'নদীর দীর্ঘশ্বাস' শিরোনামে একটি খুদে গল্প রচনা করো:
নদীর দীর্ঘশ্বাস
কাজরী নদীর তীরে গড়ে ওঠা ‘কমলপুর’ গ্রাম। গ্রামের মানুষের কাছে এই নদী যেন
অন্তঃপ্রাণ। কত শত মানুষের সংসার চলে এই নদীকে ঘিরে। পরান মাঝি, কৃষ্ণদাস, রবি,
ছমির তাদের মধ্যে অন্যতম। এই নদী সবাইকে হাত ভরে দিয়েছে শুধু, বিনিময়ে নেয়নি
কিছুই। পরান মাঝি নৌকায় লোকদের পার করে যে টাকা আয় করতেন তা দিয়ে সংসার
চালাতেন। কৃষ্ণদাস, রবি ও ছমিরের সংসার চলত মাছ ধরে। এদের মধ্যে পরান পঞ্চম
শ্রেণি অবধি পড়ালেখা জানা। সব মিলিয়ে অভাব-অনটনের সংসারে ‘কাজরীকে’ ঘিরে
গ্রামের মানুষের দিন ভালোই কাটছিল। একদিন পরান মাঝি গ্রামের সকলকে ডেকে বললেন-
“শোন হগ্গলে। আমাদের এই নদীর উজানে নাকি সরকার ড্যাম না কী জ্যান কয় হেউডা দিব।
আমাদের কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হইবো।' ভিড়ের মধ্য থেকে ছমির বলে ওঠে
ক্যানগো মাঝি ড্যাম দিলে কী হইব? পরান তখন বুঝিয়ে বলে— ‘ড্যাম দিলে আমাগো নদী
মইরা যাইব, দুই ধার জুইড়া চর জাগব, নদীতে আর মাছ হইব না। তহন আমরা খামু কী? আর
বেচুম কী?’ তখন সবাই বুঝতে পারে ড্যাম দিলে কতটা ক্ষতি হবে ‘কাজরীর’ সাথে তাদেরও
৷ তাই সবাই এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চায়। তাদের সাথে ছিল স্থানীয়
পত্রিকাগুলো। সম্মিলিত প্রতিবাদ জানাতে তারা জেলা প্রশাসকের অফিস ঘেরাও করে।
কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। উল্টো তাদের কয়েকজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এভাবে কয়েক
মাস কেটে গেলেও কোনো প্রতিকার পায়নি কমলপুরের লোকজন। তারপর কাজরীর বুকে ড্যাম
হয়েছে। পানির স্রোত হাঁটুর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে। এক কালের ভরা যৌবনা কাজরী আজ
জীর্ণ-শীর্ণ। দুধারে এখন শুধু বালু আর বালু। পরান মাঝি কাউকে আর নৌকায় করে নদী
পার করে না। কৃষ্ণদাস, রবি, হারান, ছমির মাছের অভাবে আদি পেশাই ছেড়ে দিয়েছে।
সংসারে নেমে এসেছে দুর্দশা। ভাত-কাপড়ের খোঁজে কমলপুরের অনেকেই আজ শহরমুখী।
বাপ-দাদার ভিটা মাটি ছেড়ে যেতে চায়নি পরান, কৃষ্ণদাস, ছমির, রবি। অবশেষে পেটের
দায়ে তারাও রাতের আঁধারে কমলপুরের মাটি ছেড়েছে। যাবার সময় দুচোখ বেয়ে বয়েছে
জলের ধারা। মায়ের মতো নদীকে আজ যেন তারা পর করে দিয়েছে। কাজরী ধূধূ চর নিয়ে
রইল পড়ে কমলপুরে। কিন্তু সেদিনের সেই মানুষগুলো আজ নেই। একদিন খোঁজ না নিলে
যাদের চলত না; সেই তাদের দেখা নেই আজ বহুদিন। কাজরীর বুকে এখন শুধুই দীর্ঘশ্বাস।