন। বাগেরহাট জেলায় থেকে বেবিটেক্সি করে নৌকা ঘাটে যখন পৌছালাম তখন দুপুর
গড়িয়ে গেছে। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল সকাল থেকেই, সাথে বেশ জোরালো হাওয়া। মামা
একটি নৌকা ভাড়া করলেন। স্থানীয় ভাষায় এসব ছাউনি দেওয়া নৌকাকে বলে 'টাবুরে'।
বদর বদর বলে মাঝি নৌকা ছাড়লো। আমার বয়সী একটি ছেলে দাঁড় টানছিলো। নদীর বুকে
টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ, একই সঙ্গে নৌকার দুলুনি, দাঁড় টানার শব্দ এবং মাঝির দরাজ
গলায় ভাটিয়ালি গানের সুর - সবমিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর এক মায়াময় পরিবেশ, যার
দোলায় আমি দোলায়িত হচ্ছিলাম। বর্ষার মরা নদীতে তখন প্রবল স্রোতের অনুকূলে
আমাদের নৌকাটা তরতর করে চলছিল। ঘুষিখালি নামক স্থানে দাড়টানা এবং পশুর নদীর
সঙ্গমস্থল। জায়গাটি ছিল বিপদজনক। কারণ ওখানে ছিল ঘূর্ণিস্রোত। আমাদের যেতে হবে
তার উপর দিয়েই। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের নৌকাটি ঘূর্ণিস্রোতে পতিত হলো। শত চেষ্টা
করেও মাঝি নৌকাটি বাঁচাতে পারলেন না। নৌকাটি তখন ডুবে যায় যায় অবস্থায়
চক্রাকারে ঘুরছে। ছাউনির ভিতর বাতাস ঢোকার জন্য কোনোরকমে নৌকাটি ভেসে আছে। মা,
মামা, মাঝি চিৎকার চেঁচামেচি করছে সাহায্যের জন্য। আমাকে নৌকার ছইয়ের উপর তুলে
দিয়ে আর সবাই নৌকাটি ধরে ভেসে আছে। জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সবাই
সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করছিলাম। এমন সময় অন্য আরেকটি বড় নৌকা এসে আমাদের
উদ্ধার করে। কিন্তু নৌকাটি বাঁচানো গেল না। জীবনের সে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা আমি
কখনো ভুলব না।