"স্মৃতিচারণ" শিরোনামে একটি খুদে গল্প রচনা করো।
স্মৃতিচারণ
প্রকৃতি তাকে খুব টানে। তাই প্রতিবারের মতো শীতের ছুটিতে সে এসেছে পরিচিত
প্রকৃতির কোলে। কিন্তু সারি সারি গাছ উজাড় হতে দেখে তার হৃদয়ে ওঠে বেদনার ঝড়।
শুক্রবারের বিকেলের সময়টা আজমল সাহেবের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রী গত
হয়েছেন প্রায় দশ বছর হলো। ছেলেমেয়েরাও সবাই যার যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত।
কিন্তু আজমল সাহেব আজও প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর স্ত্রীর কবর জিয়ারত
করেন। প্রতি বিকেলে অবসর সময়টা একা একা ব্যালকনিতে বসে কাটিয়ে দেন। ফেলে আসা
দিনগুলোর কথা ভাবেন। এই বাড়িটা তাঁর স্ত্রী মনের ইচ্ছা অনুযায়ী সাজিয়েছিলেন।
হাজার রঙের ফুলের বাগানে সারা বছর ধরে ফুল ফোটে। একটা সময় ছিল এই ব্যালকনিতে বসে
বিকেলে দুজনে একসঙ্গে চা খেতেন। দূর থেকে মন মাতানো ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসত আর
সঙ্গে মৃদুলয়ে বাজত রবীন্দ্রসংগীত। আজমল সাহেবের স্ত্রী রেবা দশ বছর আগে রোড
অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। ছেলেমেয়েদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি দেশ ছেড়ে বিদেশ
যেতে রাজি হননি। অবসর সময়ে তিনি অনুভব করেছেন মৃত্যুর পরেও বন্ধুর মতো রেবা
সবসময় তাঁর সঙ্গে আছে। রেবা গাছ খুব ভালোবাসত, তাই যখনই সময় পেতেন, চলে যেতেন
প্রকৃতির সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য। রেবা বেঁচে থাকতে প্রতিবছর শীতের
শুরুতেই তিনি গ্রামে যেতেন, গ্রামে বাপ-দাদার পৈতৃক ভিটেয় গিয়ে ঘুরে আসতেন।
এই তো মাত্র আর ক’দিন। তারপরেই শীত শুরু হবে। রেবার মৃত্যুর পর এই প্রথম আবার
বাড়িতে যাওয়ার একটা ইচ্ছা তাঁর মনে উঁকি দিল। গ্রামে শীতের আমেজটাই অন্যরকম।
শীতের সকালে রোদ পোহানো, পিঠা-পুলি খাওয়ার কোনো জুড়ি নেই। ভাবতে ভাবতে কোথায়
যেন হারিয়ে যান আজমল সাহেব। গ্রামে নিজের বাগানবাড়ি আছে, আছে রেবার হাতে লাগানো
অনেক গাছ। গাছগুলোর সঙ্গে রেবারই শুধু নয় বরং জড়িয়ে আছে প্রিয় সন্তানদের
স্মৃতি। এক একটা উপলক্ষ্যে এক এক ধরনের গাছ লাগাতে পছন্দ করত রেবা। এ গাছগুলোও
আজমল সাহেবের কাছে তাঁর সন্তানের মতোই। কিন্তু আজ অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেল
বাড়ি যাওয়া হয় না। বাড়িতে না যাওয়া হলেও গ্রামে আজমল সাহেবের আপন দুই ভাই
থাকে। তারাই সবকিছুর দেখাশোনা করে। নিজের বাড়িতে কেমন যেন অতিথির মতোই লাগে এখন
নিজেকে। মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলে যায়। সবকিছু কেমন যেন পর
হয়ে যায়। তিনি ভাবলেন, আবার তিনি ফিরবেন আপনজনদের কাছে। বাবা-মায়ের কাছে,
বাবা-মা ঠিক নয়, তাঁদের কবরের কাছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন সবকিছু কেমন
যেন বদলে গেছে। কোথায় হারিয়ে গেল রেবার হাতে লাগানো সেই জারুল, কৃষ্ণচূড়া,
মেহগনি গাছ। সে জায়গাগুলো এখন দখল করে আছে ছোট ভাইদের সদ্য বানানো নতুন ঝকঝকে
বিল্ডিংগুলো। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি। নিজেকে কেমন অনাহূত অতিথি বলে
মনে হলো। নিজের সন্তানরা দূরে চলে গিয়েছিল অনেক আগেই। কর্মব্যস্ততায় সে বেদনা
তিনি টের পাননি। আজ হঠাৎ যেন তাঁর মনের মধ্যে সন্তান হারানোর বেদনা ডুকরে উঠল।