'প্রাপ্তি' শিরোনামে একটি খুদে গল্প লেখ।
প্রাপ্তি
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে রাহেলা তার মা নছিরনের পিছু নিয়েছে। ভয় তার একটাই মা না
জানি কখন কাজে বেড়িয়ে যায়। তার একটাই দাবি, তাদের বস্তিঘরের পাশের বিল্ডিংয়ে থাকা
ওরই বয়সী রিতুর নতুন পোশাকটির মতো একটি পোশাক। এ কারণে নছিরনের পিছু পিছু ঘুরতে
ঘুরতে রাহেলা বলতে থাকে- 'হেই জামাটা আমারে আইন্না দাও।' মা তার এসব কথা শুনতে
শুনতে এক পর্যায়ে খুব রেগে উঠে। ঠাস করে মেয়ের গালে একটি চড় বসিয়ে দিয়ে বলতে
থাকে, আমারে কী কস? তোর বাপেরে গিয়া ক। হেই ব্যাটা তো মাইয়া জন্ম দিয়াই ফুরুৎ। হের
দায়িত্ব নাই? কুনু কথা কইতে পারবি না, চুপ মাইরা থাক কইলাম। মায়ের এমন ধমক শুনে
রাহেলার কান্না আরো বেড়ে গেল। আজ এমনিতেই নছিরনের মেজাজটা ভালো নেই। আর ওপরে
মেয়ের এই আবদার। রাহেলাকে আরো দুই তিন চড় বসিয়ে দিয়ে স্বামীর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার
করতে করতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় নছিরন। সে কি করবে বুঝতে পারে না। সাত বছর আগে
বিয়ে হয়েছিল, সে যে বাড়িতে কাজ করত সে বাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে। ড্রাইভারটি তখন
বলেছিল, গ্রামে সে বিয়ে করেছে। কিন্তু সে স্ত্রী মারা গেছে। কিন্তু বিয়ের এক বছরের
মাথায় যখন রাহেলার জন্ম হলো তখন হটাৎ একদিন সে ড্রাইভারের স্ত্রী এসে হাজির।
ড্রাইভার তখন প্রথম স্ত্রীর সাথে চলে যায়। রেখে যায় নছিরন ও রাহেলাকে। সেই থেকে
নছিরনের জীবনে শুরু হয় আর এক যুদ্ধ। নিজের পাশাপাশি মেয়ের খাবার যোগান দেয়া। তার
উপর মেমসাহেবের মেয়ের মতো পোশাক। নছিরন তার মালিকের বাসায় কাজ করে আর ভাবে কীভাবে
রাহেলাকে নতুন জামা কিনে দেওয়া যায়। নছিরন এই বাড়িতে কাজ করে। এ বাসায় সে দুবেলা
খায় আর হাতে পায় দু হাজার টাকা। সেই টাকায় চলে ঘর ভাড়া আর রাহেলায় খরচ। এ থেকে
কোনভাবেই টাকা বাঁচানো সম্ভব নয়। ঘরের মেঝে মুছতে মুছতে হঠাৎ করে নছিরন উঠে এগিয়ে
যায় বাড়ির মালিকের স্ত্রী আফসানা চৌধুরীর কাছে। বলে, আফা একটা কথা কইতাম। আফসানা
বলেন, বল কী বলবি। নছিরন বলে, 'আফা,মুই দুপুরের খাওয়ন খাইতাম না। হের বদলে মাসে
পাঁচশ টাকা দিতে হইব। মুই বাড়ি থেইক্যা খাইয়া আমুনে। সেই থেকে নছিরন সকাল ও
দুপুরে খাই না, শুধু রাতে খায়। এর বিনিময়ে নছিরন পাবে মাসে পাঁচশত টাকা বেশি।
নছিরন বাড়ি গেলেই রাহেলা বলে, 'আম্মা আর কয়দিন পরে আমারে জামা দিবা?' নছিরন মেয়েকে
বোঝাতে থাকে, আর তো মাত্র কয়ডা দিন। আইন্যা দিমু নে। নছিরন দেখে রাহেলা নতুন জামা
পাবে বলে খুব খুশি। রাহেলা তার সাথিদের বলে, জানস মা মোরে নতুন জামা আইন্যা দিব।
নছিরনও দিন গুনতে থাকে। কেননা এইভাবে দিনে একবার মাত্র খাওয়ার ফলে ক্রমেই তার
শরীর দুর্বল হয়ে যায়। আর মাত্র কয়টা দিন। তাহলেই দুই মাস হবে। দুই মাসে
একহাজার টাকা বেশি পাবে নছিরন। সেই টাকা দিয়ে সে কিনবে মেয়ের জন্য নতুন জামা। আজ
রাহেলার খুব খুশির দিন। তার মা নছিরন তার জন্য নতুন জামা আনবে। নছিরন একেবারে
শুকিয়ে গেছে। তবুও তাকে চলতে হচ্ছে। আফসানা চৌধুরীর কাছে দুমাসের একবেলা খাবারের
পরিবর্তে জমা রাখা এক হাজার টাকা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের সাহেবের মেয়ের মতো জামা
কেনে। দোকান থেকে বের হয়ে হাটতে থাকে নছিরন। হঠাৎ করেই মাথা ঘুরে পড়ে
যায়।কিছুক্ষণ পর আবার চলতে শুরু করে। বাড়ির সামনে গিয়ে দেখে রাহেলা মায়ের জন্য
অপেক্ষা করছে। মাকে দেখেই রাহেলা দৌড়ে যায় মায়ের কাছে। বলে, মা মোর জামা কই। ঢুলতে
ঢুলতে জামাটি বের করে দেয় মেয়ের হাতে। জামাটি পেয়ে রাহেলা মায়ের দিকে চেয়ে এক
চিলতে হাসি দিয়ে উঠে। রাহেলার সেই হাসি দেখে নছিরন ভুলে যায়, তার গত দুই মাসের
অনাহারের কথা। নছিরনও হেসে উঠে মেয়ের সঙ্গে।