'নিখোঁজ' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।
নিখোঁজ
আশুলিয়ার তুরাগ তীরের পথ ধরে হাঁটছিলাম আমি আর রাফি। রাফি আমার বন্ধু। আমরা
দুজন একই কলেজে পড়াশুনা করি এবং একই হোস্টেলে থাকি। আমরা দুজন মাঝে মাঝেই
বেরিয়ে পড়ি শহর থেকে কিছুটা দূরে এবং অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানে ঘুরে বেড়াই।
সেদিনও দুই বন্ধু হাটছিলাম। আমি একটু গান পাগল ছেলে। আমি ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে
গান শুনছিলাম। প্রকৃতি পাগল রাফি চারপাশের প্রকৃতি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে আর
আমার সঙ্গে কথা বলছে। যদিও আমি রাফির কোন কথায় স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম না, তবুই
যেটুকু বুঝতে পারছিলাম তা হলো- রাফি বলেছে, জানিস ইমন, তুরাগের তীরের এই পথটা
আমার খুব ভালো লাগে। দেখ নদীর পানিতে ছোট ছোট নৌকা চলছে, কেউ পানিতে পাইপ লাগিয়ে
পানি তুলছে, আবার কেউ মাছ ধরতে জাল নিয়ে ঘুরছে। আর ঐ পাশটা দেখ, কী সুন্দর!
জমিতে ধানের গাছগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। মনে হয় কেউ যেন সবুজ রং ছড়িয়ে দিয়েছে।
আরও দূরে ইটের ভাটার সুইচ্চ চিমনিগুলো যেন এক-একটা দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে আর
মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। আমি রাফির কথাগুলো কখনো শুনছিলাম, কখনো বুঝতে পারছিলাম,
কিংবা বোঝারও চেষ্টা করছিলাম না। কারণ এ পথে যেদিনই এসেছি রাফি প্রায় একই কথা
বলতো। আর তাই আমি নিজের মনে গান শুনছি আর এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবে কিছু সময় পেরিয়ে
যাবার পর মনে হলো রাফির কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। পিছনে ফিরে দেখি রাফি নেই।
কিছুটা বিস্মিত হলাম। কোথায় গেল রাফি! ভাবছি কোনকিছু দেখে হয়তো সেখানে গেছে,
খুব ভালোভাবে দেখে এখুনি ফিরে আসবে। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল কিন্তু রাফি
ফিরছে না। আমার বিস্ময় এবার রূপ নিল চিন্তায়। বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম আমি। কী
হলো রাফির? আর ও গেলইবা কোথায়? আমি চারদিকে থাকাতে থাকি, কিন্তু রাফিকে কোথাও
দেখা যাচ্ছে না। বেশ দূরে একজন দেখলাম জমিতে কাজ করছে। তাকে গিয়ে
বললাম, ভাই, আমার বয়সী একটা ছেলেকে দেখেছেন? আমরা একই সঙ্গে হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখি
সে নেই। লোকটি যেন সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকালেন। এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
প্রশ্ন জিজ্ঞাস করলেন। এরই মধ্যে আরও একজন উপস্থিত হলেন। সবারই ধারণা, আমিই
রাফির কোনো ক্ষতি করে মিথ্যে নাটক করছি। তাদের মধ্যে একজন তো বলেই বসলো,
ছেলেটাকে ধরে রাখ আমি পুলিশে ফোন দিচ্ছি। এরই মাঝে রাফিকে হারিয়ে এবং এমন
অবস্থায় পড়ে আমি ভয়ে ঘামতে শুরু করেছি। এক পর্যায় পুলিশও চলে এলো। পুলিশের এক
কর্মকর্তা এসে সবার আগে বললেন, আগে থানায় চলেন। তারপর দেখছি। উপস্থিত কেউ আমার
কথা বিশ্বাস করলেন না। পুলিশ আমাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর পিছনে বেশ কজন
লোক কৌতুহলী হয়ে হাঁটছেন। এ অবস্থায় বুঝতে পারছি না আমার কি করা উচিত। রাফির
ফোনের সুইচ অফ। তাই কোন উপায় না দেখে পুলিশের সাথেই হাঁটছি। যে পথ দিয়ে দুই
বন্ধু এসেছিলাম সেই পথ ধরেই হাঁটছি। পথের দুপাশে বালির স্তুপ। মাঝখানের সরু
রাস্তা দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি রাস্তা থেকে বেশ দূরে বালির উপর কালো
কী যেন একটা। আরও ভালো করে খেয়াল করলাম সেটি একটি মাথা। দৌঁড়ে কাছে যেতেই শুনতে
পেলাম, ইমন আর কাছে এসো না। এই বালির নিচে একেবারে পানি। পা পড়লেই তুমি ডুবে
যাবে। বুঝতে পারলাম প্রকৃত ঘটনা। আমরা দুই বন্ধু হাঁটার সময় অন্যমনস্কভাবে রাফি
সেই বালির নিচে পড়ে যায়, আর কানে ইয়ারফোন থাকায় আমি রাফির ডাক শুনতে পাই নি।
এবার পুলিশের পালা। পুলিশ একটি রশির মাথা দিল রাফির কাছে আর অন্য মাথা পাশে
থাকা একটি গাছের সাথে বাঁধল। এরপর ধীরে ধীরে রাফিকে টেনে তুলতে লাগল। এক
পর্যায়ে সমস্ত শরীরে পানি, কাদা আর বালি নিয়ে এক অদ্ভুত চেহারায় উঠে আসে রাফি।
উপরে এসেই রাফি এই অবস্থায় আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার দুচোখ দিয়ে তখন গড়িয়ে পড়েছে
অশ্রু।